ভারতীয় উপমহাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন (Advance and Retreat of the South-west Monsoon)
জুন মাসের শেষদিকে সূর্য আপাতগতিতে কর্কটক্রান্তি রেখার উপর অবস্থান করায় উত্তর-পশ্চিম ভারতে উত্তাপের পরিমাণ খুব বৃদ্ধি পায়। উত্তাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাব অঞ্চলের মৃদু নিম্নচাপ বলয়টি অত্যন্ত শক্তিশালী হতে থাকে এবং নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় অপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে পড়ে। এই সময় দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকাল থাকায় মকরক্রান্তি রেখার উপরে উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপ বলয় থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আয়নবায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে অধিকতর শক্তিশালী নিম্নচাপ বলয়ের আকর্ষণে সরাসরি এই অঞ্চলের দিকে ছুটে আসে। নিরক্ষরেখা অতিক্রম করার ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ুতে পরিণত হয়। তবে অপর একটি ধারণা অনুসারে দক্ষিণ-জুলাই ১ জুন ১৫ মুম্বাপর এই দক্ষিণ -পূর্ব আয়নবায় জুলাই ১৫সেপ্টেম্বর ১জুন ১০পুনে পূর্ব আয়নবায়ু নয় নিরক্ষীয় পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ (The Equatorial Westerlies) মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণ। উত্তর গোলার্ধে মহাদেশসমূহ গ্রীষ্মকালে যখন খুব উদ্বু হয়ে পড়ে।
তখন নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়টি উত্তরে অগ্রসর হয় (Shifting of the low pressure belt)। ITCZ কিছুটা উত্তরে সরে যায় এবং ২০-২৫° উত্তরে সরে গিয়ে সিন্ধু গাঙ্গেয় সমভূমির উপরে অবস্থান করে। এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রটিকে মনসুন ট্রাফ (Monsoon Trough) বলে। এই সময় দুই গোলার্ধে বাণিজ্য বায়ুর মধ্যবর্তী অংশে একটি সাধারণভাবে পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। জলভাগের উপর দিয়ে প্রবাহকালে এই বায়ুপ্রবাহ প্রচুর জলায়বাষ্প বহন করে নিয়ে আসে বলে এটি আর্দ্র হয় এবং মনসুন ট্রাফ-এর শক্তিশালি আকর্ষনে এর দিকে অগ্রসর হয় এবং অগ্রসরকালে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু একটি নির্দিষ্ট সময় বা ঋতুতে আসে বলে একে মৌসুমী বায়ু এবং দক্ষিম -পশ্চিম দিক থেকে আসে বলে একে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বলে। আরবি 'মৌসম' কথার অর্থ ঋতু থেকে মৌসুমী শব্দটি এসেছে। যে মুহূর্তে মৌসুমী বাপ্রবাহ ভারতে এসে পৌঁছায়, পশ্চিমঘাট পর্বতে বাঁধা পেয়ে উর্ধ্বে উঠে মেঘের ঘনঘটাসহ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই ঘটনাটিকে ইংরেজিতে Burst of the Monsoon বা 'মৌসুমী বিস্ফোরণ' বলে। প্রথম মৌসুমী বায়ুপ্রবাহটি কেরলের মালাবার উপকূলে জুন মাসের প্রথমে এসে পৌঁছায়। পশ্চিমবঙ্গে এই বায়ুপ্রবাহ জুন মাসের মাঝামাঝি এসে পৌঁছায়। জুন মাসের শেষে এই বায়ুপ্রবাহ ক্রমশ মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অসম, বিহার ও উত্ত রপ্রদেশের মধ্য দিয়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পাঞ্জাব ও রাজস্থানে গিয়ে পৌঁছায়।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দুটি শাখা-
(১) আরব সাগরীয় শাখা (The Arabian sea branch): মৌসুমী বায়ুর যে শাখা আরব সাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় প্রতিহত হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে বৃষ্টি ঘটায় তাকে মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা বলে। প্রচুর জলীয়বাষ্প বয়ে নিয়ে আসে বলে পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে এই বায়ুপ্রবাহ প্রায় ২০০-৩০০ সেমি বৃষ্টি হয়। তবে পশ্চিমঘাট পর্বত অতিক্রম করার পর বায়ুতে জলীয়বাষ্প খুব কমে যায় বলে এবং বায়ু অবনমনকালে চাপ বৃদ্ধিতে সংকুচিত হয়ে উন্ন হলে বৃষ্টির পরিমাণ খুব কমে যায় এবং একটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল সৃষ্টি হয়। এজন্য পশ্চিমে ম্যাঙ্গালোরে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫৪ সেমি বৃষ্টিপাত হয়, পর্বতের অপর পার্শ্বে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের বেলিয়াতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কেবল ৯৫ সেমি। তবে পালঘাটের সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে আর্দ্র বায়ুর কিছু অংশ প্রবেশ করলে মালভূমি অঞ্চলের অভ্যন্তরেও কিছু বৃষ্টি সংঘটিত হয়। এই বায়ুর একাংশ যখন নর্মদা ও তাপ্তী উপত্যকার মধ্য দিয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালায় প্রতিহত হয় সেখানে মাঝারি রকমের বৃষ্টিপাত ঘটায়। আরব সাগর থেকে প্রবাহিত মৌসুমী বায়ুর অপর একটি শাখা গুজরাটের কচ্ছ ও কাঁথিয়াবাড়ে এবং রাজস্থানের মরু অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহকালে উচ্চ পর্বতের বাধা না পাওয়ায় বৃষ্টি প্রায় ঘটাতে পারে না। এজন্য রাজস্থানে থর মরুভূমি বা মরুস্থলির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর একাংশ আরাবল্লী পর্বতে বাধা পেলে পর্বতের পূর্বদিকে স্বল্প বৃষ্টিপাত (প্রায় ১০০ সেমি) ঘটায়। এই বায়ু আরও উত্তর-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে প্রবাহিত বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী বায়ুর শাখার সঙ্গে মিলিত হয়ে পাঞ্জাব ও রাজস্থানের পূর্বাংশে এবং পশ্চিম হিমালয়ে হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি ঘটায়।
