welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিসংক্রান্ত তত্ত্বসমূহ (Theories regarding the origin of Monsoon) :

মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিসংক্রান্ত তত্ত্বসমূহ (Theories regarding the origin of Monsoon) :


আবহাওয়াবিদগণের কাছে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি একটি প্রহেলিকা। এর উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু তত্ত্বের অবতারণা হলেও কোনো তত্ত্বই সর্বতোভাবে গ্রহণীয় হয়নি। তবে আধুনিক কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান ও তথ্য মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিসংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে সহায়ক হলেও আবহবিদ্যার বিশেষজ্ঞরা মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি, বিকাশ ও তার অনিশ্চিত আচরণ সম্পর্কে সহমত পোষণ করেন না। সূচনাপর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রচলিত তত্ত্বগুলিকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যথা- (ক) প্রাচীন তত্ত্বসমূহ (classical theories), (খ) আধুনিক তত্ত্বসমূহ (modern theories) |


(ক) প্রাচীন তত্ত্বসমূহ (classical theories): এডমন্ড হ্যালি প্রদত্ত মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বকে প্রাচীন তত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়।


1. প্রথাগত তাপীয় ধারণা (Classical thermal concept) :


ব্রিটিশ জলবায়ুবিদ এডমন্ড হ্যালি (Edmond Halley)* 1686 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি তত্ত্ব লন্ডনের রয়‍্যাল সোসাইটি (Royal Society) নামক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বটিকে তাপীয় ধারণা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীতে জলভাগ ও স্থলভাগের অসম বণ্টন এবং আগত সৌর বিকিরণ গ্রহণে-এই দুই ধরনের ভূভাগের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যমূলক উত্তাপ মৌসুমি বায়ু সৃষ্টির জন্য দায়ী। সাধারণত স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত ও শীতল হয়, অন্যদিকে জলভাগ ধীরে ধীরে উত্তপ্ত ও শীতল হয়। তাই ঋতুভেদে মহাদেশ ও মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বায়ুচাপের এক বিরাট তারতম্য লক্ষ করা যায়, যা বায়ুচাপীয় ঢালের পরিবর্তন সূচিত করে।



শীতকালে এশিয়ার বিস্তীর্ণ স্থলভাগ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে। কিন্তু সংলগ্ন বিশাল জলভাগ তত দ্রুত হারে তাপ বিকিরণে সক্ষম না হওয়ায় স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ অধিক উন্নতার অধিকারী হয়। এর ফলে স্থলভাগে উচ্চচাপ এবং তৎসংলগ্ন সমুদ্রে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় এবং স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুচাপীয় ঢালের উদ্ভব ঘটে। এই কারণে শীতকালে স্থলভাগ থেকে দক্ষিণের জলভাগের দিকে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় (চিত্র 14.1a)। স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে এই বায়ু অত্যন্ত শুষ্ক ও শীতল হয়। একেই শীতকালীন মৌসুমি বায়ু

বলে।


গ্রীষ্মকালে ঠিক এর বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তৎসংলগ্ন জলভাগ অত্যন্ত ধীরে উত্তপ্ত হয়। উপরন্তু উত্তরায়ণের ফলে আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (ITCZ) এশিয়ার স্থলভাগের ওপর অবস্থান করায় নিম্নচাপ আরও শক্তিশালী হয়। ফলে দক্ষিণের জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে তীব্র বায়ুচাপীয় ঢালের সৃষ্টি হয়। এই ঢাল অনুসারে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর আগমন ঘটে (চিত্র: 14.1b)। জলভাগের ওপর দিয়ে আসে বলে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে আনে এবং ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।


• সমালোচনা:


অ্যানগেট (Anget), হান (Hann), কোপেন (Koppen), বাভের (Baver), কিয়েল (Kiel), মিলার (Miller), স্টুলার (Strahler), বায়ার্স (Byers), ওয়াটস (Watts) প্রমুখ ভৌগোলিক ও আবহবিদ হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণাটিকে সমর্থন করলেও বহু আবহবিদ ও ভৌগোলিক তত্ত্বটিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে-


(i) মহাদেশের ওপর সৃষ্ট নিম্নচাপ ক্ষেত্র সর্বদা স্থায়ী হয় না। এগুলি হঠাৎ স্থান পরিবর্তন করায় স্থায়ী তাপীয় নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে না।


(ii) যদি জলভাগ ও স্থলভাগের বৈষম্যমূলক উত্তাপ প্রক্রিয়ায় মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয় তবে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে প্রতি-মৌসুমি বায়ু (Anti-monsoon) সংবহন থাকা আবশ্যিক। কিন্তু মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত অঞ্চলের ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে এই ধরনের বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।


(খ) আধুনিক তত্ত্বসমূহ (Modern theories): হ্যালি পরবর্তী মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বকে আধুনিক তত্ত্ব বলা হয়। এগুলি হল-


