বিকিরণের প্রকৃতি ও বিধিসমূহ (Nature and Laws of Radiation) :
প্রতিটি বস্তুই ছোটো হোক বা বড়ো, পরম তাপমাত্রা (absolute zero) অপেক্ষা উম্ন হলে বিকিরণে সক্ষম। বই, আমাদের শরীর, উদ্ভিদ, বায়ুমণ্ডল, গ্রহ ও নক্ষত্র প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট মাত্রার তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তবে কোনো বস্তু বা উপাদান থেকে একক ক্ষেত্রফলে তাপবিকিরণের হার বস্তুর তাপমাত্রা (surface temperature) এবং পৃষ্ঠতলের প্রকৃতির (Nature of Surface) ওপর নির্ভর করে। বিকীর্ণ তাপ কোনো বস্তুর ওপর পড়লে
(1) ওই তাপের কিছু অংশ শোষিত হয়,
(ii) কিছু অংশ প্রতিফলিত হয় এবং
(iii) বাকি অংশ বস্তুটি স্বচ্ছ হলে তার মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়। অতএব, 1 একক আপতিত বিকীর্ণ তাপের 'a' অংশ শোষিত, 'r' অংশ প্রতিফলিত এবং'।' অংশ সঞ্চালিত হলে আমরা পাই,
a+r+t=1
এই সমীকরণটি থেকে বোঝা যায়, যে বস্তু যত বেশি বিকীর্ণ তাপ শোষণ করে ততই কম প্রতিফলন করে। তাই অস্বচ্ছ মাধ্যম বিশিষ্ট অমসৃণতলযুক্ত কালো বর্ণের বস্তুর তাপ শোষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি হয়। আবার, তাপশক্তি শোষণ করে যেহেতু পদার্থের অণুগুলি গতিশক্তি লাভ করে, তাই যে বস্তু যত তাপ শোষণে সক্ষম সেই বস্তুর তাপ বিকিরণ করার ক্ষমতাও তত বেশি হয়। অর্থাৎ, উত্তম তাপ-শোষক যেমন উত্তম বিকিরক তেমনি ততটাই খারাপ প্রতিফলক।
বিকিরণের এই ধারণা থেকে কৃষ্ণবস্তু (Black body)-এর ধারণা এসেছে। একটি আদর্শ কৃষ্ণবস্তু (Perfect Blackbody) বলতে সেই কাল্পনিক বস্তুকে বোঝায় যা প্রমাণ তাপমাত্রায় তার সমস্ত শক্তি বা উত্তাপ বিকিরণ করতে সক্ষম হয়। (A hypothetical body which emits the maximum possible radiation for a given temper- atue is called Blackbody. -G.T.Trewartha & L.H.Hons)। এই ধরনের বস্তু আবার আপতিত বিকিরণের সবটুকুই শোষণ করে নেয়, এর কোনো অংশই প্রতিফলন বা সঞ্চালন করে না।
অর্থাৎ, একটি আদর্শ কৃম্নবস্তুর ক্ষেত্রে r = 0, t = 0 এবং a = 1। সূর্য একটি আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর উদাহরণ।
সুতরাং বিকিরণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আমরা বিকিরণের কিছু ধর্ম (properties) বা কিছু মৌলিক বিষয় (Basic Principle) জানতে পারি। এই নীতিগুলি সূত্র দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যেমন-
(ক) Principle I:
"Short waves are characterized by high frequencies, long waves by low frequencies". অর্থাৎ, বিকীর্ণ তাপের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে প্রবাহমাত্রা ব্যস্তানুপাতে সম্পর্কিত। তাই বিকীর্ণ তাপের গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমতুল্য হওয়ায় এর বেগ (c) তরঙ্গদৈর্ঘ্য (১) ও প্রবাহমাত্রা (f) গুণফলের সঙ্গে সমানুপাতিক। অর্থাৎ, c = Af
(খ) Principle II:
"Hot object radiate more energy than cool object", অর্থাৎ, উয় বস্তু শীতল বস্তুর তুলনায় অধিক হারে তাপ বিকিরণ করে।
কৃষ্ণবস্তু যেমন আপতিত রশ্মির সবটুকুই শোষণ করতে সক্ষম তেমনি শোষিত শক্তির সম্পূর্ণটাই বিকিরণ করতে পারে। তাই যে কৃষ্ণবস্তুটি অধিক উন্নতা লাভ করবে সেটি তত বেশি মাত্রায় বিকিরণ করতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে 1879 সালে বিজ্ঞানী জোসেফ স্টিফেন উয় কৃষ্ণবস্তুর থেকে বিকীর্ণ তাপের পরিমাণ এবং ওই বস্তুর উন্নতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি সূত্র নির্ণয় করেন। 1884-তে বোলম্যান (Boltzmann) এই সূত্রটির তাত্ত্বিক প্রমাণ দেন। তাই এই সুত্রকে একত্রে স্টিফেন-বোলম্যান (Stefan-Boltzmann) সূত্র বলে।
Pic 1 scroll down for picture 👇
★ স্টিফেন-বোলজম্যানের সূত্র (Stefan-Boltzmann Law):