(২) বঙ্গোপসাগরীয় শাখা (The Bay of Bengal Branch): মৌসুমী বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে পূর্বদিকে সোজা মায়ানমারের আরাকান উপকূলে প্রতিহত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিদান করে। এই বায়ু পরে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে নিম্ন গাঙ্গোয় সমভূমিতে প্রবেশ করে।
বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী বায়ুর অপর একটি শাখা বঙ্গদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অসমের খাসিয়া পাহাড়ে ও পূর্ব হিমালয়ে বাধা পেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। জলীয়বাষ্পপূর্ণ এই বায়ু প্রথমেই খাসিয়া পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হঠাৎ প্রায় ১২০০ মিটার উপরে উঠে যায় এবং শীতল হয়ে ঘনীভূত হয় ও প্রচুর বৃষ্টিদান করে। এজন্য খাসিয়া পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির কাছে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। কিন্তু চেরাপুঞ্জির বিপরীতদিকে শিলং শহরে যখন এই বায়ু প্রবেশ করে তখন জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে যায় বলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও হ্রাস পায়। চেরাপুঞ্জির কাছে মৌসিমরাম গ্রামে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২৫০ সেমি, সেখানে শিলং শহরে বৃষ্টির। পরিমাণ মাত্র ২০০ সেমি।
মৌসুমী বায়ুর এই শাখাটি সুউচ্চ হিমালয় পর্বত অতিক্রম করতে না পেরে দুটি অংশে বিভক্ত হয়। একটি অংশ পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টি ঘটায়, অপর অংশটি পশ্চিমদিকে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলে বৃষ্টিদান করতে করতে ক্রমশ পশ্চিমে অগ্রসর হয়। তবে পশ্চিমে অগ্রসরকালে বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমতে থাকে বলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায় যেমন কলকাতায় ১৫০ সেমি বৃষ্টি হলেও পাটনায় তা ১১২.৫ সেমি, এলাহাবাদে ১০৫.৭ সেমি এবং দিল্লীতে ৬৭.৫ সেমি হয়ে থাকে। অনুরূপ ভাবে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে ক্রমশ কমতে থাকে। দার্জিলিং-এ যেখানের বৃষ্টির পরিমাণ বছরে ৩০৫ সেমি, কলকাতায় তা মাত্র ১৫০ সেমি।
ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমী বায়ুর এত অধিক প্রাধান্য যে ভারতকে মৌসুমী জলবায়ুর দেশ (Land of the Monsoon) বলা হয়। ভারতে সমগ্র বৃষ্টিপাতের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর অবদান। এই বায়ুর সময়মত আগমন ও প্রত্যাগমনের উপর দেশের কৃষিকার্যের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে। এই বায়ুর নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে বা পরে আগমন অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা এবং কৃষিকার্যের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে প্রভাবিত করে।
▲ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাগমন (Retreat of the South-west Monsoon):
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় ও বঙ্গোপসাগরীয় উভয় শাখাই অক্টোবর মাস থেকে উত্তর ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন করতে থাকে। সূর্য এই সময় নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণায়নে মকরক্রান্তিরেখা অভিমুখী হয়। ভারতে এই কারণে উন্নতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। উত্তর পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চল ক্রমশ শীতল থেকে শীতলতর হলে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপের বায়ু প্রবাহকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ভারতে শীতের তীব্রতা যতই বাড়তে থাকে পাঞ্জাব অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয়ের শক্তি ততই বাড়তে থাকে। এই উচ্চচাপের শক্তিশালী বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুকে ক্রমশ ঠেলে পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য করে। ফলে আরব সাগরীয় শাখা রাজস্থান, গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যের উপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বঙ্গোপসাগরীয় শাখা গল্যা সমভূমির উপর দিয়ে প্রথমে পূর্বদিকে এবং পরে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পশ্চাদ পসরণ।
করতে থাকে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়। উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে নির্গত বায়ুর সাথে দক্ষিণ পশ্চিম বায়ুর সংঘর্ষে যে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় তাকে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে 'আশ্বিনের ঝড়' বলে। এই ঘূর্ণিঝড় ভারতের পূর্ব উপকূল বরাবর এসে তামিলনাড়ু উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এজন্য তামিলনাড়ু উপকূলে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তি (Mechanism of Monsoon): ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বৎসর মৌসুমী বায়ু আবির্ভূত হয়। এই সকল দেশের আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রায় এই বায়ুপ্রবাহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর উদ্ভব সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোন তত্ত্ব কিছুদিন পূর্বেও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বিভিন্ন সময়ের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন কারণ নির্দেশ করেছে।