2. ফনের গতিশীল ধারণা (Dynamic Concept of Flohn):


হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণার সীমাবদ্ধতার কারণে 1951 খ্রিস্টাব্দে জার্মান আবহাওয়া বিভাগের (German Weather Bureau) বিজ্ঞানী এইচ. ফন (H. Flohn) গতিশীল ধারণার উপস্থাপনা করেন। ফনের মতে, সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখা (Heat equator) এবং আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (ITCZ)-এর স্থানান্তরের ফলে বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ বলয়ের ঋতুভিত্তিক স্থানান্তরের কারণে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয়।


ITCZ হল উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর সম্মিলন বলয়। এই বলয়টি নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ে অবস্থিত।


এই নিম্নচাপ বলয়ের সর্বাপেক্ষা উন্নতম স্থানের সংযোগকারী রেখা হল তাপবিষুব রেখা। সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখাটি নিরক্ষরেখার উত্তরে এবং দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণে স্থানান্তরিত হয়। তাপবিষুব রেখার এরূপ স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়টিও স্থানান্তরিত হয়।


উত্তরায়ণের সময় তাপবিষুব রেখাটি নিরক্ষরেখার উত্তরে মোটামুটি 10° অক্ষরেখা বরাবর বিস্তৃত হয়। এর ফলে ITCZ-ও উত্তরে স্থানান্তরিত হয়। অনেক সময় ITCZ-টি প্রায় 30° অক্ষরেখা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তাই দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু যখন নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত ITCZ-এর দিকে ধাবিত হয় তখন ফেরেলের সূত্রানুযায়ী ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই বায়ুকে নিরক্ষীয় পশ্চিমা বায়ু (Equatorial Westerly) বলে। এই নিরক্ষীয় পশ্চিমা বায়ুকেই আবহবিদ ফন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু


রূপে অভিহিত করেছেন। ভারতে প্রবেশ করার পূর্বে এই বায়ু বিস্তীর্ণ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে বলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম হয়। শীতকালে দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে তাপবিষুব রেখাটি দক্ষিণ গোলার্ধে 5°-10° দক্ষিণ অক্ষরেখায় স্থানান্তরিত হয় (চিত্র: 14.2b)। ফলে সমগ্র ভারতবর্ষ উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবাধীন হয়। স্থলভাগের ওপর দিয়ে আসায় এই বায়ু শুষ্ক ও শীতল প্রকৃতির হয়। এই উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুকেই ফন উত্তর- পূর্ব মৌসুমি বায়ুরূপে অভিহিত করেছেন। অধিক শুষ্ক হওয়ায় এই বায়ুর প্রভাবে শীতকালে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না।


• সমালোচনা:


ফন প্রদত্ত মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত গতিশীল ধারণাটি বহু আবহবিদের কাছে বহুভাবে সমালোচিত হয়েছে।


(1) অনেকে মনে করেন, ফন প্রদত্ত গতিশীল ধারণাটি অতি সরল। মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও ঋতুভেদে বিপরীতমুখী প্রবাহের কারণ এতটা সরল নয়। সম্প্রতি উপগ্রহ চিত্র পর্যবেক্ষণ করে ও বহু গবেষণার মাধ্যমে অনেকেই ফনের ধারণাটি বাতিল করেছেন।


(ii) অনেক আবহবিদ বলেন, যদি তাপবিষুব রেখার স্থানান্তরে ITCZ-এর স্থানান্তরের কারণে উদ্ভুত নিরক্ষীয়


পশ্চিমা বায়ু মৌসুমি বায়ুকে সৃষ্টি করে তবে পৃথিবীর সর্বত্র মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দেখা যায় না কেন? কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই এই বায়ুপ্রবাহ সীমাবদ্ধ কেন?


(iii) বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ কোরিওলিস বল। এটি নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে 5° অক্ষরেখার পর সক্রিয় হয়। ভারতের দক্ষিণে কেরালা শুরুই হয় ৪°4' উঃ থেকে, তবে এত দ্রুত কীভাবে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে রূপান্তরিত হয়?


3. জেফ্রির তত্ত্ব (Jeffry's theory):


ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ ও ভূ-পদার্থবিদ জেফ্রি মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনো তত্ত্ব প্রদান করেননি। তিনি হ্যালি প্রদত্ত তাপীয় ধারণাকে স্বীকৃতি দেন মাত্র। তিনি জল ও স্থলের বৈষম্যমূলক উত্তাপ গ্রহণের ফলে মৌসুমি বায়ু সৃষ্টি হয় বলে মেনে নিয়ে এই তত্ত্বটির প্রধান দুর্বলতাটির সমাধান করার চেষ্টা করেন। তিনি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে জলভাগ থেকে স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হওয়া মৌসুমি বায়ুর ঠিক ওপরের বায়ুস্তরে বিপরীত দিকে স্থলভাগ থেকে জলভাগের দিকে বায়ুপ্রবাহের অস্তিত্বকে প্রমাণ করেন।


