অর্থনৈতিক অঞ্চল
সংজ্ঞা ও ধারণা (Definition and Concept):
■ অঞ্চল হল এমন একটি ধারণা যা বুঝতে সাহায্য করে বিভিন্ন স্থানের বৈশিষ্ট্যগত ঐক্য বা অনৈক্যকে (Unities and Diversities)। 'অর্থনৈতিক অঞ্চল' হল নির্দিষ্ট আঞ্চলিক পরিসরে উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়ণ করা।
বৈশিষ্ট্য: (i) অর্থনৈতিক অঞ্চল ভারতে পরিকল্পনা অঞ্চল হিসেবে সরকারিভাবে কৃত ও গৃহীত হয়, তাই অনেক সময় প্রশাসনিক আঞ্চলিক ব্যাপ্তি থাকে তার। তবে নদী প্রকল্প গ্রহণ মাধ্যমে নদী অববাহিকার অঞ্চলগত আন্তঃরাজ্য সীমানায় ব্যাপ্ত থাকতে পারে পরিকল্পনা অঞ্চল।
(ii) অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্দেশ্য আঞ্চলিক উন্নয়ন যা একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে সংঘটিত হবে। প্রয়োজন হবে শ্রমশক্তির দক্ষতাসহ মানব সম্পদের ব্যবহার। পরিকল্পনা অঞ্চলের ধারণা এসেছে আঞ্চলিক সম্পদ চিহ্নিতকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়িত করার জন্য।
ভারতে অনেক অশ্বলই রয়েছে সম্পদ উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে পড়া। ফলে জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রার মানও রয়ে গিয়েছে নিম্ন। কিন্তু পরিকল্পনা অঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে আম্মলিক সম্পদ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে ও তার সঠিক ও সময়োপযোগী বিকাশ ঘটাতে পারলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসাধারণের মানোন্নয়ন সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রসরতার প্রয়োজনেই এরূপ পরিকল্পনা অঞ্চল সৃষ্টির প্রয়োজন।
ডক্টর ভি. নাথ তাঁর 'Regional Development and Planning in India' পুস্তকে লিখেছেন-'Planning regions have to serve as the spatial units for formation and implementation of development plants They must, therefore, be demarcated, keeping in view of objective of planned development.... অর্থাৎ পরিকল্পনা অঞ্চলকে স্থানীয় একক হিসাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়ণ করতে হবে। এজন্য এগুলি সুচিনিন্তিত হতে হবে পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিয়ে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল: বৈশিষ্ট্য এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য:
(ক) কৃষি ও কৃষি সহযোগী অর্থনৈতিক উন্নয়ন (মৎস্য সংগ্রহ, পশুপালন, বনজ সম্পদ সংগ্রহ ইত্যাদি)।
(খ) শিল্প, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
(গ) শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন।
(ঘ) পৌরায়ণ তথা নগরায়ণ।
(ঙ) পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনে জল, মৃত্তিকা, অরণ্য সংরক্ষণ।
প্রথম ক্রম বা বৃহৎ বা ম্যাক্রো (Macro) অঞ্চল (First order region): প্রাকৃতিক উপকরণসমূহের বৈচিত্র্যসম্পন্ন কিন্তু চাহিদা ও সমস্যাগুলির একই প্রকার, খাদ্যে সয়ম্ভরতার প্রচেষ্টা, শিল্পের কাঁচামালের যোগান, শক্তিসম্পদের যোগান, পরিবহন যোগাযোগ প্রভৃতি উন্নয়নের সম্ভাবনাময়। আঞ্চলিক বিকাশের উদ্দেশ্যে উন্নয়ন কেন্দ্র ও উৎপাদন কেন্দ্রসমূহের গড়ে ওঠা।
প্রথম রুম হায়ারার্কি (Hirechary)-র সর্বোচ্চ ক্রম। সম্পদ উন্নয়নের প্রকল্প বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে যেমন একটি নদী অববাহিকা (গঙ্গা নদী অববাহিকা) অথবা একটি বৃহৎ প্রদেশ বা একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হতে পারে। এই অঞ্চলের জনসাধারণের চাহিদা একপ্রকার হতে পারে কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থা ও সম্পদের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই ক্রমটি দ্বিতীয় রুমের অনেকগুলি অঞ্চল নিয়ে গঠিত হতে পারে।
দ্বিতীয় ক্রম বা মাঝারি বা মেসো (Meso) অঞ্চল (Second order region): গঠিত হয় অনেকগুলি ক্ষুদ্রায়তন অঞ্চল নিয়ে। মাঝারি আয়তনের এই রুমের অঞ্চল সম্পদের কার্য্যকরি ব্যবহার এবং বিশেষীকরণের দ্বারা বিভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থায় সাফল্য আনায় সচেষ্ট থাকে। ন্যূনতম অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা সহ খাদ্য, বাসস্থান ও শ্রমনিযুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এটি আঞ্চলিক বিভাগের দ্বিতীয় পর্যায় যা অনেকগুলি তৃতীয় ক্রমের অঞ্চল নিয়ে গঠিত হতে পারে। অন্যভাবে বলা যায় প্রথম ক্রমের এক একটি উপবিভাগ দ্বিতীয় ক্রমের অঞ্চল। প্রথম পর্যায়ে যেমন ভৌগোলিক বৈচিত্র্য থাকে দ্বিতীয় ক্রমে কিন্তু ভৌগোলিক পরিবেশ ও সম্পদ সম্ভাবনায় সমতা পরিলক্ষিত হয়। এরূপ রুম রচনার উদ্দেশ্য স্থানীয়ভাবে সম্পদ সংগ্রহে গুরুত্ব আরোপ। এটি একটি বহুমুখী আঞ্চলিক একক যা বিশেষীকরণের মাধ্যমে যথা সম্ভব সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়। এরূপ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত অঞ্চল ও একটি পশ্চাদপদ অঞ্চল মিলিয়ে একটি দ্বিতীয় রুমের অঞ্চল গঠিত হতে পারে। উদ্দেশ্য, পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিনিময় মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়ন।
তৃতীয় ক্রম বা ক্ষুদ্র বা মাইক্রো (Micro) অঞ্চল (Third order region): ক্ষুদ্রতম এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক উপকরণগুলি একই প্রকার এবং অঞ্চলের অধিবাসীদের উন্নয়নের উদ্দেশ্য এক এবং স্থানীয় বিশেষত গ্রামাঞ্চলের এবং পৌর এলাকা ধরে উন্নয়ন এই রুমের উদ্দেশ্য।
আঞ্চলিক ক্রমের ক্ষুদ্রতম এই একক পরিকল্পনার সর্বনিম্ন স্তরে থাকে। এটি একটি জেলা বা একটি ব্লক বা তহশিল অথবা তহশিলের একটি ক্ষুদ্রতর অংশ নিয়ে গঠিত হতে পারে। ক্ষুদ্রতর অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পদ সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই ক্রমপর্যায়ের উদ্দেশ্য। কোনো পৌরাঞ্চলের অথবা কোনো গ্রামীণ ব্লকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা বা সমস্যাদি দূরীকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তরে আঞ্চলিক উন্নয়ন ঘটানো এই প্রকল্পের লক্ষ্য। অর্থাৎ তৃণমূল স্তরে উন্নয়ন, পৌঁছে দেওয়া পরিকল্পনা অঞ্চলের উদ্দেশ্য।
উদাহরণ:
ম্যাক্রো বা প্রথম ক্রমের অঞ্চল দক্ষিণ উপদ্বীপীয় অঞ্চল (কেরালা ও তামিলনাড়ু অঞ্চল)। সম্পদ উন্নয়নের তালিকায় রয়েছে উপকূলীয় মৎস্য সংগ্রহ, আঞ্চলিক অরণ্য, জলসম্পদ, শক্তিসম্পদ ও কৃষির উন্নয়ন।
মেসো বা দ্বিতীয় ক্রমে উক্ত অঞ্চলটি বিভক্ত হয়েছে (ক) কেরালা যার সম্পদ উন্নয়নের তালিকাভুক্ত বাগিচা, মৎস্য, বনজ, কাষ্ঠ, নারকেল, জলবিদ্যুৎ ও থোরিয়াম সংগ্রহ এবং জাহাজ নির্মাণ, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি শিল্পোন্নয়ন।
(খ) চেন্নাই-কোয়াম্বাটুর শিল্পাঞ্চল সম্পদ সম্ভাবনার তালিকায় রয়েছে লিগনাইট, লৌহ আকরিক প্রভৃতি খনিজ সংগ্রহ, আখ, নারকেল, কার্পাস প্রভৃতি অর্থকরী ফসল, বস্ত্রশিল্প, চিনি শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ধাতব শিল্পের উন্নয়ন।
(গ) তামিলনাড়ু উপকূলীয় অঞ্চল সম্পদ সম্ভাবনার তালিকায় রয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য সংগ্রহ, লবণ সংগ্রহ, ধান, কার্পাস, মিলেট প্রভৃতি চাষ। ব-দ্বীপ অঞ্চলের কৃষি ও শিল্প সম্ভাবনা, পর্যটন প্রভৃতির মাধ্যমে উন্নয়ন।
মাইক্রো বা তৃতীয় ক্রমে রয়েছে উক্ত দ্বিতীয় ক্রমের অঞ্চলভুক্ত জেলা বা তা অপেক্ষাও ক্ষুদ্রতর অশ্বল যেমন তহশিল বা ব্লক পর্যায়ে সম্পদ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য উপবিভাগসমূহ।