(i) সাধারণ ধারণা (General Views): স্থলভাগ ও জলভাগের মধ্যে তাপগ্রাহিতার তারতম্যের কারণেই এই বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। স্থলবায়ু ও সমুদ্রবায়ুর ব্যাপক সংস্করণকেই মৌসুমী বায়ু বলে মনে করা হয়।
গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চল অধিক উত্তপ্ত হয় এবং দক্ষিণে মকরক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্য তির্যকভাবে পতিত হওয়ায় উত্তাপ কম পায় ও উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপের বায়ু নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের আকর্ষণে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে ফেরেলের সূত্র অনুসারে ডানদিকে বেঁকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। প্রবাহকালে উত্তরোত্তর উষু হবার ফলে এই বায়ুর জলধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং বিস্তীর্ণ সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বহন করে আনে।
(ii) জেফ্রিস-এর তত্ত্ব (Jefferys Theory): বায়ুর নিম্নস্তরে জলভাগ থেকে স্থলভাগে বায়ুপ্রবাহের কারণ হিসাবে ঊর্ধ্বস্তরে স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুর প্রবাহকে নির্দেশ করা হয়েছে। প্রায় ছয় দশকেরও পূর্বে জেফ্রিস গাণিতিক প্রমাণের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে, ২.১ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে বায়ু সমুদ্রপৃষ্ঠের বায়ুপ্রবাহের বিপরীতে প্রবাহিত হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে বিপরীত বায়ুপ্রবাহ আরও অনেক ঊর্ধ্বে লক্ষ করা যায়। নিম্নস্তরে বায়ু যখন পশ্চিমদিক থেকে আকৃষ্ট হয় তখন বায়ুচাপ ও উয়তার তারতম্যে উর্ধ্ব ও নিম্ন বায়ুপ্রবাহের বৈপরীত্য মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণ হিসাবে একসময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি বলে উপস্থাপিত হয়।
(iii) রেডন-ধারণ তত্ত্ব (Radon Content Theory): এই তত্ত্বে তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে। ভূমি থেকে প্রতিনিয়ত ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম বিকিরত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশছে। স্থলভাগ থেকে এই বিকিরণের মাত্রা অধিক। বায়ুস্তরে উচ্চ-রেডন (Radon) মাত্রা এর স্থলভাগে উৎপত্তি এবং নিম্ন-রেডন মাত্রা এর জলভাগে উৎপত্তিকে নির্দেশ করে। এই প্রসঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েত গবেষণা জাহাজ Yu. M. Shokalski কর্তৃক বায়ুস্তর গবেষণা ও নিরীক্ষণ বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করে। এই গবেষণা জাহাজটি ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালায়। এই গবেষণায় স্থলভাগের নিকটবর্তিতার জন্য লোহিত সাগরে (Red Sea) উচ্চ-রেডন মাত্রা লক্ষ্য করা হয়। জাহাজটি যখন ভারত মহাসাগরে, বিশেষতঃ নিরক্ষরেখার উপর দিয়ে গমন করে তখন এতে রেডন মাত্রার ক্রমহ্রাস লক্ষিত হয়। একদল গবেষকের মতে, রেডন মাত্রার এই তারতম্যই মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণ। এই বায়ুপ্রবাহের সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদল আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু এর বিপক্ষে বলা হয় যে, মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তি উক্ত অঞ্চলে হলে এত স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রবাহপথে এত অধিক জলীয় বাষ্প এই বায়ুপ্রবাহ সংগ্রহ করতে পারত না।
(iv) থার্মাল ইঞ্জিন তত্ত্ব (Thermal Engine Theory): এতে মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তির কারণ হিসাবে তিব্বতের উচ্চ-মালভূমির তাপীয় প্রভাবকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই মালভূমি পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অপেক্ষা ২০-৩" সেন্টিগ্রেড উদ্বুতর। Dr. P. Koteswaram এবং Prof. H. Flohn বলেন, যেহেতু তিব্বত মালভূ মি বায়ুমণ্ডলে তাপের একটি উৎস, তাই এই বায়ুকে ঊর্ধ্বে উঠতে প্রভাবিত করে। উর্ধ্বগমনকালে বায়ু দক্ষিণ মুখে প্রসারিত হয় এবং ক্রমশঃ ভারত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর নিমজ্জন ঘটে। এই সময় নিম্নগামী বায়ু পৃথিবীর আবর্তনের কারণে দক্ষিণে বিক্ষিপ্ত হয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রত্যাগমনশীল বায়ু (Return Current) -রূপে ভারতে প্রবেশ করে। ভারত মহাসাগরে এর উত্তরাভিমুখে গমনকালে এই বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে নেয়। এই যুক্তি সম্পর্কে যে দুটি মুখ্য প্রশ্ন তোলা হয়, সেই দুটি হল- (১) ভারতীয় মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ কি তপ্ত উৎসস্থল দ্বারাই পরিচালিত হয়? এবং (২) ভারত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলে কি বায়ুর নিম্নগমন লক্ষ্য করা যায়?
