আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন [Regional Planning and Development]
প্রধান উপাদানসমূহ (Key elements of development):
কোনও একটি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বেশ কতকগুলি উপাদান আন্তঃসম্পর্কযুক্ত হয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিক এলন করে। এর মধ্যে (Natural resources): একটি পালন এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল- দেশের উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাসে প্রকৃতির
• প্রাকৃতিক সময়োজন। কারণ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ (জমি, জল, বনভূমি, খনিজ উপাদান প্রভৃতি) সুন্দর ব্যবহার করেই মূলত শিল্প-পরিকাঠামোর যাবতীয় ভিত গড়ে ওঠে, যা আবার পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের আয় বৃদ্ধি ঘটিয়ে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে তোলে। যে সমস্ত দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি রয়েছে, সেখানকার উন্নয়ন দ্রুত ব্যাহত হয়।
অবশ্য কয়েকটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ জাপান এমন একটি দেশ যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি থাকলেও, অন্যান্য দেশ থেকে কিছু কাঁচামাল ও খনিজ আমদানি, উচ্চ মানের প্রযুক্তি, নতুন গবেষণা এবং জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তারা এখানকার সম্পদের ঘাটতি মেটাতে যথেষ্ট সফল হয়েছে। একইভাবে ব্রিটেন অ-লৌহঘটিত যাতু ছাড়াই শিল্প বিকাশের চরম সীমায় পৌঁছাতে সচেষ্ট হয়।
• মানবসম্পন্ন (Human resources):
সাধারণত মানবসম্পদ বলতে আমরা দক্ষতা, শিক্ষাগত গুণাবলী উৎপাদনশীলতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং দূরদৃষ্টি সহ একাধিক মানবীয় গুণাবলী তথা মানবপুজিকেই বুঝে থাকি। মূলত উন্নয়ন অর্জনের পথে প্রাকৃতিক সম্পদের মতোই মানবসম্পদগুলির ভূমিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কার্যক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি মানবসম্পদের পরিধি ও দক্ষতার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অধ্যাপক মেয়ারের মতে, মানব পুঁজি গঠন হল "the process of acquiring and increasing the number of persons who have skills, education and experience which are critical for the economic and political development of the country."
• প্রযুক্তি(Technology):
প্রযুক্তিকে বরাবরই আধুনিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তিগত দক্ষতা বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনশীলতা যেকোনও উৎপাদনের পরিমাণের বৃদ্ধি ঘটিয়ে উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে। সেই সাথে উচ্চ পর্যায়ে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সহজেই দেশের অগ্রগতিকে সচল রাখা যায়। অবশ্য, প্রযুক্তির মাত্রা স্থির থাকলে উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। সেই কারণে উন্নত দেশগুলিতে দ্রুত উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলিই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
রবার্ট সোলোর মতে, মার্কিন অর্থনীতির প্রায় 2/3 শ্রমশক্তি এবং মূলধনের সর্বোত্তম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেখানকার প্রযুক্তির মাত্রাগত পরিবর্তন ও ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বজায় রেখেছে। এ প্রসঙ্গেঙ্গ লুইস বলেছেন-"যে দেশটিকে আজ সম্পদের দিক থেকে দরিদ্র বলে মনে করা হয়, সেটি পরবর্তী সময়ে অর্থনেতিক দিক থেকে খুব ধনী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, শুধুমাত্র সেখানকার অজানা সম্পদ আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে নয়, বরং সম্পদগুলির জন্য নতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তিগত ব্যবহার হওয়ার জন্য।
পরিকাঠামো হল সেই সমস্ত মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও পরিসেবা, যা মানুষের যাবতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডকে আরও সহজ করে তুলে উন্নয়নে শামিল হয়। এটি শুধু উৎপাদনকেই প্রভাবিত করে না, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এসময় এটি শুধু উৎপাদনকেই খাত উন্নত না হলে সেখানে সমুন্সির সব ধরনের প্রচেষ্টাই ব্যাহত হয়। সেই কারণে চা দেশের পরিকাঠামোগত যোগাযোগ বাবস্থার উন্নতি, পানীয় জলের সুব্যবস্থা, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, ব্যাংকিং ও বীমা, সেচ ও বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি পরিকাঠামোগত বিভিন্ন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক পরিতে বিদ্যুৎ বিজ্ঞান ও রূপে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যেমন- আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশে পরিকাঠামোর ক্ষেত্রগুলিকে ব্যাপকভাবে ঢেলে সাজানোর ফলে তারা সব দিক থেকেই যথেষ্ট উন্নত।