জেফ্রি গাণিতিক প্রমাণের সাহায্যে দেখিয়েছেন বায়ুমণ্ডলে 2-1 কিমি ওপরে বায়ু ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুর বিপরীতমুখে প্রবাহিত হয়। তিনি বলেন যে, ট্রপোস্ফিয়ারে উচ্চতা অনুযায়ী বায়ুর চাপ হ্রাস পাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তর দিয়ে যদি পশ্চিম দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয় তাহলে 3 থেকে 6 কিমি ঊর্ধ্বে তা পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হবে। মৌসুমি বায়ুর ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটি ঘটে।


• সমালোচনা:


জেফ্রির গাণিতিক বিশ্লেষণকে গ্রহণ করলে নিচে আলোচিত দুটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়-


(i) নিম্ন অক্ষাংশে যেখানে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয় সেখানে জিওস্ট্রফিক ভারসাম্যের (Geostrophic balance) অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু জেফ্রির মডেল মেনে নিলে জিওস্ট্রফিক ভারসাম্যকে অগ্রাহ্য করতে হয়।


(ii) জেফ্রির মতবাদকে অনুসরণ করলে জল ও স্থলভাগের বৈষম্যমূলক উত্তাপের কারণেই মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয়, তা মেনে নিতে হয়। কিন্তু মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি এতটা সরল নয়।


4. র‍্যাডন কেন্দ্রীভবন তত্ত্ব (Theory of Radon Concentration):


60-এর দশকে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি নতুন ধারণার আবির্ভাব ঘটে। এই ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয়, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম জাতীয় তেজস্ক্রিয় অণুর (radioactive nuclei) বিভাজনের ফলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে মৌসুমি বায়ুর উদ্ভব ঘটে। এই তেজস্ক্রিয় অণুগুলি ক্ষয়স্থায়ী। এগুলিকে র‍্যাডন বলে। এই তত্ত্বে বলা হয় বায়ুস্তরে উচ্চ র‍্যাডনের মাত্রা মৌসুমি বায়ুর স্থলভাগে উৎপত্তিকে নির্দেশ করে।


1960-এর দশকে ওয়াই. এম. শোকালস্কি (Y. M. Shokalski) নামক সোভিয়েত জাহাজ থেকে 1960 সালের জুলাই মাসে অনেকগুলি সমীক্ষা চালিয়ে ও বিভিন্ন গবেষণা দ্বারা মনে করা হয়েছে যে, মহাদেশীয় স্থলভাগই র‍্যাডনের (থোরিয়াম) প্রধান উৎস। জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগে প্রায় দ্বিগুণ র‍্যাডন উৎপন্ন হয়। এই সমীক্ষায় লক্ষ করা যায় যে স্থলভাগের নিকটবর্তিতার কারণে লোহিত সাগরে উচ্চ র‍্যাডনের মাত্রা লক্ষ করা যায়। এরপর 70-এর দশকে ভারতের Tata Institute of Fundamental Research-এর বিজ্ঞানী ড. রামা (Dr. Rama) র‍্যাডন


ভত্ত্বের অনুকুলে অনুরূপ মন্তব্য করেন। তার গবেষণায় আফ্রিকার ইথিওপিয়া অঞ্চলে অধিক র‍্যাডনের সন্নিবেদ মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির জন্য দায়ী বলে দাবি করা হয়। তার মতে, আফ্রিকার ইথিওপিয়া ও আরব সাগর অ্যাসে ব‍্যাভনের সন্নিবেশ সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। এই র‍্যাডনের বিভাজন ঘটলে প্রচুর উত্তাপ তৈরি হয় যা জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে একটি সক্রিয় বায়ু স্রোতের সৃষ্টি করে। এই স্রোতটি ইথিওপিয়া হয়ে আবর সাগর দিয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলের দিকে এগোতে থাকে, যা মৌসুমি বায়ুর আগমনের সাথে সম্পর্কিত। অনুরূপ আরও একটি দূর্বল স্রোত আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এলেও তা পর্যাপ্ত শক্তিশালী নয়। পরবর্তীকালে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে র‍্যাডনের পরিমাণ দেখে একদল গবেষক সিদ্ধান্তে আসেন, ঋতুভেদে র‍্যাডনের মাত্রার তারতম্যের জন্য আরবসাগর ও মধ্য প্রাচাই মৌসুমি বায়ুর সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল।


• সমালোচনা:


(i) র‍্যাডন তত্ত্ব অনুযায়ী মৌসুমি বায়ু যদি স্থলভাগ থেকেই উৎপন্ন হয় তবে এই বায়ুতে এতটা পরিমাণ জলীয় বাষ্পের আগমন কীভাবে হল। কারণ আরব সাগরে এত দ্রুত প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করা সম্ভব


নয়।


(ii) একটি সমীক্ষায় বলা হয় 65° পূর্ব দ্রাঘিমারেখায় যেখানে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু 1 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত আর্দ্র অবস্থায় থাকে সেখানে 75° পূর্ব দ্রাঘিমারেখায় মালাবার উপকূলে ধাক্কা খাওয়ার সময় 6 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত আর্দ্রতা থাকা কীভাবে সম্ভব?