(v) মৌসুমী মেঘ সংবহন তত্ত্ব (Monsoon Cloud Trajectory Theory): উপপ এহ কর্তৃক প্রেরিত মেঘের আলোকচিত্রের সাহায্যে বর্তমানে আমরা আমাদের দেশকে বেষ্টন করে থাকা সমুদ্রের উপরে ঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে অনুরূপ ঝড়ের লক্ষণ সূচিত হলেও উপগ্রহ মাধ্যমে তা ধরা পড়ে। উপগ্রহ কর্তৃক প্রেরিত মেঘের আলোকচিত্র প্রমাণ করে যে, মৌসুমী বায়ু যখন ভারতের দিকে অগ্রসর হয়, তখন এটি আরব সাগর ও এডেন উপসাগর থেকে আগত অন্য একটি পশ্চিমা বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়। এটি সম্ভব হতে পারে যে, এ পর্যন্ত যে রেডনের পরিমাপ করা গিয়েছে তা প্রকৃত মৌসুমী বায়ুর কারণ না হায়ে আরবে উৎপন্ন পশ্চিমা বায়ুর প্রতিনিধিত্ব করে।
▲ মৌসুমী বায়ুর প্রবাহে জেট বায়ুস্রোতের প্রভাব (Influence of Jet Stream on Monsoon): ভারতের উপর উপক্রান্তীয় (পশ্চিমী) জেট এবং ক্রান্তীয় (পূবালী) জেট উভয় বায়ুপ্রবাহই লক্ষ্য করা যায়। তবে ক্রান্তীয় বায়ুপ্রবাহ অপেক্ষা উপ ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ বিস্তৃততর অঞ্চল অধিকার করে থাকে।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রবাহকালে উপ-ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি ধরা না গেলেও শীতকালে এটি ভারতের জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ ভারতীয় উপদ্বীপের উপর জুন মাসে আবির্ভূত হয় এবং আগষ্ট মাসের শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থাকে। যখন উপ-ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ বিশাল হিমালয় পর্বতের সুউচ্চ শিখরশ্রেণীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন এটি কখনো কখনো দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। একটি শাখা হিমালয় পর্বতের উত্তরে এবং অন্যটি দক্ষিণ অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে দুটি জেট বায়ুপ্রবাহ কখনো কখনো চীনের উপরে একত্রিত হয়। মিলিত জেট বায়ুপ্রবাহের গতি বিভক্ত জেট বায়ুপ্রবাহ অপেক্ষা প্রায়শই অধিক হয়।
ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর উপরে দেখা যায় এবং উপক্রান্তীয় উচ্চচাপের শীর্ষদেশ থেকে দক্ষিণে অবস্থান করে। চীনের দক্ষিণ উপকূল থেকে আরম্ভ করে এই পূবালী বায়ুস্রোত ১৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ বরাবর থাইল্যান্ড, দক্ষিণে অবস্থিত ভারত উপদ্বীপ অতিক্রম করে অবশেষে সুদান ও সাহারায় গিয়ে ক্ষিয়মান হয়। পূবালী জেট বায়ুস্রোত মালয়েশিয়া থেকে ভারতীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত তীব্রতর হয় (সর্বাধিক গতি ঘন্টায় ১০০-২০০ কিলোমিটার) এবং পরে পশ্চিমদিকে তীব্রতা ক্রমশঃ কমে আসে। উপক্রান্তীয় জেট বায়ুস্রোত ভারতীয় উপমহাদেশে অক্টোবর মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রত্যাবর্তনের পর আবির্ভূত হয় এবং দক্ষিণ দিকে শীতের আগমনে ক্রমশঃ স্থানান্তরিত হয়। ফেব্রুয়ারী-মার্চে এই জেট বায়ুস্রোত এর দক্ষিণতম অবস্থানে আসে। এরপর এটি উত্তর দিকে পুনরায় ফিরে যায়। মে মাসের শেষাশেষি এই বায়ুস্রোত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে অপসৃত হয়।
দক্ষিণের উপদ্বীপে একটি ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ জুন মাস থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। জুলাই -আগষ্টে এটি ১২-১৫° উত্তরে অবস্থান করে। সেপ্টেম্বর মাসে এটি ভারত থেকে অপসৃত হয়।
জেট বায়ুপ্রবাহ নিয়ত বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত এবং অবস্থানের নিবিড়তার পরিবর্তন ঋতু-পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