• প্রশাসনিক পরিধি (Administrative Scope):
উন্নয়ন কার্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনের পরিধিগুলি দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। উন্নয়নের প্রশাসনিক কার্যনীতিতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতার একাধিক বিষয়গুলিকে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে বিবেচনা করে বহুমুখী একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
• সমৃদ্ধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো (Improved social and cultural structure):
একটি দেশের সংস্কারমুক্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো উন্নয়নের প্রক্রিয়াতে যথেস্ট উৎসাহ প্রদান করে থাকে।
• গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ (Democratic Political Environment):
জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজনৈতিক পরিমন্ডলের স্থিতিশীলতা, সহধর্মিতা, সরকারি কাজে জনগণের অংশগ্রহণ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক বিষয়গুলি বর্তমানে উন্নয়নকে আরও যুগোপযোগী করে তুলেছে।
এখানে, সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নয়নের উপাদানগত বিষয়সমূহকে একটি ধারণাচিত্র (6.18 নং) দ্বারা উপস্থাপন উন্নয়নের বিভিন্ন রূপ (Different forms of Development):
বিশেষজ্ঞরা মানবসভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত একটি বহুমুখী কল্যাণকামী প্রক্রিয়ারন্সে উন্নয়নকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিভত্ব করেছেন, যেমন
প্রকৃতি অনুসারে (According to nature)
প্রকৃতি অনুসারে উন্নয়নের দুটি রূপ লক্ষ্য করা যায়-
(1)প্রকৃতি অনুসারে উন্নয়ন Quantitative development):
পরিমাণগত উন্নয়ন কেরটিতে কোনও অর্থিত প্রতি পরিমানও একটি সমকালের নিরিখে সার্বিক অনুশিকে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বিবেচনা ও তার যথাবল এন করা হয়ে তাতে আমাদের দেশের নৃপতি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে উন্নয়ন বোঝাবে সেখানকার মোট ঘোড়া মূল্যায়ন হয়ে বা হাতির সংখ্যা, সৈনাদের সংখ্যা, বাজারের সংখ্যা, এমনকি দাতব্যালয়ের সংখ্যাকেও বিবেচনা করা হত।
• গুণগত উন্নয়ন (Qualititative development):
যখন কোনও একটি দেশের আর্থ-সামাজিক কার্যাবলীর ধারাবাহিক অগ্রগতিকে গুণগত তাৎপর্যতায় (ভালো-মন্দের বিচারে) বিবেচনা করা হয়, তাকেই গুণগত উন্নয়ন বঙ্গে। যেমন-বিভিন্ন পরিবেশগত অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে গুণগত উন্নয়নের ধারণাটিকেই বিশেষ প্রাধান দেওয়া হয়। উল্লাসভাত উল্লেখ্য, পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় ধারণা দুটিকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমানভাবে বিবেচনা করা হলেও, বর্তমানে উন্নয়নের মাত্রাগত প্রকৃতি এখনও পরিমাণগত ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমায়িত রয়ে গেছে।
স্থানিকতা অনুসারে (According to Spatiality):
উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি কোনও একটি দেশের বা অঞ্চলের ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ উভয় প্রকৃতির স্থানিক স্কেলেই পরিলক্ষিত হয়। তাই, উন্নয়ন স্থানিকতার দিক থেকে এর তিনটির বিশেষ রূপ হল-
• স্থানীয় উন্নয়ন (Local development):
উন্নয়নের সবচেয়ে সাধারণ রূপ হল স্থানীয় উন্নয়ন, কোনও একটি দেশের নিম্ন প্রশাসনিক স্তর মারফত বাসগৃহের সম্প্রসারণ, রূপান্তর, ছোটো ও মাঝারি আবাসন সংস্কার, কুটির শিল্প উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্র কোনও আঞ্চলিক পরিসেবার প্রকল্পকে ঘিরে অব্যাহত থাকে। সাধারণত, বিভিন্ন গ্রাম বা ক্ষুদ্র শহরাঞ্চলগুলিতে এই ধরনের স্থানীয় উন্নয়নমূলক পদক্ষেপগুলি "অনুমতিপ্রাপ্ত উন্নয়ন" (Permitted development)-রূপে বিবেচিত হয়। স্থানীয় উন্নয়ন পদ্ধতি অঞ্চলগুলির অন্তঃসত্ত্বাকেন্দ্রিক সম্ভাবনা বিবেচনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
• আঞ্চলিক উন্নয়ন (Regional development):