. বায়ুপুঞ্জ তত্ত্ব (Airmass theory): 5


বায়ুপুঞ্জ তত্ত্বটি মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনো নতুন তত্ত্ব নয়। এটি প্রকৃতপক্ষে ফনের গতিশীল তত্ত্বের একটি সম্প্রসারিত রূপ। উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন চিত্র থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (IICZ) উত্তর গোলার্ধে 20°-25° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থান করলে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে ITCZ-এর দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এটিই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। উত্তর দিক থেকে আগত উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর সঙ্গে এই বায়ুর সংঘর্ষ হলেই সীমান্তের সৃষ্টি করে। একেই মৌসুমি সীমান্ত (Monsoon Front) বলে। সম্মিলন বলয়ে সীমান্ত সৃষ্টির কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিস্তীর্ণ সমুদ্র অংশ পার করে আসার সময় জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে উন্ন ও আর্দ্র হওয়ায় হালকা হয়। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আগত আয়ন বায়ু শীতল ও শুদ্ধ হয় বলে ভারী হয়। এই কারণে দুটি ভিন্ন প্রকৃতির বায়ুর মিলনে সম্মিলন বলয় তৈরি না হয়ে সীমান্ত তৈরি হয়।


• সমালোচনা


(i) বায়ুপুঞ্জ তত্ত্বের প্রায় সম্পূর্ণটাই ফনের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই অনেকে এই তত্ত্বটিকে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র তত্ত্ব হিসাবে আখ্যা দিতে নারাজ।


(ii) বায়ুপুপ্ত তত্ত্বটিতে যে মৌসুমি সীমান্তের উল্লেখ করা হয়েছে তার যথার্থতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ যে সম্মিলন বলয়ে (IICZ) দুটি সমধর্মী সম উয়তা ও সম ঘনত্বযুক্ত বায়ুর মিলন ঘটে, সেখানে দুটি ভিন্ন চরিত্রের বায়ুর সীমান্ত কীভাবে তৈরি হবে?

6. মেঘপুঞ্জ সংবহন তত্ত্ব (Cloud Trajectory Theory):


মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও পথনির্দেশ সংক্রান্ত একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাভিত্তিক তত্ত্ব হর বায়ুসংবহন তত্ত্ব। বিশ শতকের 70-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তর (Weather Bereau) NOAA উপগ্রহ প্রেরিত চিত্রের ওপর ভিত্তি করে ভারতে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য পেশ করে। উপগ্রহ চিত্রগুলিতে ৪০° পূর্ব দ্রাঘিমারেখা বরাবর জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাসের উপস্থিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে নিরক্ষরেখার দক্ষিণে 10° অক্ষরেখার ওপর কোনো স্থানে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ঘটে। এ ছাড়া উপগ্রহ প্রেরিত চিত্র থেকে সময়ান্তরে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘের অবস্থান মানচিত্রে বসিয়ে মৌসুমি বায়ুর ভারতে আগমনের পথ নির্দেশও করার চেষ্টা করা হয়। এই সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে দক্ষিণ ভারত মহাসাগর থেকে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে মেঘপুঞ্জ উত্তরমুখী হয়ে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করে এবং সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে প্রবাহের সময় একটি ক্ষীণ বায়ুস্রোত এডেন উপসাগর ও আরব সাগর থেকে এসে প্রধান বায়ুস্রোতে মিলিত হয় এবং একে আরও শক্তিশালী


করে তোলে।


7. নিরক্ষীয় নিম্নচাপ দ্রোণীর উপস্থিতি (Existence of Equatorial trough of low pressure):


এই তত্ত্ব অনুযায়ী অনুমান করা হয় যে প্রাক্ মৌসুমি ঋতুতে নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপ দ্রোণী (trough) মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির জন্য দায়ী। উপগ্রহ চিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ভারতে মৌসুমি বায়ু আগমনের পূর্বে মোটামুটি 5° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখা বরাবর দুটি নিম্নচাপ অঞ্চল বা ট্রাফ অবস্থান করে। আবহবিদগণ একে নিরক্ষীয় দ্বৈত ট্রাফ (Equatorial Double trough) বলে অভিহিত করেন। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের শুরুর দিকে 5° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত ট্রাফটি দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু 5° দক্ষিণ অক্ষাংশের ট্রাফটি তখন সক্রিয় অবস্থায় থাকে। তবে মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গো 5° উত্তর অক্ষাংশের ট্রাফটি আরও উত্তরে সরতে থাকে এবং অবশেষে উত্তর-পশ্চিম ভারত, পাকিস্তান ও ইরাকের ওপর অবস্থিত নিম্নচাপ অক্ষের সঙ্গে মিশে যায়। এভাবে উত্তর নিরক্ষীয় ট্রাফটি শক্তিশালী মৌসুমি ট্রাফে (monsoon trough) পরিণত হয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে।