ভারতীয় অঞ্চলে উপ-ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহ অদৃশ্য হবার ঘটনাটি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর আগমনের সঙ্গে অংশতঃ মিলে যায়। ক্রান্তীয় জেট বায়ুপ্রবাহের ক্ষেত্রে মৌসুমী বায়ুর ছেদ (Break in the monsoon) অনেক ক্ষেত্রেই এই জেট বায়ুপ্রবাহের স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি উত্তরে অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত দেখা যায়। জেট বায়ুপ্রবাহের প্রবল গতিবেগের ঢাল বায়ুপ্রবাহের মিলন ও অধোগমনের সূত্রপাত ঘটায়। এইভাবে ধূলিঝড়, ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপের সৃষ্টি, এগুলির তীব্রতা বৃদ্ধি এবং পরে তীব্রতা হ্রাস প্রভৃতির উপর এই জেট বায়ুপ্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের জন্য যে বিপুল জলীয় বাষ্পের প্রয়োজন হয়, তা মূলত দক্ষিণে ভারত মহাসাগর থেকে উত্থিত হয়। নিরক্ষীয় প্রদেশের আড়াআড়ি প্রসারিত নিম্ন অবস্থানে থাকা জেট প্রবাহ কর্তৃক পরিচলন তাপীয় উৎস (Convective Heat Source)-এর দিকে উক্ত জলীয় বাষ্পের সরবরাহ ঘটে। পূবালী জেট-এর কেরালা উপকূলের উপর অবস্থান, অনেক আবহবিদ-এর মতে কেরালা উপকূলে মৌসুমী বায়ুর আবির্ভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্রিটিশ আবহবিদ ফাইন্ডলেটার (Findlater J., 1969) পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে একটি শক্তিশালী সংকীর্ণ বায়ুস্রোত লক্ষ করেছিলেন। এটি পূর্ব আফ্রিকা হয়ে আরব সাগরের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জুন মাসে ভারতে প্রবেশ করে। আরব সাগরীয় উপকূল অঞ্চলে এই সময় সমুদ্রে জলস্ফিতি লক্ষ করা যায়। একই সঙ্গে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংযোগের ঘটনাটি ঘটে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহে এই সময় উল্লেখনীয় শক্তি সঞ্চার হয়। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের বৃষ্টিপাতের তীব্রতার সঙ্গে উর্ধাকাশে পূবালী জেট বায়ু প্রবাহের উপস্থিতি যুক্ত বলে অনেক আবহবিদ মনে করেন। পরিসংখ্যান থেকে লক্ষ করা গেছে পূবালী জেট ভারত মহাসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প আরব সাগরে প্রেরণ করে। জেট বায়ু প্রবাহ কেরালার আকাশে অবস্থানের সঙ্গে শক্তিশালী মৌসুমী বায়ু আবির্ভাবের ঘটনাটি জড়িত অনেক আবহাওয়াবিদই মনে করেন।
মৌসুমী বর্ষনের নিবিড়তা ও ছেদ (Intensity and Break of Monsoon): জেট বায়ুস্রোতের গুরুত্ব এই যে ৯ ডিগ্রী উত্তর বরাবর এর পথ পরিক্রমাকালে আরো লক্ষ করা গেছে জেট বায়ুস্রোতের নিবিড়তা বেশি হয় যখন, মৌসুমী বর্ষনও বেশি হয়। এই নিবিড়তা হ্রাসের সঙ্গে মৌসুমী বর্ষনের ছেদ-এর সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও জেট বায়ুর নিবড়তার বহুবর্ষভিত্তিক লব্ধ পরিসংখ্যান-এর বিশ্লেষণ জেট বায়ু প্রবাহের সঙ্গে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের উক্ত সম্পর্ককে প্রমান করে।
▲ উপগ্রহ দ্বারা মৌসুমী গবেষণা বা MONEX (Monsoon Experiment): এটি মৌসুমী গবেষণা সংক্রান্ত একটি কর্মসূচী। বিশ্ব বায়ুমণ্ডল গবেষণা প্রকল্পের (Global Atmospheric Research Programme) অধীনে মৌসুমী বায়ু গবেষণার একটি বিশেষ কার্যক্রম স্থির হয়, যা মৌসুমী গবেষণা বা মোনেক্স নামে পরিচিত। এই কর্মসূচীতে একটি মার্কিন ভূ-সমীক্ষণ উপগ্রহ-GOES INDIAN OCEAN নিরক্ষরেখার ৬০° পূর্ব দ্রাঘিমার অবস্থানে থেকে মোনেক্স অঞ্চলের বায়ুমণ্ডল সমীক্ষা করতে থাকবে। GOES মেঘমণ্ডলের অবস্থান নিরীক্ষণ করে ইউরোপীয় গ্রাহক কেন্দ্রে তথ্য প্রেরণ করবে। বাংলাদেশের ঢাকায় জাপান কর্তৃক উৎক্ষিপ্ত ও সমীক্ষণ কার্যের দ্বারা ভারতীয় আবহবিদগণ বায়ুমণ্ডল এবং মৌসুমী বায়ু-সংক্রান্ত গবেষণার বিশেষ সুযোগ লাভ করেছেন। কিছুকাল পূর্বেও মৌসুমী বায়ুর উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ ছিল। বহু সমীক্ষা ভিন্নমত গঠনে উৎসাহিত করে। দিয়াগো গার্সিয়া ও সিচেলিস থেকে ফ্রান্স কর্তৃক গবেষণার জন্য বেলুন উৎক্ষেপণের পর দেখা গিয়েছে যে, এই বেলুনগুলি মৌসুমী বায়ু-তাড়িত হয়ে ভারতীয় উপকূল অভিমুখে যাত্রা করে এবং এমনকি এদের কোনটি মায়ানমারেও গিয়ে পৌঁছায়। বায়ুচাপের ডাল, পৃথিবীর আবর্তন এবং ভূ-পৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত গতি নিয়ন্ত্রণ বায়ুপ্রবাহের পথ নির্দেশ করে দেয়। MONEX কর্মসূচীর পূর্বে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেখানে কোরিওলিস শক্তি সামান্যই, সেই স্থানের বায়ু-পরিক্রমা বিষয়ে বিশদ কিছু জানা সম্ভব হয় নি।