যে সমস্ত পরিকল্পিত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপগুলিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখে গ্রহণ করা হয়, সেটি আঞ্চলিক উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শিল্পোন্নত বেশিরভাগ দেশগুলিতে কোনো না কোনো ধরনের আঞ্চলিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। অতীতে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আঞ্চলিক উন্নয়ন নীতিগুলিকে বৃহত্তর অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিকাশের জন্য অথবা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল। বর্তমানে আঞ্চলিক উন্নয়নের যাবতীয় কর্মপন্থাগুলিকে একটি দেশের ভৌগোলিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে গ্রহণ করা হয়। এখানে যেসমস্ত বিষয়গুলি সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে, সেগুলি হল-
(i) প্রাদেশিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি, (ii) আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান, (iii) সমষ্টিগত আর্থিক সহায়তা প্রদান প্রভৃতি।
• জাতীয় উন্নয়ন (National development):
জাতীয় উন্নয়ন শব্দটি এমনই একটি বহুধাবিস্তৃত শব্দ, যেটিকে জাতীয় জীবনের সমষ্টিগত দিকগুলিকে ইতিবাচকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রযোজ্য হয়। সামগ্রিক এই প্রক্রিয়াটি একটি দেশের বিভিন্ন ক্ষোত্রে সার্বিক পুনর্গঠন এবং আপামর ব্যক্তিবর্গের বিকাশে অত্যন্ত সহায়তাপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলে।
এ প্রসঙ্গে John Vaizey বলেছেন- "জাতীয় উন্নয়ন হল সমস্ত নাগরিক শক্তির সামগ্রিক প্রভাব যা ভৌতসম্পদ, মানবসম্পদ, জ্ঞান ও দক্ষতার ভাণ্ডার গড়ে তোলে।"
বস্তুতপক্ষে, জাতীয় উন্নয়ন দেশের সুবিধাবন্ধিত জনগোষ্ঠীকে তাদের পূর্ণ সম্ভাধন্য উপলব্দি করে অর্থনৈতিক, আমাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত একাধিক পরিসেবা প্রদানের মাধ্যমে যথেষ্ট উৎসাহিত করে তোলে। অনেক সমর, জাতীয় উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পে আঞ্চলিক স্তরে সম্পদ স্থিতিকরণ ও জীবনের মান উন্নত করার
একটি পূর্বশর্ত হিসেবেও গণ্য করা হয়। জাতীয় উন্নয়নে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যেমন
(1) জাতীয় অর্থনীতির পুনগঠনে পরিকল্পিত উন্নয়ন, (ii) আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃশি (1) শিল্পভিত্তিক উৎপাদনে সহায়তা, (iv) মানবসম্পদ উন্নয়ন, (৩) বিভিন্ন উৎপাদগের মা সার্থক প্রয়োগ, (১১) গণশিক্ষার ব্যবস্থা, (vii) দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান প্রভৃতি।
(C) উন্নয়নের পরিসর অনুসারে (According to the scope of development):
পরিসরগত দিক থেকে উন্নয়নের যে কয়েকটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি হল-
• অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic development):
• ধারণা (Concept): উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণাটি প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দিয়ে উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনও একটি দেশের উদীয়মান অর্থ ব্যবস্থায় প্রকৃত জাতীয় আয় এবং উৎপাদনের বণ্টনগত ভারসাম্যতা বজায় রেখে মানুষের জীবনযাত্রাকে উচ্চতর মানদণ্ডে উপনীত করা হয়।
এ প্রমুখ Baldwin ও Meier বলেছেন- "Economic development is a process whereby an conomy's real national income increase over a long period of time অধ্যাপক Rostow অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গেঙ্গ বেশ কতকগুলি প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলি হল- (i) মৌলিক বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ প্রবণতা, (ii) প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রবণতা, (iii) নতুন কলাকৌশল এবং যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের প্রবণতা, (iv) ভোগ ও সঞ্চয় প্রবণতা, (v) বস্তুগত অগ্রগতিসাধনের প্রবণতা প্রভৃতি।
তবে, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনিস মনে করেন, কোনও সমাজে অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা সর্বনিম্ন প্রাপ্যতার থেকে জীবনযাপন করছেন, তাদের যতক্ষণ না উন্নয়ন ঘটছে সেটিকে সার্বিক উন্নয়ন বলে গণ্য করা ঠিক নয়।
• উদ্দেশ্য (Purpose):
অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল-
দেশে আর্থনীতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো।
কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি।
শিল্পের বহুমুখীকরণ প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন।
* ব্যাবসাবাণিজ্যের সম্প্রসারণ প্রভৃতি।
• বৈশিষ্ট্য (Characteristics):
(i) অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি অত্যন্ত গতিশীল এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
(ii) এটি সর্বদা প্রকৃত উৎপাদন এবং আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
(iii) অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাঠামোয় দেশে সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।।
