welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

স্যাপিরো ও কাইসার মডেল (The Shapiro-Keyser Model (1990) :

স্যাপিরো ও কাইসার মডেল (The Shapiro-Keyser Model (1990) :


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার উদ্ভাবন ও নতুন নতুন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে দৈনন্দিন আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, কম্পিউটার ভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রণালী এবং বহু গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে বার্কনেস প্রদত্ত মেরু সীমান্ত তত্ত্বের বেশ কিছু ত্রুটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তত্ত্বটির প্রধান ত্রুটি হিসেবে গবেষকরা দেখান যে মেরু সীমান্তের উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদ বরাবর নিম্ন ট্রপোস্ফিয়ার ও ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারের মধ্যে যে আবহাওয়াগত অবস্থা দেখানো হয়েছে তা অত্যন্ত সরলীকৃত। বাস্তবে ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারের আবহাওয়াগত অবস্থা আরও জটিল প্রকৃতির।


1950-এর দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে দৈনন্দিন আবহাওয়াগত অবস্থা সংক্রান্ত তথ্যগুলিকে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের বিকাশ সম্পর্কে আবার নতুন করে গবেষণা শুরু করা হয়। এই সময় গবেষকগণ ঘূর্ণবাতের বিকাশকালে ঊর্ধ্ব ও নিম্ন ট্রপোস্ফিয়ারের দৈনন্দিন আবহাওয়াগত অবস্থা বিচার-বিবেচনা করেন, যা বার্কনেস প্রদত্ত ঘূর্ণবাত মডেলটির ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে না। এই গবেষণাগুলিতে প্রকাশ পায় যে ঘূর্ণবাত বিকাশের সময় নিম্ন ট্রপোস্ফিয়ারে সাইক্লোজেনিসিস (Cyclogenesis) বা ঘূর্ণবাত সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। তুলনামূলকভাবে ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত সক্রিয় থাকে।


এই পটভূমিকায় 1990 সালে স্যাপিরো এবং কাইসার (Shapiro and Keyser) নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেন এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ঘূর্ণবাতের একটি অত্যাধুনিক মডেল প্রস্তুত করেন। এই তত্ত্বটিতে মেরু সীমান্ত মতবাদের ত্রুটিগুলিকে দূর করে ঘূর্ণবাত বিকাশের পর্যায়গুলিকে পরিমার্জনা করেন। তবে স্যাপিরো এবং কাইজার প্রদত্ত নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের মডেলটি প্রধানত সমুদ্রের ওপর ঘনীভূত ঘূর্ণবাতগুলির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। তাঁদের মতে, জলভাগে বিশেষ করে শীতকালের দিকে বিকাশমান ঘূর্ণবাতের উপগ্রহ চিত্রগুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে পরিণত পর্যায়ে ঘূর্ণবাতটি বেশ সক্রিয় এবং সুদৃঢ়',' (কমা) আকৃতির ন্যায় আবর্ত তৈরি করে। এই ঘূর্ণবাতগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সমোফ্লরেখাগুলির বণ্টন সীমান্ত বরাবর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে, যা তীব্র বায়ুচাপীয় ঢালকে সূচিত করে অর্থাৎ আপাতভাবে সক্রিয় ব্যারোক্লিনিক অবস্থাকেই তুলে ধরে। কিন্তু নরওয়েজীয় মডেল লক্ষ করলে দেখা যাবে সীমান্ত বরাবর সমোয়রেখাগুলির ব্যবধান ততটা কাছাকাছি নয়। এ ছাড়া, তাঁদের নির্দেশিত মডেল অনুযায়ী ঘূর্ণবাত যত বিকাশ লাভ করে ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে উয়তা পারিপার্শ্বিক এলাকার তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে ঘূর্ণবাত আরও সক্রিয়তা লাভ করে।

        সাপিরো এবং কাইজার ঘূর্ণবাতের পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্রকে 4টি পর্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন।


1. প্রারম্ভিক পর্যায় (incipient Stage):

থেকে আগত শীতল মেরুবায়ু এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আগত উয়ু পশ্চিমা বায়ু দ্বারা তৈরি সীমান্তীয় অঞ্চলে (frontal zone) একটি আদর্শ ব্যারোক্লিনিক অবস্থা সৃষ্টি করে। এর ফলে উয়ু ও শীতল বায়ুপুঞ্জের মধ্যে একটি দীর্ঘ বিস্তৃত উয় ও শীতল সীমান্তের উদ্ভব হয়। সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় 400 কিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দুটি সীমান্তের মিলন স্থলে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় স্থানে ঘূর্ণবাতের নিম্নচাপ কেন্দ্রটি অবস্থান করে।



স্যাপিরো ও কাইসার মডেল






2. সীমান্তীয় ভগ্নদশা (Frontal fracture) :

