পৃথিবীর তাপমণ্ডল (Temperature Belts of the World):
পৃথিবীতে সমস্ত শক্তির উৎস সূর্য। সূর্য থেকে আগত আলোক শক্তি ও তাপ শক্তি সারাবছর ধরে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। প্রাপ্ত সৌরশক্তি ও সৌররশ্মির আপতন কোণের ভিত্তিতে অর্থাৎ অক্ষাংশের ওপর নির্ভর করে প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিতরা তিন প্রকার তাপমন্ডলের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার বলে এক-একটি নির্দিষ্ট উন্মুতাযুক্ত অঞ্চল পৃথিবীকে বলয়ের আকারে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে অবস্থান করছে। এগুলিকেই তাপবলয় (Heat belts) বলা হয়। প্রধান প্রধান অক্ষাংশগুলির ওপর ভিত্তি করে আগত সৌর বিকিরণের পার্থক্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রা অনুভূত হওয়ায় তাপবলয়গুলিকে সমাক্ষরেখা অনুসারে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
(i) উয়ুমণ্ডল (0° -23°30′ উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ)
(ii) নাতিশীতোয় মণ্ডল (23°30′- 66°30′ উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ)
(iii) হিমমণ্ডল (66°30′ 90° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ)
1. উষ্ণমণ্ডল (Torrid Zone):
নিরক্ষরেখার উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকে 23°30′ অক্ষাংশ পর্যন্ত কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখাদ্বয়ের মধ্যবর্তী 5,226 কিমি বিস্তৃত অঞ্চলকে উয়মণ্ডল বা গ্রীষ্মমণ্ডল বলে।
বৈশিষ্ট্য:
(ক) কর্কটক্রান্তি রেখা থেকে মকরক্রান্তি রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে সূর্যের আপাত গতি সীমাবদ্ধ থাকার ফলে এই অঞ্চলে মধ্যাহ্নে সূর্যরশ্মি বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় লম্বভাবে (90° - 43°) পতিত হয় এবং কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলের প্রতিটি স্থানে বছরে দুবার সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পতিত হয়।
(খ) সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পতিত হওয়ায় দিনের দৈর্ঘ্যের বিশেষ পার্থক্য হয় না।
(গ) দিনরাতের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য বিশেষ বোঝা না যাওয়ায় গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ঋতুর মধ্যে পার্থক্য বিশেষ লক্ষ করা যায় না। শীতঋতুর প্রভাব তেমন নেই বললেই চলে।
(ঘ) এই অঞ্চলে যে-কোনো স্থানের বার্ষিক গড় উয়তা 27° সেঃ বা তার বেশি।
(ঙ) গড় উয়তার প্রসর এই অঞ্চলে খুবই কম থাকে।
(চ) মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সিংহভাগ অঞ্চলই উয় মণ্ডলের অন্তর্গত।
2. নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল (Temperate Zone):
উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখা (23°30′ উঃ) থেকে উত্তরে সুমেরুবৃত্ত (66°30′ উঃ) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মকরক্রান্তি রেখা (23°30′ দঃ) থেকে দক্ষিণে কুমেরুবৃত্ত (66°30′ দঃ) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল নাতিশীতোয় মণ্ডলের অন্তর্গত। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের এই দুই অঞ্চলকে যথাক্রমে উত্তর নাতিশীতোয় মণ্ডল এবং দক্ষিণ নাতিশীতোয় মণ্ডল বলে। এই অঞ্চলের প্রকৃত বিস্তার প্রায় 4,800 km। আবার, এই মণ্ডলের যে অংশ হিমমণ্ডলের কাছাকাছি (প্রায় 45°- 66°30′) তাকে শীতপ্রধান নাতিশীতোয় মণ্ডল এবং যে অংশ উন্নমণ্ডলের নিকটবর্তী (প্রায় 23°30′ থেকে 45°) তাকে গ্রীষ্মপ্রধান নাতিশীতোয় মণ্ডল বলে।
বৈশিষ্ট্য:
(i) এই দুই নাতিশীতোয় মণ্ডলে মধ্যাহ্ন সূর্যরশ্মি 90° কোণ থেকে 43° কোণের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ, মধ্যাহ্ন সূর্যরশ্মি খুব খাড়াভাবে পড়ে না, আবার খুব একটা তির্যকভাবেও পড়ে না।
(ii) ফলে এই দুই তাপমণ্ডলে শীতকাল খুব শীতল হয় না, আবার গ্রীষ্মকালও খুব উন্ন হয় না।
(iii) কিন্তু ক্রান্তীয়রেখার নিকটবর্তী অঞ্চল ও মেরুবৃত্তের নিকটবর্তী অঞ্চলের মধ্যে উন্নতার যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তাই উত্তর ও দক্ষিণ নাতিশীতোয় মণ্ডলকে 45° সমাক্ষরেখার ভিত্তিতেই উয় নাতিশীতোয় মণ্ডল এবং শীতল নাতিশীতোয় মণ্ডলে ভাগ করা হয়।
(iv) এখানে গ্রীষ্মকাল হয় মৃদু উয় এবং শীতকাল হয় মৃদু শীতল।
(V) দিনরাতের দৈর্ঘ্য সারাবছর ধরে গড়ে মাঝামাঝি থাকে। তাই এখানে নাতিশীতোয় অবস্থা বিরাজ করে।
(vi) ইউরোপের সমস্ত দেশ, রাশিয়া, কানাডার অংশ নাতিশীতোয় মণ্ডলে অবস্থিত।
3. হিমমণ্ডল (Frigid zone):
দুই মেরুবৃত্ত থেকে মেরুবিন্দু পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে অর্থাৎ উভয় গোলার্ধে 66°30′ – 90° অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে হিমমণ্ডল বলে। উত্তর দিকের সুমেরুবৃত্ত থেকে সুমেরু (90°) বিন্দু পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে উত্তর হিমমণ্ডল এবং দক্ষিণ দিকের কুমেরুবৃত্ত থেকে কুমেরু বিন্দু পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে দক্ষিণ হিমমণ্ডল বলে।
বৈশিষ্ট্য:
(i) এই অঞ্চলে দিনরাতের দৈর্ঘ্যের তারতম্য অত্যন্ত বেশি। কোনো কোনো স্থানে এক থেকে ছয় মাস একটানা সূর্যকে দেখাই যায় না। যখন একটানা দিন বিরাজ করে তখন সূর্যরশ্মি অতি তির্যকভাবে পড়ে বলে বায়ুমণ্ডল কখনোই অধিকমাত্রায় উত্তপ্ত হতে পারে না। (পতনকোণ 47° -0°)
(ii) প্রায় সারাবছর এই অঞ্চল বরফাচ্ছন্ন থাকে।
(iii) গড় তাপমাত্রা ০° সেঃ-এরও কম থাকে।
(iv) একটানা রাত্রিকালীন সময়ে মেরুজ্যোতির (Aurora) প্রভাবে এই অঞ্চল মৃদু আলোকিত হয়।
(ⅴ) গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকা হিমমণ্ডলে অবস্থিত।