• সমালোচনা:


অধিকাংশ আবহবিদ মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির পিছনে নিরক্ষীয় ট্রাফের সঙ্গে মৌসুমি ট্রাফের মিলনের তত্ত্বকে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে, নিরক্ষীয় ট্রাফ ও মৌসুমি ট্রাফ দুটি আলাদা বিষয়। এরা কখনোই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। এ ছাড়া এই তত্ত্বটি মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সম্পর্কিত কোনো বিষয়েই আলোকপাত করতে পারে না।


৪. মাসকারেনাস উচ্চচাপ তত্ত্ব (Mascarenes High Pressure Theory):


ফন প্রদত্ত গতিশীল তত্ত্বটি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত মাসকারেনাস উচ্চচাপ তত্ত্ব দ্বারা। উপগ্রহ চিত্র মারফৎ বায়ুপ্রবাহের ধরন, মেঘের বিকাশ ও প্রবাহপথ অনুসন্ধান করে একদল আবহবিদ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, নিরক্ষরেখার দক্ষিণে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় 4000 কিমি দক্ষিণে আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপের সন্নিকটে 25° দক্ষিণ থেকে 35° দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং 40° থেকে 90° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত মাসকারেনাস উচ্চচাপ অঞ্চলের প্রতীপ ঘূর্ণবাত থেকে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি হয়। এই উচ্চচাপ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রতীপ ঘূর্ণবাত থেকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে



বায়ুর বিক্ষেপ ঘটায় এই উচ্চচাপ বলয় থেকে বায়ু দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আফ্রিকার সোমালিয়া দ্বীপপুঞ্জের দিকে ধাবিত হয় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করলে কোরিওলিস বলের প্রভাবে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় এবং উত্তর ভারতে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের প্রভাবে সোমালি স্রোত অনুসরণ করে ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে প্রবেশ করে (চিত্র: 14.3)।


মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির ক্ষেত্রে মাসকারেনাস উচ্চচাপের সক্রিয়তা নির্ভর করে ভারত মহাসাগরের ওপর সৃষ্টি হওয়া উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ কক্ষের অবস্থান এবং ওয়াকার চক্রের সক্রিয়তার ওপর। ভারত মহাসাগরে নিরক্ষরেখা বরাবর উভয়প্রান্তে একদিকে উচ্চচাপ ও অন্যদিকে নিম্নচাপ কক্ষ অবস্থান করে। একে Indian Ocean Dipole (IOD) বলে। এই দুটি কক্ষের স্থান পরিবর্তন ভারতে মৌসুমি বায়ুর আগমনকে প্রভাবিত করে। IOD-এর সক্রিয় অবস্থায় (Positive phase)


নিম্নচাপ কক্ষটি পূর্ব আফ্রিকার ভারত মহাসাগরের ওপর অবস্থান করে। অর্থাৎ, পশ্চিম ভারত মহাসাগরে নিম্নচাপ ও পূর্ব ভারত মহাসাগরে উচ্চচাপ কক্ষটি অবস্থান করে (চিত্র: 14.4a)। এর ফলে মাসকারেনাস উচ্চচাপ কক্ষটি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সোমালিয়ায় নিম্নচাপ কক্ষের দিকে সক্রিয় বায়ুপ্রবাহ দেখা যায়। এর ফলে সোমালিয়া উপকূলে মেঘের বিকাশ ঘটে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। এই সক্রিয় ট্রাফটির প্রভাবে সোমালিয়া দ্বীপপুঞ্জে দক্ষিণ- পূর্ব আয়ন বায়ুর আগমন অব্যাহত থাকে যা নিরক্ষরেখা অতিক্রম করলে কোরিওলিস বলের প্রভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুরূপে প্রবাহিত হয় এবং মৌসুমি ট্রাফকে সক্রিয় করে। তাই সক্রিয় IOD অবস্থায় মৌসুমি বায়ুর ওপর এল নিনো (EL NINO) প্রভাব খুব একটা থাকে না। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকার নিম্নচাপ কক্ষটি স্থান পরিবর্তন করলে অর্থাৎ, পশ্চিম ভারত মহাসাগরে উচ্চচাপ কক্ষ ও পূর্ব ভারত মহাসাগরে নিম্নচাপ কক্ষ অবস্থান করলে IOD নিষ্ক্রিয় পর্যায়ের (Negetive phase) মধ্য দিয়ে যায় (চিত্র: 14.4b)। এর ফলে মাসকারেনাস উচ্চচাপ বলয়ে সৃষ্ট প্রতীপ ঘূর্ণবাতটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং সোমালিয়ার দিকে তৈরি হওয়া ট্রাফটিও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই পর্যাপ্ত মেঘের বিকাশ না হওয়ায় বৃষ্টিপাতের অভাবে পূর্ব আফ্রিকায় খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই কারণে মৌসুমি ট্রাফটিও দুর্বল হয়ে পড়ে।


9. তাপীয় ইঞ্জিন মতবাদ (Thermal engine theory):


ভারতীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মুখ্য সঞ্চালক (Director General of Indian Observatories) ড. পি. কোটেশ্বরম (Dr. P. Koteswaram) 1958 খ্রিস্টাব্দে 'পৃথিবীর মৌসুমি বায়ু' সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিব্বতীয় মালভূমিতে বৈষম্যমূলক উত্তাপ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও প্রবাহের অভিমুখ নির্ধারণের প্রধান নির্ণায়ক হিসেবে প্রথম উপস্থাপন করেন। কোটেশ্বরম উদ্ভাবিত এই তত্ত্বটিকে তাপীয় ইঞ্জিন মতবাদ (Thermal Engine Theory) বলে অভিহিত করা হয়।


তিব্বতের মালভূমি একটি পর্বতবেষ্টিত মালভূমি। এর চারদিক সুউচ্চ হিমালয় ও কুয়েনলুন পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। এই পর্বতশৃঙ্গগুলির গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 6000 মিটারের বেশি। তিব্বতের মালভূমিটি সমুদ্র সমতল থেকে গড়ে 4000 মিটার ওপরে অবস্থিত এবং এর গড় বিস্তার 2000 কিমি। চারদিক সুউচ্চ পর্বতবেষ্টিত হওয়ায় আবহাওয়ার উপাদানগুলির বৈশিষ্ট্য অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা চরিত্রের হয়। কোটেশ্বরমের মতে, অতিরিক্ত সৌর বিকিরণ লাভ করায় এই অঞ্চলের আবদ্ধ বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে গ্রীষ্মকালে তিব্বতের মালভূমি ভারতীয় উপমহাদেশের তুলনায় প্রায় 3° সেঃ বেশি উত্তপ্ত হয় এবং নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। তাই কোটেশ্বরম এটিকে উত্থিত তাপীয় দ্বীপ (Elevated Heat Island) রূপে আখ্যা দিয়েছেন। এই অঞ্চলে তাই উয় বায়ু ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ট্রপোপজের সন্নিকটে জমা হয়ে 10-12 কিমি উচ্চতায় একটি সক্রিয় প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি করে। এই প্রতীপ ঘূর্ণবাতের কারণে বায়ু ছিটকে দক্ষিণমুখী হয়ে ক্রমশ উন্নতা হারিয়ে একটি অংশ গাঙ্গেয় অববাহিকায় ও আরেকটি অংশ নিরক্ষীয় অঞ্চলের নিকট ভারত মহাসাগরের ওপর নেমে আসে। এই নিম্নমুখী বায়ু পৃথিবীর আবর্তন গতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উত্তর ভারতে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে উত্তর দিকে ধাবিত হয়। ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় এই বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে এবং কোরিওলিস বলের প্রভাবে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুরূপে ভারতের পশ্চিম উপকূলে প্রবেশ করে (চিত্র: 14.5)। তবে চৈনিক আবহবিদগণ গ্রীষ্মকালে তিব্বতের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার পিছনে এপ্রিল-মে মাসে হওয়া বজ্রঝড়কেই দায়ী করেন। তাঁরা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, এই বজ্রঝঞ্ঝার ফলে বাতাসে মুক্ত হওয়া ঘনীভবনজনিত লীন তাপ ও এর সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাপ মিলে তিব্বতের মালভূমিকে একটি উত্থিত তাপীয় দ্বীপ (Evelated Heat Island)-এ পরিণত করে।



◆ সমালোচনা:

কোটেশ্বরম বর্ণিত তাপীয় ইঞ্জিন মতবাদটি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ না করলেও আধুনিক আবহবিদগণ মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির পিছনে তিব্বতের মালভূমির যে প্রভাব আছে তা মেনে নেন। তাপীয় ইঞ্জিন মতবাদের প্রধান ত্রুটি হিসেবে বলা হয় যে নিরক্ষীয় অঞ্চল একটি সম্মিলন বলয়। এখানে বায়ু সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী। তাহলে এই অঞ্চলে কীভাবে ঊর্ধ্বাকাশ থেকে বায়ুর ভূপৃষ্ঠে নেমে আসা সম্ভব? এ ছাড়া এই মতবাদে বিশেষভাবে জেট বায়ুর উল্লেখ করা হয়নি।


10. জেট বায়ু তত্ত্ব (Jet Stream theory) :


মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত জেট বায়ু তত্ত্ব সর্বাধুনিক ও সবচেয়ে বেশি যুক্তিসংগত একটি তত্ত্ব। 1973 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার ও পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার যৌথ প্রয়াসে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। একে ইন্দো-সোভিয়েত মৌসুমি সমীক্ষা (Indo-Soviet Monsoon Experiment বা সংক্ষেপে ISMEX) বলা হয়। এই সমীক্ষা চালানোর জন্য ভারত মহাসাগরে ও আরব সাগরে চারটি সোভিয়েত জাহাজ ও দুটি ভারতীয় জাহাজ প্রেরণ করা হয়। মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সমীক্ষা করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির জন্য তিব্বতীয় মালভূমির বৈষম্যমূলক উত্তাপ, পশ্চিমি জেট বায়ুর অন্তর্ধান ও পুবালি জেট বায়ুর উৎপত্তি দায়ী।


ভারতীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মুখ্য সঞ্চালক পি. কোটেশ্বরম সর্বপ্রথম মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির পিছনে তিব্বতীয় মালভূমির বৈষম্যমূলক উত্তাপ প্রক্রিয়াকে দায়ী করেন। আবহবিদ ইন (Yin)-এর মতে, তিব্বতীয় মালভূমি গ্রীষ্মকালে দুভাবে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিকে প্রভাবিত করে। যেমন-


1. গ্রীষ্মকালে এই মালভূমিটি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় প্রায় 3° সেঃ অধিক উন্ন হওয়ায় অঞ্চলটি পশ্চিমি জেট বায়ুর ক্ষেত্রে একটি যান্ত্রিক সীমারেখা (Mechanical barrier) হিসেবে কাজ করে। এই সীমারেখাটি পশ্চিমি জেট বায়ুকে হিমালয়ের উত্তরে আবদ্ধ করে রাখে এবং ভারতবর্ষকে পশ্চিমি জেটের প্রভাবমুক্ত করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমনের পথকে প্রশস্ত করে।


2. এই তিব্বতীয় মালভূমিটি গ্রীষ্মকালে একটি উত্থিত তাপীয় উৎসে (High level Heat Source) পরিণত হয়, যা কোটেশ্বরমের মত অনুযায়ী উত্থিত তাপীয় দ্বীপ (Elevated Heat Island)। এই তাপীয় উৎস থেকে বায়ু ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং টুপোপজের সন্নিকটে সৃষ্ট প্রতীপ ঘূর্ণবাতের মাধ্যমে ছিটকে ভারত মহাসাগরে নেমে এসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে সক্রিয় করে।


আবহবিদ ইন (Yin) 1949 খ্রিস্টাব্দে ভারতে মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণ হিসেবে গ্রীষ্মকালে পশ্চিমি জেট বায়ুর তিব্বতীয় মালভূমির উত্তর দিকে স্থানান্তর এবং হিমালয়ের দক্ষিণে পুবালি জেটের সক্রিয় হওয়াকে দায়ী করেন। তবে ইন পুবালি জেটকে দক্ষিণী জেট বলে অভিহিত করেন। পরবর্তীকালে 1959 খ্রিস্টাব্দে পি. কোটেশ্বরম এবং পি. আর. কৃষ্ণা (P. Koteswaram and P. R. Krishna) মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিতে পুবালি জেটের সক্রিয়তার ওপর জোর দেন। গ্রীষ্মকালে এই পুবালি জেট বায়ু উপদ্বীপিয় ভারতে (Peninsular India) 15°-20° উত্তর অক্ষাংশের ওপর অবস্থান করে এই জেট বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় 9 কিমি পর্যন্ত হয় এবং তিব্বতের মালভূমিতে সৃষ্টি হওয়া প্রতীপ ঘূর্ণবাতের ফলে সক্রিয় হয়। এটি নিরক্ষরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে ভারত মহাসাগরের ওপর বায়ুর অধোগমনকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে ভারতে মৌসুমি বায়ুর আগমনকে সুনিশ্চিত করে। কোটেশ্বরমের পর পাইরে পেডেলাবোর্দ (Pierre Pedelaborde) 1963 খ্রিস্টাব্দে 'The monsoon' গ্রন্থে, 1960 খ্রিস্টাব্দে ফন (Flohn), 1965-তে স্টিফেনসন (Stephen- son) প্রমুখ মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তি ও বৃষ্টিপাত প্রসঙ্গ্যে পশ্চিমি জেটের অন্তর্ধান ও পুবালি জেটের সক্রিয়তাকে স্বীকার করে নেন এবং সবশেষে 1973-এ ISMEX ও MONEX অভিযানও এই মতবাদের যথার্থতাকে স্বীকৃতি দিয়ে তিব্বতের মালভূমির বৈষম্যমূলক উত্তপ্তকরণ ও জেট বায়ুর প্রভাবকে যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করে।


জেট বায়ু তত্ত্ব অনুযায়ী শীতকালে সূর্যের দক্ষিণায়নের ফলে উপক্রান্তীয় পশ্চিমি জেটবায়ু (Sub-tropical Westerly Jet stream) ক্রান্তীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই সময়ে এই বায়ুর উচ্চতা হ্রাস পায়, প্রায় 3 কিমি নীচে নেমে আসে। এর ফলে পশ্চিমি জেট বায়ুটি হিমালয় পর্বত ও তিব্বত মালভূমি দ্বারা বাধা পেয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তরের শাখাটি তিব্বত মালভূমির উত্তর দিক দিয়ে এবং দক্ষিণ শাখাটি উত্তর ভারত দিয়ে প্রবাহিত। হয়ে চিনের পূর্ব উপকূলে এসে মিলিত হয় (চিত্র: 14.6a)। এই সময় এর গতিবেগও অত্যন্ত বেশি থাকে-ঘণ্টায় প্রায় 240 কিমি। পশ্চিমি জেট বায়ুর দক্ষিণ শাখার প্রভাবে কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চলে ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন স্রোত বন্ধ হয়ে যায় এবং জেট বায়ুর নিম্নভাগ থেকে শীতল বায়ুপ্রবাহ নেমে এসে উচ্চচাপ ও কেন্দ্রবহির্মুখী বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি করে। এই কেন্দ্রবহির্মুখী বায়ু ঘড়ির কাঁটার দিকে বায়ুকে বিক্ষিপ্ত করে দক্ষিণমুখী করে। এভাবে সমগ্র ভারতের ওপর উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু আধিপত্য বিস্তার করে। স্থলভাগ থেকে উৎপত্তি হয় বলে এই বায়ু অত্যন্ত শুষ্ক ও শীতল প্রকৃতির হয়।


শ্রীষ্মকালে সূর্যের উত্তবায়নের সঙ্গেঙ্গ সঙ্গে উন্নতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জেট বায়ুর দক্ষিণ শাখাটি উত্তর ভারত থেকে দুর্বল হতে শুরু করে এবং একসময় অন্তর্ধান করে। এই সময় তিব্বত মালভূমিতে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের ফলে প্রচুর লীনতাপ জমা হয়। এই লীনতাপ ও ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য তাপ একত্রিত হয়ে তিব্বত মালভূমির উন্নতা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় মোটামুটি 3° সেঃ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে তিব্বতীয় মালভূমি একটি উত্থিত তাপীয় দ্বীপে (Elevated Heat Island) পরিণত হয়। এই তাপীয় দ্বীপটি পশ্চিমি জেট বায়ুকে ভারতে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং একটি প্রাকৃতিক সীমারেখা তৈরি করে। এর ফলে পশ্চিমি জেট বায়ু হিমালয়ের উত্তরে স্থানান্তরিত হয় এবং এর উচ্চতাও বৃদ্ধি পায় (চিত্র: 14.6b)। তিব্বতের মালভূমি অঞ্চলটি অধিক উয় হওয়ায় নিম্নচাপ ক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং চারদিকে পর্বতবেষ্টিত হওয়ায় উদ্ভবায়ু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ট্রাপোপজের নীচে জমা হতে থাকে। এর প্রভাবে তিব্বতীয় মালভূমির ঊের্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে 9-12 কিমি উচ্চতায় প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। এই প্রতীপ ঘূর্ণবাত থেকে বায়ু ছিটকে দক্ষিণমুখী হয় এবং নিরক্ষরেখার নিকট নেমে আসে। এটি উত্তর দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে উত্তর ভারতে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের প্রভাবে ফেরেলের সূত্রানুযায়ী ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুরূপে ভারতে প্রবেশ করে। কোটেশ্বরম ও পরবর্তীকালে ফন-এর মত অনুযায়ী উত্তর ভারত থেকে পশ্চিমি জেট অন্তর্ধান করলে 15°-20° সমাক্ষরেখা বরাবর পুবালি জেটের আবির্ভাব ঘটে। মায়ানমার ও অসমের সূর্মা উপত্যকা অতিক্রম করে এই জেট বায়ু কলকাতা-বেঙ্গালুর অক্ষ বরাবর পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয় (চিত্র: 14.6b)। তিব্বত মালভূমিতে সৃষ্টি হওয়ায় প্রতীপ ঘূর্ণবাতের ফলে বিক্ষিপ্ত বায়ু এই পুবালি জেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এর শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। এই পুবালি জেটই নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে ওপরের স্তরের বায়ুর অধোগমনকে সচল রাখে। ফলে ভারতের দিকে মৌসুমি ট্রাফটি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে পড়ে এবং কেরালা উপকূলে হঠাৎ প্রবেশ করে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ ছাড়া এই পুবালি জেটই দক্ষিন-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে ক্রমশ পশ্চিমে ঠেলে ভারতের মধ্যেই সীমাবন্ধ রাখে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01