ঘূর্ণবাত বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে শীতল বায়ুর গতিবেগ উয় বায়ুর তুলনায় দ্রুত হওয়ায় শীতল সীমান্তটি দ্রুত অগ্রসর হয়ে নিম্নচাপ কেন্দ্রের একেবারে দক্ষিণে চলে আসে এবং উয় বায়ুকে ঘিরতে শুরু করে। শীতল সীমান্তীয় অঞ্চলে শুষ্ক তাপবিযুক্তি হার প্রক্রিয়ায় (dry adeabetic lapse rate) দ্রুত মেঘের বিকাশ ঘটে। এর প্রভাবে সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে স্যাপিরো-কাইজার-এর মতে, এই ধরনের ঘূর্ণবাতে শীতলবায়ুর গতিবেগ মেরু সীমান্ত তত্ত্বের ন্যায় ততটা প্রবল থাকে না। শীতল সীমান্তের প্রান্তভাগে অর্থাৎ ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রের দিকে বায়ুপ্রবাহ ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। তাই শীতল সীমান্তটি ঘূর্ণবাতের দক্ষিণ। দিক থেকে উন্ন সীমান্তের সাপেক্ষে মোটামুটি সমকোণে অবস্থান করে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে দুটি সীমান্ত কখনোই সংযুক্ত হয়ে একটি কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হয় না। এই ঘটনাকেই স্যাপিরো ও কাইজার সীমান্তীয় ভগ্নদশা (frontal fracture) বলে অভিহিত করেন।


3. উয় সীমান্তের পশ্চাদমুখী বক্রতা এবং T-আকৃতির গঠন (Bent back warm front & frontal T-bone structure) :


ঘূর্ণবাত বিকাশের তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ পরিণত পর্যায়ে (mature stage) স্যাপিরো-কাইজার String Jet বায়ুর কথা উল্লেখ করেন। ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে অবস্থিত শীতল জেটবায়ুর একটি অংশ শীতল সীমান্তীয় অঞ্চল বরাবর নিম্নমুখী হয়ে Frontal fracture-এর দিকে অগ্রসর হয়। এই শীতল জেট বায়ুর অংশটি আর একটি গৌণ শীতল সীমান্ত সৃষ্টি করে অগ্রসর হওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী উয় সীমান্তের প্রান্তভাগকে ক্রমশ পিছনের দিকে ঠেলতে থাকে। ফলে উয় সীমান্তটির প্রান্তভাগটি ক্রমশ বাঁকতে বাঁকতে একটি (bent back) হুকের আকৃতি ধারণ করে এবং Frontal fracture-এর দিকে শীতল জেট বায়ু প্রবেশ করতে থাকে। এর ফলে ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রটি উয় বায়ু দ্বারা অধিকৃত হয় এবং কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে উন্নতা দ্রুতহারে কমতে থাকে। এই অবস্থায় প্রাথমিক শীতল সীমান্তটি উন্ন সীমান্তের সাপেক্ষে সমকোণে অবস্থান করে অগ্রসর হওয়ায় দুটি সীমান্ত দেখতে ইংরেজি অক্ষর "T'-আকৃতির হয় (চিত্র: 19.13c)। একেই স্যাপিরো-কাইজার 'T'-আকৃতির গঠন (T-bone structure) বলে অভিহিত করেছেন।


4. পৃথকীকরণ (Warm core frontal seclusion) :


ঘূর্ণবাতের অন্তিম পর্যায়ে কেন্দ্র সংলগ্ন উন্নভাগের উয় সীমান্তের ক্রমশ পশ্চাদমুখী বক্রতা (bent back)-র কারণে এবং শীতল বায়ু দ্বারা অধিকৃত হওয়ার ফলে উয় বায়ুর কিছু অংশ মূলস্রোত থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। এই ঘটনাকেই স্যাপিরো-কাইজার সেকুসান (seclusion) বলে অভিহিত করেছেন। এর ফলে কেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চল থেকে বাইরের দিকে উয়তা দ্রুত কমতে থাকায় খাড়া তাপীয় ঢাল বৃত্তাকারে কেন্দ্রকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। এভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া উয় বায়ুর ভাগটি ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ করে পারিপার্শ্বিক বায়ুর উন্নতার কাছাকাছি চলে আসে। অবশেষে ঘূর্ণবাত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।


◆ সমালোচনা (Critisism):

স্যাপিরো-কাইজার প্রদত্ত নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বিকাশের এই মডেলটি সর্বাধুনিক তথ্যপূর্ণ ও বহু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হলেও বেশ কিছু ত্রুটি থেকে গেছে। যেমন-


1. সর্বপ্রথম এবং প্রধানতম ত্রুটি হল-মডেলটি কেবলমাত্র নাতিশীতোয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর তৈরি হওয়া ঘূর্ণবাতগুলির পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল। ফলে স্থলভাগে ঘূর্ণবাতের চরিত্র কী ধরনের হতে পারে তা তুলে ধরতে তত্ত্বটি অসমর্থ হয়। ফলে এই মডেলটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা হারায়।


2. সাপিরো-কাইজার মডেলটি তুলে ধরার জন্য বেশ কিছু গাণিতিক ও সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতির ব্যবহার করেছিলেন ঠিকই কিন্তু মডেলটিতে ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে তাঁরা অতিসংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাখ্যা করেন। ফলে মডেলটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়।


3. ঘূর্ণবাতের বিকাশে জেট বায়ুর প্রভাব যে রয়েছে তা প্রমাণিত হলেও ঠিক কীভাবে ঘূর্ণবাতকে সঞ্চালিত করে তা নিয়ে মডেলটি খুব একটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01