শক্তির উৎস সূর্য এবং সূর্যের গঠন (The Source of energy: The Solar System) :
পৃথিবীতে আগত সকল শক্তির উৎস হল সূর্য। সূর্য একটি গ্যাসীয় পিণ্ড (gaseous mass) যা পৃথিবীর তুলনায় 109 গুণ বড়ো। সূর্যের অভ্যন্তরে সর্বদা আণবিক বিস্ফোরণের কারণে প্রচুর তাপের উদ্ভব হয়। এই তাপ মূলত হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরের সময় আণবিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়। সূর্য একটি গ্যাসীয় পিণ্ড হওয়ায় এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসীমা নির্ধারণ করা মুশকিল। তাই কেবল তাপমাত্রার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে অনুমানের ভিত্তিতে সূর্যের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে সূর্যকে চারটি স্তরে বিভক্ত করা হয় (A) কেন্দ্র মণ্ডল, (B) আলোক মণ্ডল, (C) বর্ণমণ্ডল, (D) সৌরমুকুট বা সৌরকিরীট।
(A) কেন্দ্র মন্ডল (Core):
এটি সূর্যের একেবারে কেন্দ্রে বা মধ্যভাগে রয়েছে। এখানে সর্বদাই আণবিক বিস্ফোরণ এবং হাইড্রোজেনের হিলিয়ামে রূপান্তর (fusion) ঘটে চলেছে। ফলে এই অংশে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই অংশের আনুমানিক গড় তাপমাত্রা 15 মিলিয়ন °সেঃ। প্রসঙ্গত, মোট তাপীয় শক্তির। প্রায় সবটাই এই অংশে উৎপন্ন হয়।
(B) আলোক মণ্ডল (Photosphere):
কেন্দ্রের ঠিক চারদিকেই রয়েছে সূর্যের সর্বাধিক উজ্জ্বল অংশ আলোকমণ্ডল (Photosphere)। এটি প্রধানত দৃশ্যমান আলোকরশ্মি বিকিরণ করে বলে এই অংশটি আমাদের কাছে দৃশ্যমান। আলোকমণ্ডলটি মোটামুটি 300, থেকে 450 কিমি পুরু এবং অমসৃণ তলযুক্ত জ্বলন্ত গ্যাসীয় আবরণ। এর ঘনত্ব প্রায় 10" gm/cm³। এর এই অংশে বেশ কতকগুলি ছোটো ছোটো উজ্জ্বল অঞ্চল রয়েছে যেখানে তাপের প্রবাহের ফলে পরিচলন কোশের সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলগুলিকে granules বলে। এই অঞ্চলগুলি মূলত গ্যাসীয় বিস্ফোরণের ফলে প্রজ্জ্বলিত এবং উত্তপ্ত গ্যাসীয় অংশ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বহিঃপৃষ্ঠের দিকে চলে আসে ও শীতল গ্যাসীয় অংশ নিম্নমুখী হয়ে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি করে। আলোকমণ্ডলের গ্যাসীয় উপাদানের মধ্যে 90% হাইড্রোজেন ও 10% হিলিয়াম গ্যাস রয়েছে। এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা 6000 কেলভিন বা 11000° ফাঃ, আলোকমণ্ডলের তুলনামূলক উয় অংশগুলিকে faculae এবং তুলনামূলক শীতল অংশকে সৌর কলঙ্ক (Sun spot) বলে।
(C) বর্ণমণ্ডল (Chromosphere):
আলোকমণ্ডল (Photosphere)-এর ঠিক ওপরে তুলনামূলক পাতলা ও শীতল গ্যাসীয় আবরণ হল বর্ণমণ্ডল (Chromosphere)। এই স্তরটি মোটামুটি 2500 km পুরু এবং এর ঘনত্ব 10 g/cm³ থেকে 10-14 g/cm³ অঞ্চলটির গড় তাপমাত্রা 4000 k। এই অঞ্চলে সামান্য চাপের পার্থক্যজনিত কারণে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের ইলেকট্রন ও প্রোটন কণাগুলি আয়নিত হয়ে তীব্র গতি লাভ করে, যা সূর্য থেকে বহু দূরে ছুটতে থাকে। একেই সৌর ঝড় (Solar Storm) বলে।
এই আয়নিত সৌর ঝড় যখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের (magnetic field) মধ্যে চলে আসে তখন পৃথিবীর দুই মেরুর দিকে ধাবিত হয়। এর প্রভাবে মেরু অঞ্চলে সুমেরু প্রভা ও কুমেরু প্রভা (Aurora) দেখা যায়।
(D) সৌরমুকুট বা সৌরকিরীট (Corona):
এটি সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ। এর উয়তা প্রায় 1 থেকে 2 মিলিয়ন কেলভিন। বর্ণমণ্ডলের (Choromosphere) উপরিস্তর থেকে উৎপন্ন সৌর ঝড় এই স্তরের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আসে এবং পৃথিবীর আয়নমণ্ডলের (Ionosphere) সঙ্গে বিক্রিয়া করে। সূর্যের এই অংশটি কেবলমাত্র সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায়। এর ঘনত্ব তুলনামূলক কম হওয়ায় বিকিরণের মাত্রাও কম।
সুতরাং সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, হাইড্রোজেন আয়নের হিলিয়ামে পরিবর্তনের সময় আয়নিত অবস্থায় সৌরশক্তি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) রূপে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রচুর শক্তি আবদ্ধ থাকে। এটি নিউক্লিয়ার রূপান্তর (nuclear fusion)-এর সময় প্রচুর শক্তি মুক্ত করে। চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু নিউক্লিয়াস মিলে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস গঠন করে। ফলে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের ভরের তুলনায় 0.7 শতাংশ কম হয়। এই অবশিষ্ট ভর (0.3%) আইনস্টাইনের সূত্র অনুযায়ী (E = mc²) প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করে যা গামা (1) রশ্মি রূপে আলোর গতিতে (3 × 108 km/s) ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু ভর (m) খুবই অল্প এবং গতিবেগ (c) অনেক বেশি মাত্রায় হয় তাই এটি প্রচুর শক্তি অর্জন করে।