১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দে মৌসুমী বায়ুর প্রারম্ভে এবং এর প্রাক্কালে এই বেলুন প্রেরণ পরীক্ষা করা হয়েছিল।মৌসুমীর সূত্রপাতের পূর্বে সিচেলিস ও দিয়াগো গার্সিয়া থেকে প্রেরিত বেলুন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে পৌঁছায়। বেলুনগুলির একটি উত্তরদিকে আরবের উপকূল অভিমুখেও উড়ে যায়। কোনটি মায়ানমার উপকূ লে গিয়ে পৌঁছায়। এটি প্রমাণ করে যে, বিশেষ কারণেই বেলুনগুলি মোটামুটি নির্দিষ্ট পথে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে উত্তর গোলার্ধের গন্তব্যস্থলে উড়ে যায়, যা আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের অদূরে একটি তীর আড়াআড়ি প্রবাহ সৃষ্টি করে। মৌসুমী বায়ুর আগমনের সময়ই আরব সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে একটি বাত্যা-আবর্তের (Vortex) সৃষ্টি গবেষকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে। গণনা করে দেখা গেছে, এই বাত্যা-আবর্ত সৃষ্টির ফলে বায়ুমণ্ডলের গতি-সঞ্চারক শক্তির (Kinetic Energy) বৃদ্ধি ঘটে। এই বাত্যা-আবর্তের অবস্থান ১৯৭৯-তে মৌসুমী বায়ু প্রবাহকালে ১৪ই জুন প্রথম নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু এই বাত্যা- আবর্ত পরবর্তী কয়েকটি সমীক্ষায় চিহ্নিত করা যায় নি বলে মৌসুমী বায়ু আগমনের পক্ষে এটি কতখানি অপরিহার্য তা বলা যায় না। তবে এই সমীক্ষাগুলিতে গতি-সঞ্চারক শক্তির (Kinetic Energy) বৃদ্ধি যথেষ্টই লক্ষ্য করা যায়।
▲ মৌসুমীবায়ুপ্রবাহে এল নিনো (El Nino)-র প্রভাব: এল নিনোর ঘটনাটি হ'ল এই সময় দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে পূর্ব পশ্চিমে বায়ুপ্রবাহ ঘটে। এটি সমুদ্রের উপরিস্থিত জলকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু উপকূলের দিকে ঠেলে দেয়। উদ্বু সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে এই অঞ্চলে বায়ু উচু হয়ে বায়ু উত্থান ঘটে তার ফলে বায়ু নিম্নচাপ হয়। এই ঘটনায় বায়ুমন্ডলীয় প্রবাহে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুতি ঘটে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের আধিক্য ঘটে। বিপরীতভাবে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পায়। কোনো কোনো এল নিনো বছরে ভারতে মৌসুমী বৃষ্টিপাত এত কমে যায় যে বিস্তির্ণ অঞ্চলে (বিশেষত পশ্চিম ভারতে) প্রায় খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পেরু উপকূলে সমুদ্র জলের উয়তা স্বাভাবিক-এর থেকে ০.৫ ডিগ্রী বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এল নিনো ঘটনা যুক্ত বলা হয়। অর্থাৎ উন্নতার স্বাভাবিকের থেকে ধনাত্বক বিচ্যুতি ০.৫ (+০.৫) হলে পেরু-ইকুয়েডর উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। সমুদ্র জলের উষ্ণতা স্বাভাবিক বা ঋনাত্বক হলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পায়। তখন পশ্চিম প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়।
ভারতে এল নিনোর ব্যাপক প্রভাব আবহবিদগণ লক্ষ্য করেছেন। এই প্রভাবকে 'টেলি কানেকশন' (Teleconnection)-ও আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেহেতু সুদুর পেরু-ইকুয়েডর অঞ্চলে উষু সমুদ্র স্রোতের প্রভাবে ঘটা এল নিনো ঘটনা ভারতে মৌসুমী বায়ুর উপর প্রভাব ফেলে।
ভারতে আর্দ্র মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারণ নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের আড়াআড়ি বায়ুচাপের ঢাল যা স্থল ও জলের উদ্ভতার পার্থক্যের কারণে ঘটে। এটি পৃথিবীর আবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সমুদ্র, বায়ুমন্ডল ও স্থলভাগের মধ্যে জলীয় বাষ্পের বিনিময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জুন-সেপ্টেম্বর মাসে নিরক্ষীয় চাপবলয়ে আড়াআড়ি বা প্রস্থ বরাবর সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্পের উত্থান ঘটে এবং দঃ পঃ মৌসুমী বায়ুতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু এল নিনো বছরে ভারত মহাসাগর ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উদ্বু জল পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে পেরুর দিকে সরে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে। পেরু উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উদ্বুতায় বা SST (Sea Surface Temperature) প্রায় ০.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ধনাত্মক উয়তার বৈষম্য (Positive Temperature Anomaly) পেরু উপকূলে বৃষ্টি বৃদ্ধি করে কিন্তু ভারতে দঃ পঃ মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে জলীয় বাষ্পের পরিমান কমে যাওয়ায় এবং কোনো কোনো এল নিনো বছরে খরা পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়।
এল নিনো বছরে প্রশান্ত মহাসাগরে উন্নতার বৈষম্য হওয়ায় ওয়াকার সার্কুলেশনে পরিবর্তন ঘটে। এল নিনো ঘটনাকালে পূর্ব প্রশান্ত সমুদ্রে উদ্বুতর আবহাওয়ায় বায়ুর উত্থানে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পশ্চিম প্রশান্ত সহ ভারত মহাসাগরে এর বিপরীত অবস্থা অর্থাৎ জলের উদ্ধৃতা হ্রাস পাওয়ায় বায়ুর অবনমন ঘটে বৃষ্টিপাত হ্রাস পায়। এল নিনো বছরগুলিতে মৌসুমী বায়ুতে ছেদ (Break of Monsoon) এর সংখ্যা ও ছেদ সময়কালের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমান হ্রাস পায়।
এল নিনো ও লা নিনাঃ এল নিনো ঘটনা একটি দুর্বল মৌসুমী বায়ু এবং লা নিনা ঘটনা একটি শক্তিশালী মৌসুমী বায়ুর সূচনা করে। এল নিনোর অনুপস্থিত বছরগুলিতে মৌসুমীবায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং বৃষ্টিপাতও স্বাভাবিক পরিমানে হয়।
লানিনার বছরে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র জলে উয়তা ঋনাত্বক বৈষম্য ঘটে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে এর বিপরীত ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ সমুদ্র জলের উদ্বুতার ধনাত্বক বৈষম্য ঘটে। এর ফলে নিরক্ষীয় চাপ বলয়ের আড়াআড়ি বা প্রস্থ বরাবর মৌসুমী বায়ু প্রবাহের অতিক্রম কালে উদ্বুতর সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে এবং ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে প্রচুর বা স্বাভাবিকের থেকে বেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়। মৌসুমীবায়ু প্রবাহের ছেদ (Break of Monsoon)-এর সংখ্যা এবং ছেদ-এর দৈঘ্যও হ্রাস পায় লা নিনা বছরগুলিতে।
এল নিনো কালপঞ্জীঃ এল নিনো অবস্থা ডিসেম্বর মাসে বড় দিনের সময় ঘটে এবং ৭ মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত টিকে যেতে পারে। ২ থেকে ৭ বৎসরের ব্যবধানে এল নিনোর আগমন ঘটে। সাম্প্রতিক অতীতে এল নিনো ঘটনাগুলি ছিল ১৯৭২-৭৩, ১৯৮২-৮৩, ১৯৯৭-৯৮, ২০১৪-১৬, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ বছরগুলিতে।
ভারতে মৌসুমী বৃষ্টিপাত অঞ্চল:
মৌসুমী বৃষ্টিপাতের তারতম্যে ভারতকে কয়েকটি বৃষ্টিপাত অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা-
ক. অতিবর্ষন অঞ্চল (২৫০ সেমি-এর উর্ধে): এই অঞ্চলের অন্তর্গত হল পশ্চিম উপকূলের উত্তরাংশ, অসম, পূর্ব হিমালয় ও তরাই, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল ও উত্তর বিহার।