(iv) অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বদা একটি ভারসাম্য অবস্থায় পৌঁছাতে চায়।
(v) অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে কোনও একটি দেশ বা অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যাগুলিকে সহজেই নির্মূল করা সম্ভব।
• অন্তর্ভুক্ত বিষয় (Topics included): অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, সার্বিক কর্মসংস্থান, বেকার সমস্যার সমাধান ও দারিদ্র দূরীকরণ, কৃষি-শিল্প-ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার এমনকি উচ্চমানের জীবনধারাকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্তকৃত প্রতিটি বিষয়েরই একাধিক ক্ষেত্র বলেছে। সেগুলিকে 6.20 নং ধারাণ্যচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হল। অর্থনৈতিক উন্নয়নেরCharles Kindleberger Bruce Herrick-এর মতে ধারণায় সাধারণত সমস্ত বিষয়গুলি যুক্ত থাকে, বার মধ্যে কয়েকটি হল (1) বস্তুগত কল্যাণের উন্নতি, (ii) গণ দারিদ্র্য, অশিক্ষা, যার অকালমৃত্যু দুরীকরণ, (ii) উৎপাদন ক্ষেত্র এবং উৎপাদিত কৌশলের গঠনমূলক পরিবর্তন, (IV) জনকল্যানমূী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলির সম্প্রসারণ প্রভৃতি।
• অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপায় (Ways of economic development): অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে বিভিন্ন দেশে একাধিক কর্মপন্থা অবলম করা হয়। এগুলি হল-
• সম্পদের সদব্যবহার (Resource Utilization): একটি দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সেখানকার প্রাকৃতিক এবং মানবিক সম্পদের সশ্যবহার সর্বাধিক মনোনিবেশ করা হয়ে থাকে। এখানে
বীশের প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদগুলির সর্বোত্ম ব্যবহার একদিকে যেমন নতুন পুঁজি বিনিয়োগের পথ সুগম করে, অন্যদিকে শ্রমশস্তির পর্যাপ্ত জোগান এবং উৎপাদনের গুণগত মান বৃদ্ধি
অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান ক্ষেত্রসমূহ
ঘটিয়ে সেখানকার মানবসম্পদকেও যথেষ্ট উৎসাহিত করে। এইভাবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অবলম্বন করে কোনে একটি দেশ উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত স্তরে এগিয়ে যায়।
• মূলধন গঠন (Capital formation): অর্থনৈতিক প্রগতি মূলধন গঠনের প্রবৃত্তি এবং যথার্থ বিনিয়োগ হারের পরিমাণের ওপরেও বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ Bohm Bawerk বলেছেন, মূলধন হল উৎপাদনের অন্যতম উৎপাদিত উপকরণ (Produced means of production)। কোনও দেশে মূলধন গঠনের পরিমাণ বাড়লে নতুন করে বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামোর পথ সুগম হয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক পরিস্থিতি গাড়ে তোলে।
• কৌশলগত প্রচেস্টা (Strategic Efforts): যে সমস্ত দেশের উৎপাদনগত অর্থনৈতিক কৌশল বা উল্লবী প্রচেষ্টা যত উন্নত এবং যুগোপযোগী, সেই সমস্ত দেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে চিরকালই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকে। অধ্যাপক A. K. Nandi-র মতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলত তিন ধরনের উদ্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়, যেমন-
(1) পণ্য আবিষ্কার (Product innovation): এটির দ্বারা পুরানো পদ্ধতিতে নতুন দ্রব্য উৎপাদনকে বোঝায়।
(B) পদ্ধতি আবিষ্কার (Process Innovation): এটির দ্বারা নতুন পদ্ধতির সাহায্যে পুরানো দ্রব্য উৎপাদনকে বোঝায়।
(ii) পণ্য ও পদ্ধতি আবিষ্কার (Product and process innovation): এটির দ্বারা নতুন পদ্ধতিতে নতুন দ্রব্য উৎপাদনকে বোঝায়।
আসলে উন্নত প্রযুক্তি বা কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি দেশের উৎপাদনের গড় ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণে কমে যায়। এক্ষেত্রে, মোট ব্যয় হ্রাসের সুবাদে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানগুলি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে, সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক জোয়ার আসে। যেমন-ব্রিটেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলি এই কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে।
• শ্রম বিভাজন এবং শ্রম বিশেষীকরণ (Labor Division and Labor Specialization): কোনও একটি দেশের উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে শ্রম বিভাজন এবং শ্রম বিশেষীকরণ নীতি পরোক্ষভাবে উৎপাদন বা জোগানের মাত্রা বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ঘটিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে।