পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার পার্বত্য অঞ্চলটি বাদ দিয়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু প্রধানত উদ্বু ও আর্দ্র এবং ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ুর দ্বারা প্রভাবিত। বৎসরের এক উল্লেখযোগ্য সময় (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহের অন্তর্গত হয় আমাদের রাজ্য। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে এবং কখনো কখনো সেপ্টেম্বর মাসেও। শীতকালে কোনো কোনো বছর পশ্চিমী ঘূর্ণাবর্ত কাশ্মীরে ঢুকে উত্তর পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা হয়ে আমাদের রাজ্যের দিকে এগিয়ে এসে পড়লে শুদ্ধ ঋতুতেও আর্দ্র বৃষ্টিযুক্ত আবহাওয়া কয়েকদিনের জন্য তৈরি হয়। শীতকাল সাধারণভাবে নাতিশীতল ও নাতিশুদ্ধ উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর অন্তর্গত।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রকসমূহ:
কর্কটক্রান্তিরেখার নৈকট্য: কর্কটক্রান্তিরেখা পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ কর্কটক্রান্তিরেখার কাছে এবং উত্তরবঙ্গের হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল বাদে বাকি অংশ কর্কটক্রান্তিরেখার সন্নিকটে হওয়ায় জলবায়ু উয় ও আর্দ্র প্রকৃতির।
উচ্চতা: উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল উচ্চতার জন্য সারাবছরই আরামদায়ক শীতযুক্ত হলেও পশ্চিমবল্যের অধিকাংশই নিম্নভূমি বলে উয়তার আধিক্য দেখা যায়।
ভূ-প্রকৃতি : উত্তরে হিমালয় পর্বতের অবস্থানের জন্য মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে বাধা পেয়ে পশ্চিমবলো প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় বলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বর্ষাকাল।
সমুদ্র থেকে দূরত্ব: দক্ষিণবঙ্গের এক বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় উদ্বুতার চরমভাব কম, তবে পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল সমুদ্র থেকে যথেষ্ট দূরে হওয়ায় জলবায়ু অপেক্ষাকৃত উয় ও শুদ্ধ।
মৃত্তিকা: আমাদের রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা নরম পলিগঠিত হওয়ায় অধিক উত্তপ্ত হতে পারে না বলে তাপ বিকিরণ কম হওয়ায় উদ্বুতার আধিক্য কম। তবে পশ্চিমের মালভূমি অংশে শিলাময় মৃত্তিকা অঞ্চলে উন্নতার আধিক্য ও চরমভাব দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের ঋতু: পশ্চিমবঙ্গের গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত-এই ছয়টি ঋতু থাকলেও ভারত সরকারের আবহদপ্তর পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে চারটি ঋতুতে বিভক্ত করেছেন। এগুলো নিম্নরূপ-
(১) গ্রীষ্মকাল (মার্চ ও জুন এর মাঝামাঝি): ২১ মার্চ সূর্য নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয় এবং তারপর ক্রমশ উত্তরে সরে যেতে থাকে এবং অবশেষে ২১ জুন কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। এই সময় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে উত্তাপের পরিমাণ খুব বৃদ্ধি পায় (৩৮০-৪২° সে.) এবং পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়ে ঝড়বৃষ্টি হয়। এই স্থানীয় ঝড়কে কালবৈশাখী (Nor' Wester) বলে।
(২) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন (জুন-এর মাঝ থেকে সেপ্টেম্বর): মে ও জুন মাসের শেষে প্রচণ্ড উত্তাপের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (বিশেষ করে পাঞ্জাবে) প্রচণ্ড নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ে না গিয়ে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে আরও শক্তিশালী হয়ে পার্শ্বাবের নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ধাবিত হয়। এই দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করার পর ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে রূপান্তরিত হয়। একে শ্রীষ্মের মৌসুমি বলে। বছরের একটি বিশেষ ঋতুতে এই বায়ু প্রবাহিত হয় বলে একে মৌসুমি বায়ু (আরবি ভাষায় 'মৌসম' কথার অর্থ ঋতু) বলা হয়।
আমাদের রাজ্যে জলবায়ুতে দঃ পঃ মৌসুমি বায়ুর প্রভাব: এই বায়ু দীর্ঘ পথ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে বলে জলীয় বাষ্পপূর্ণ থাকে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। ভারতে এই বায়ু আরবসাগরীয় ও বঙ্গোপসাগরীয় এই দুই শাখায় বিভক্ত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ষা ঋতু এই আর্দ্র বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমি বায়ুর আগমনেই ঘটে থাকে। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত (৩০০ সেমি) হয়। তরাই ও উত্তরবঙ্গে (৩০০ সেমি) এবং মেদিনীপুর ও সুন্দরবন উপকূল (২০০ সেমি) থেকে পশ্চিমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে (১৬০-১০০ সেমি)।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু যেহেতু ভারতীয় মৌসুমীবায়ু প্রবাহের অন্তর্গত তাই এই বায়ুপ্রবাহ জেট স্ট্রীম (পৃ. ২.৬-৮) ও এল নিনো (পৃ. ২.৯-১০) দ্বারা একইভাবে প্রভাবিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে কেরালায় প্রবেশ করার দু'সপ্তাহের মধ্যেই এবং অবস্থান করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।
(৩) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমন(অক্টোবর-নভেম্বর) অক্টোবর মাসের গোড়ায় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে চলে যাওয়ায় পাঞ্জাবের নিম্নচাপ বলয় ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে এবং সেখানে ক্রমশ উচ্চচাপের সৃষ্টি হতে থাকে। এই উচ্চচাপ থেকে নির্গত বায়ু ক্রমশ অধিক শক্তিশালী হয়ে গ্রীষ্মের মৌসুমি বায়ুকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগরে এই দুই বায়ু মিলিত হয়ে ঝড়বৃষ্টি ঘটায়। একে আশ্বিনের ঝড় বলে।
(৪) শীতকাল (ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি): ডিসেম্বর মাসের প্রথমেই গ্রীষ্মের মৌসুমি বায়ু পশ্চিমবলা থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাগমন করে। তখন পাঞ্জাবের প্রবল উচ্চচাপ বলয় থেকে শীতল শুদ্ধ বায়ু গাঙ্গেয় সমভূমির ওপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। একে শীতের মৌসুমি বায়ু বলে। এই সময় পশ্চিমবঙ্গে শুদ্ধ শীতল অতি মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করে। রাতে উত্তাপের গড় ১৫° সে.-এর মতো থাকে।
পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু: উচ্চস্থান শীতল হয়।প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতায় ৬-৪° সেন্টিগ্রেড হারে তাপ হ্রাস পায়। এজন্য পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু প্রধানত শীতল থাকে। জলভরা বাতাস হিমালয় পর্বতে বাধা পায় বলে এই পার্বত্য অঞ্চলে বর্ষা আগে শুরু হয় এবং বৃষ্টিও খুব বেশি (৩০০ সেমি) হয়। গ্রীষ্ম অতি মনোরম কিন্তু শীতকালে তীব্র শীত (৫° সেন্টিগ্রেডের নীচে নেমে যায়)। দার্জিলিং-এ কখনো কখনো তুষারপাত হয়।
পশ্চিমবঙ্গে পার্বত্য জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য: প্রায় সারাবছর শীত অনুভূত হয়, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি তীব্র শীত, দার্জিলিং রাজ্যের শীতলতম অঞ্চল। শীতকালে তুষারপাত এই জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য, দার্জিলিং হিমালয়ের প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত হয় উত্তরবঙ্গোর পার্বত্য অঞ্চলে ও পর্বত পাদদেশে প্রচুর শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত (৩০০-৪০০ সেমি) হয়, পর্বত পাদদেশে তরাই অঞ্চলে পার্বত্য নদীগুলির জল নেমে আসায় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় তরাই অঞ্চলের জলবায়ু আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে, এটি রাজ্যের আর্দ্রতম স্থান, শীতকালে তুষারপাতের দিনগুলি ছাড়া সাধারণভাবে আকাশ থাকে নির্মল ও মেঘমুক্ত, ক্যাটাবেটিক বায়ুর প্রভাবে মাঝে মাঝে শৈত্যপ্রবাহ ঘটে, পার্বত্য অঞ্চলের উচ্চতর স্থানগুলি সরাসরি সূর্যতাপ পায় বলে দিনের বেলায় আবহাওয়া খুব আরামদায়ক থাকে, অধিক উচ্চতার জন্য তীব্র শীতল জলবায়ু পর্বত শৃঙ্গগুলিকে তুষারাবৃত রাখে।