The total amount of radiation from a blackbody is propor- tional to the 4th power of its absolute temperature, কোনো আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে প্রতি সেকেন্ডে বিকীর্ণ সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তির মোট পরিমাণ ওই বস্তুর পরম উন্নতার চতুর্থ ঘাতের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, T' যদি বস্তুর পরম উয়তার মান হয় তবে বিকীর্ণ শক্তির পরিমাণ- E = στ
এখানে σ হল স্টিফেন-বোলম্যান ধ্রুবক। এর পরীক্ষালব্ধ মান 5.67 x 10⁸ w/m²/k⁴ বা 5.67 x 10⁵ erg/cm²/S/k
অনুরূপভাবে, সূর্যের পৃষ্ঠদেশের পরম তাপমাত্রা 6000 k। তাই সূর্যের মোট শক্তির পরিমাণ সূত্রানুযায়ী হবে 73483.2 w/m²
(গ) Principle III: "Inverse relationship between wavelength of the radiation that an object emits and the absolute temperature of the object", অর্থাৎ, বিকীর্ণ শক্তির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে বস্তুর পরম উন্নতার ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক বর্তমান।
অর্থাৎ, বস্তু যত বেশি উষ্ন হবে তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তত বেশি ক্ষুদ্রতর হবে। একটি আদর্শ কৃষ্ণবস্তু সর্বাধিক কত মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ করবে তা ভিন (Wien) একটি সূত্রের মাধ্যমে উল্লেখ করেন যা ভিনের সরণ সূত্র (Wien's displacement law) নামে পরিচিত।
Pic 2 scroll down for picture 👇
★ ভিনের সরণ সূত্র (Wilhelm Wien's displacement law):
"The wavelength at which a blackbody emits maximum radiation is inversly proportional to the absolute temperature" বিকীর্ণ শক্তির সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান বিকিরকের পরম উন্নতার ব্যস্তানুপাতিক হয়। অর্থাৎ,। যদি বস্তুর পরম উয়তা হয় তবে ভিনের সূত্রানুযায়ী বস্তুটির সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে-
Amax = C/+ | এখানে ৫ হল ভিন ধ্রুবক। এর মান 2898 µk |
ভিনের সূত্র প্রয়োগ করে সূর্য ও পৃথিবী দ্বারা বিকীর্ণ তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের সর্বোচ্চ মান কত হতে পারে তা নির্ণয় করা যায়।
সুতরাং পৃথিবী থেকে বিকীর্ণ তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সূর্যের তুলনায় বেশি। তাই পৃথিবীর বিকিরিত তরঙ্গকে দীর্ঘতরঙ্গ (Long wave radia- tion) এবং সূর্য থেকে বিকিরিত তরঙ্গকে ক্ষুদ্রতরঙ্গ (Short wave radiation) বলা হয়। বিকিরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় সূর্য পৃথিবী অপেক্ষা অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষুদ্রতরঙ্গ বিকিরণ করে।
Pic 3 scroll down for picture 👇
(ঘ) Principle IV: "Strong absorbers of radiation are also strong emitters at particular wavelength and poor absorbers are poor emitters at same wavelength." একই ধরনের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে বিকীর্ণ তাপের উত্তম শোষক মাত্রই উত্তম তাপ বিকিরক। মানুষের যেমন খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দ রয়েছে তেমনি বস্তুরও তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা রয়েছে। অর্থাৎ, বিভিন্ন বস্তু বিকীর্ণ তাপ শোষণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার তরঙ্গদৈর্ঘ্যকেই শোষণ করে। আবার, বিকিরণের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্টমাত্রার তরঙ্গকেই বিকিরণ করে। যেমন কাচ এমন একটা বস্তু যা অবলোহিত (infrared) তরঙ্গকে শোষণ করে এবং অতিবেগুনি (ultraviolet) রশ্মিকে সঞ্চালিত (transmit) করে, কিন্তু দৃশ্যমান তরঙ্গকে সঞ্চালনে বাধা দেয়। আবার, উদ্ভিদের পাতা ক্ষুদ্রতরঙ্গের রশ্মিকে আবদ্ধ করে এবং অবলোহিত রশ্মিকে বিকিরণ করে। সুতরাং বস্তুর শক্তির শোষণ ও বিকিরণের হার বস্তুর শোষণ ও বিকিরণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
1. বিকিরণ ক্ষমতা (Emissive Power):
নির্দিষ্ট উন্নতায় কোনো বিকিরকের পৃষ্ঠতল একক ক্ষেত্রফলে একক সময়ে যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে এবং ওই একই উয়তায় একই সময়ে ওই আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর একক ক্ষেত্রফল যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে, এই দুয়ের অনুপাতকে ওই তলের বিকিরণ ক্ষমতা বলে। এই ক্ষমতা নির্ভর করে বস্তুর পৃষ্ঠতলের প্রকৃতি, উন্নতা ও নির্গত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর। সুতরাং বস্তুর বিকিরণক্ষমতা (e入) হল-
Pic 4 scroll down for picture 👇
e入= নির্দিষ্ট উন্নতায় বিকিরকের পৃষ্ঠতলে একক ক্ষেত্রফলে একক সময়ে বিকিরিত শক্তির পরিমাণ / ওই উয়তায় একই ক্ষেত্রফলে একই সময়ে আদর্শ কুয়বস্তুর বিকিরিত শক্তির পরিমাণ
2. শোষণ ক্ষমতা (Absorbtive Power):
কোনো বস্তু আপতিত বিকিরণের যে অংশ শোষণ করে তাকে ওই বস্তুর শোষণ ক্ষমতা বলে। এটি আপতিত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং, কোনো বস্তুর শোষণ ক্ষমতা (al) হল-
αλ = শোষিত শক্তির পরিমাণ / আপতিত শক্তির পরিমাণ
একটি আদর্শ কুয়বস্তু (Perfect blackbody) আপতিত বিকিরণের সবটুকুই শোষণ করে নেয়। অতএব এর শোষণ ক্ষমতা a入 = 1
কোনো বস্তুর শোষণ ও বিকিরণ ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্ক কারশ্যফ একটি সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
Pic 5 scroll down for picture 👇
★ কারশ্যফের সূত্র (Kirchhoff's law):
নির্দিষ্ট উয়তায় এবং নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের ক্ষেত্রে সকল বস্তুর বিকিরণ ক্ষমতা এবং শোষণ ক্ষমতার অনুপাত ধ্রুবক হয় এবং এই অনুপাত ওই উন্নতায় ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য আদর্শ কৃয়বস্তুর বিকিরণ ক্ষমতার সমান হয়।সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট উন্নতা ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য কোনো বস্তুর বিকিরণ ক্ষমতা e入. এবং শোষণ ক্ষমতা a入 হলে ওই উন্নতায় ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য একটি আদর্শ কৃয়বস্তুর
বিকিরণ ক্ষমতা কারশ্যফের সূত্রানুযায়ী- Eλ = e入 / αλ বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান ও জলীয় বাষ্প ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের আলোকরশ্মিকে শোষণ ও বিচ্ছুরণ (emit) করে। চিত্র নং 2-10 থেকে বোঝা যায় যে জলীয় বাষ্প (H₂O) এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂) অবলোহিত তরঙ্গের উত্তম শোষক কিন্তু দৃশ্যমান তরঙ্গের শোষণ ক্ষমতা তেমন নেই। অনুরূপে, মাত্রায় কম হলেও নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O), মিথেন (CH₁), ওজোন (O) গ্যাসগুলিও ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী অবলোহিত তরঙ্গের উত্তম শোষক। এসব গ্যাস প্রত্যাবর্তনকারী অবলোহিত তরঙ্গ শোষণ করে গতিশক্তি লাভ করে এবং পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে একটি পরমাণু থেকে অপর পরমাণুতে শক্তি স্থানান্তরিত করে। এভাবে ক্রমান্বয়িক সংঘর্ষে গতিশক্তির বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের উয়তা বাড়তে থাকে। সুতরাং অবলোহিত শক্তির দ্বারা নিম্ন বায়ুমণ্ডল এই পদ্ধতিতে উত্তপ্ত হয়।
Pic 6 scroll down for picture 👇
জলীয় বাষ্প (H,O) ও কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO.) অবলোহিত তরঙ্গের উত্তম শোষকের সঙ্গে সঙ্গে উত্তম প্রেরকও বটে। ফলে এই গ্যাসগুলি অবলোহিত তরঙ্গকে ভূপৃষ্ঠে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়ায় তা পুনরায় ভূপৃষ্ঠ দ্বারা শোষিত হয় এবং পুনরায় ভূপৃষ্ঠ দীর্ঘতরঙ্গের অবলোহিত রশ্মিরূপে প্রেরণ করে যা আবার উক্ত গ্যাসগুলি দ্বারা পুনরায় শোষিত হয়। এভাবে নিরন্তর এই প্রক্রিয়া চলতে থাকায় ট্রপোস্ফিয়ারের নিম্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় উন্নতা বাড়তে থাকে। জলীয় বাষ্প ও CO, কর্তৃক এভাবে অবলোহিত তরঙ্গ শোষিত হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের উয়তা বৃদ্ধিকে গ্রিন হাউস প্রভাব (Green house effect) বলে।
Pic 3 |
Pic 4 |
Pic 2 |
Pic 1 |
Pic 5 |
Pic 6 |