খ. মধ্যম বর্ষন অঞ্চল (১০০-২৫০ সেমি): উত্তর বিহার, পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশ, পশ্চিম উপকূ লের বাকি অংশ, উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ ও ওড়িষা এই অঞ্চলভুক্ত।
গ. স্বল্প বর্ষন অঞ্চল (৫০-১০০ সেমি): পূর্ব পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশ, পূর্ব রাজস্থান ও দাক্ষিনাত্যের মালভূমির মধ্যভাগে (অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক) স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়।
ঘ. অত্যল্প বর্ষন অঞ্চল (৫০ সেমি-এর কম): অতি অল্প বৃষ্টি হয় পশ্চিম রাজস্থান ও কাশ্মীরের উত্তর পশ্চিমাংশে।
ভারতের জলবায়ু অঞ্চল (Climatic Region of India)
▲ ভারতের জলবায়ুর বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। স্ট্যাম্প (Dr.L.D. Stamp), থর্নওয়েট (Dr. Thornthwaite), কেণ্ডু (Kendrew), কোপেন (Koppen) প্রমুখ আবহবিদগণ এই শ্রেণিবিভাগ করেছেন। বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ বিশ্লেষণ করে এবং উন্নতা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যকে লক্ষ্য করে ভারতীয় আবহবিদগণ ভারতের জলবায়ুকে মোট ৮টি জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন।
ভারতের জলবায়ুর শ্রেণীবিভাগঃ
[১] উত্তর-পূর্ব ভারতের অতিবৃষ্টি অঞ্চল (পূর্বাঞ্চল): অসম উপত্যকা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম,মণিপুর ও ত্রিপুরা এর অন্তর্গত। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এখানে ২০০ সেমি-এর বেশি। জানুয়ারী মাসের উদ্ভুতা ৫"-১৮" সেন্টিগ্রেড। (প্রধান উৎপন্ন ফসল- চা, ধান ও পাট]।
[৩] উত্তর-পশ্চিম ভারতের মাঝারি বৃষ্টিপাত অঞ্চল: হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশ এর অন্তর্গত। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬০-১০০ সেমি এবং জানুয়ারী মাসের উদ্বুতা ১৩০-১৮০ সেন্টিগ্রেড। [উৎপন্ন প্রধান ফসল- গম, ধান, ভুট্টা, যব ও আখ]।
[৪] পশ্চিম ভারতের প্রায় বৃষ্টিহীন শুদ্ধ মরু-অঞ্চল: রাজস্থান, কচ্ছ ও কাথিয়াওয়াড় উপদ্বীপ এই শুদ্ধ অঞ্চলের অন্তর্গত। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬০ সেন্টিমিটার থেকে পশ্চিমদিকে ক্রমশঃ কমে ২০ সেন্টিমিটার-এর কম হয়। জানুয়ারী মাসের উদ্বুতা ১৩-২১° সেন্টিগ্রেড। [উৎপন্ন ফসল গম, রাগী, জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি)।
[৫] দাক্ষিণাত্য মালভূমির মধ্যভাগের মাঝারি বৃষ্টিপাত অঞ্চল: মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটক মালভূমির উত্তরাংশ এর মধ্যে পড়ে। বৃষ্টিপাত ৬০-১০০ সেন্টিমিটার। | প্রধান উৎপন্ন ফসল- ধান, আখ, ডাল ও তুলা।
পশ্চিম উপকূলের বেশি বৃষ্টিপাত অঞ্চল: কঙ্কন উপকূল এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল এর অন্তর্গত। বৃষ্টিপাত ২০০ সেমি-এর বেশি। জানুয়ারী মাসে উদ্বুতা ২৪° সেন্টিগ্রেডেরও বেশি। [উৎপন্ন প্রধান ফসল- ধান, মশলাপাতি, আখ, ডাল, চা, তুলা]।
[৭] দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের গ্রীষ্ম ও শীত ঋতুর বৃষ্টিপাত অঞ্চল: তামিলনাড়ু উপকূল এবং অন্ধ্র উপকূলের দক্ষিণাংশ এর অন্তর্গত। বৃষ্টিপাত ১০০-২০০ সেমি। শীতকালীন বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। জানুয়ারী মাসে উষুতা ২৪" সেন্টিগ্রেডের ওপরে থাকে। [প্রধান উৎপন্ন ফসল ধান, তুলা, তৈলবীজ, ডাল, কফি, রবার]।
[৮] পার্বত্য শীতল জলবায়ু অঞ্চল: হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে প্রধানতঃ এই জলবায়ু দেখা যায়। সারা বছরই শীত। জানুয়ারী মাসের উদ্বুতা ১০০ সেন্টিগ্রেডেরও নীচে থাকে, কখনো তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে চলে যায়। পশ্চিম হিমালয়ে শীতকালেও কিছু বৃষ্টি হয়। তবে শুষ্কতর লাডাক অঞ্চলে বৃষ্টি ২০ সেমি-এরও কম। [প্রধান উৎপন্ন ফসল- আপেল, আঙুর, আখরোট, পীচ প্রভৃতি ফল এবং ধান ও চা]