welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

অধঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া (Mechanism of Precipitation):

অধঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া (Mechanism of Precipitation):


অধঃক্ষেপণের জন্য প্রয়োজন জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন। পর্যাপ্ত পরিমাণ জলাকর্মী কণার উপস্থিতিতে বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা 100 শতাংশে পৌঁছলেই জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন শুরু হয় ও মেঘের বিকাশ ঘটে। ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জলকণাগুলি বায়ুতে ভাসমান জলাকর্ষী কণাগুলিকে আশ্রয় করে ঘনীভবন কণায় (Condensation nuclei) পরিণত হয়। এগুলি আদর্শ পরিবেশে জলকণায় (Cloud droplet) পরিণত হয়। এই জলদকণাগুলি আদর্শ পরিবেশে বৃষ্টিবিন্দুতে (Rain drop) পরিণত হয়। তবে ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট যে-কোনো মেঘ থেকেই অধঃক্ষেপণ সংঘটিত হয় না। কারণ জলকণার গড় ব্যাস মাত্র 20 মাইক্রোমিটার (µm), কিন্তু বৃষ্টিবিন্দুগুলির গড় ব্যাস এর চেয়ে 100 গুণ বেশি। আবার, ঘনীভবন কেন্দ্রাণুর আকৃতি যত ছোটো হবে জলকণার বিকাশের হার তত বৃদ্ধি পাবে। অপেক্ষাকৃত 0.1 µm-এর কম ব্যাসার্ধ যুক্ত ঘনীভবন কেন্দ্রাণুই জলকণা সৃষ্টিতে সক্ষম। এগুলি মোটামুটিভাবে 1 কিউবিক মিটার বায়ুতে 100 থেকে 1000-এর মধ্যে থাকে। আবার জলকণাগুলি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছনোর জন্য যথেষ্ট বড়ো হওয়া প্রয়োজন। এক-একটি বৃষ্টিবিন্দুতে যদি 2-5 থেকে 3 কোটি জলকণার উপস্থিত থাকে তবেই সেটি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, 1000 মিটার উচ্চে অবস্থিত কোনো মেঘের ঘনীভবনের ফলে সৃষ্ট কোনো জলকণার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে অন্তত 48 ঘণ্টা সময় লাগে। উপরন্তু অতিসূক্ষ্ম হওয়ার কারণে জলকণাগুলি মাঝপথেই বাষ্পীভূত হয়। সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, কেবলমাত্র ঘনীভবন প্রক্রিয়া এককভাবে জলকণা এবং বৃষ্টিবিন্দু সৃষ্টি করতে পারে না।

জলকণা (cloud droplets)-গুলি কীভাবে বৃষ্টিবিন্দুতে (rain drops) পরিণত হয় এবং অধঃক্ষেপণ ঘটায়, এ নিয়ে একাধিক তত্ত্ব বর্তমান। অধঃক্ষেপণ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তত্ত্বগুলিকে প্রাচীনত্ব ও আধুনিকতার ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) প্রাচীন তত্ত্ব ও (খ) আধুনিক তত্ত্ব।


(ক) প্রাচীন তত্ত্বসমূহ (Classical Theories):

উনবিংশ শতকে এবং বিংশ শতকের প্রথমভাগে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশের পিছনে অনেকগুলি অনুমানভিত্তিক তত্ত্বের উপস্থাপনা করা হয়।


(i) একদল বিজ্ঞানীর মতে, বিপরীত তড়িৎ আধানযুক্ত জলকণা বা মেঘ-জলকণাগুলির পারস্পরিক তড়িৎ আকর্ষণের প্রভাবে সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ ঘটে। কিন্তু এই মতবাদের প্রধান দুর্বলতা হল যে মেঘ-জলকণাগুলির মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেশি হয় যে এদের যুক্ত করার জন্য উভয়ের মধ্যে উল্লিখিত তড়িৎ আকর্ষণ বল পর্যাপ্ত নয়। কারণ এদের আকৃতি এতটাই ক্ষুদ্র হয় যে এদেরকে যুক্ত করার মতো তড়িৎ আকর্ষণ বল খুব একটা থাকে না। তবে এই সমালোচনার উত্তরে বলা হয় যে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন আকৃতির মেঘ-জলকণার উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ কণাগুলির তড়িৎ আকর্ষণ বল বেশি হওয়ায় তা ক্ষুদ্র কণাগুলিকে গ্রাস করে আকৃতিতে বাড়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, মেঘ-জলকণাগুলির ব্যাসার্ধ মোটামুটিভাবে গড়ে 10 থেকে 15 মাইক্রোমিটারের (um) মধ্যেই থাকে এবং মাত্র অল্প কয়েকটি জলকণার ব্যাস 40 µm-এর অধিক হতে পারে।


(ii) অন্য একদল আবহবিজ্ঞানীর মতে, বায়ুমণ্ডলে তীব্র বায়ুস্রোতের উপস্থিতি বিভিন্ন উন্নতার জলকণাকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। এদের মধ্যে একই উয়তায় যেখানে শীতল জলকণা অতিসম্পৃক্ত অবস্থায় থাকে সেখানে উয় জলকণাগুলি সম্পৃক্ত অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না। এই অবস্থায় বাষ্পচাপের পার্থক্যের জন্য সৃষ্ট বাষ্পচাপীয় ঢালের প্রভাবে উন্ন জলকণাগুলি বাষ্পীভূত হলে শীতল জলকণা দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে যুক্ত হয়। এভাবে জলকণার আকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং একসময় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে অধঃক্ষেপণরূপে ভূপতিত হয়।


iii) আর একটি তত্ত্বে বলা হয়, অপেক্ষাকৃত বড়ো ঘনীভবন কেন্দ্রাণুকে কেন্দ্র করে বৃষ্টিবিন্দুগুলি বিকাশ লাভ করে। কারণ এই বৃহৎ ঘনীভবন কেন্দ্রাণুগুলি অতি দ্রুত ঘনীভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ঘনীভবন কেন্দ্রাণুর আয়তন যত বৃদ্ধি পাবে মেঘ-জলকণা বিকাশের হার তত কমে আসবে এবং বৃষ্টিবিন্দু বিকাশ বাধা পাবে।


(খ) আধুনিক তত্ত্বসমূহ (Modern theories) :

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ সংক্রান্ত গবেষণাগুলি আরও যুক্তিসংগত হতে থাকে। নানান পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে বৃষ্টি বিন্দুবিকাশের তত্ত্বকে আরও বিজ্ঞান নির্ভর করা হয়। বিংশ শতকে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশের এই ধরনের যুক্তিনিষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দুটি তত্ত্ব বহুল প্রচলিত। এই তত্ত্ব দুটি হল- 1. বরফকেলাস তত্ত্ব (Ice crystal theory) ও 2. সম্মিলন তত্ত্ব (Coalescence theory)


1. বরফকেলাস তত্ত্ব (Ice crystal theory):

বরফকেলাস তত্ত্বটি (Ice crystal theory) তিনজন কিংবদন্তী আবহবিদ ওয়েগনার (Wegener) বার্জেরন (Bergeron) এবং ফিন্ডিসন (Findeisen)-এর গবেষণার সম্মিলিত ফল। 1911 খ্রিস্টাব্দে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত 'Thermodynamik der Atmosphäre' শীর্ষক প্রতিবেদনে জার্মান আবহবিদ আলফ্রেড ওয়েগনার (Alfred Wegener) সর্বপ্রথম বরফকেলাস (ice crystal) সৃষ্টি হওয়ার পিছনে বরফকেলাস ও অতিসম্পৃক্ত জলকণার (Supercooled water droplet) মধ্যে সম্পৃক্ত বাষ্পচাপের (Saturation vapour pressure) পার্থক্যকে দায়ী করেন।

এর প্রায় 11 বছর পর 1922 খ্রিস্টাব্দে সুইডিশ আবহবিদ টর বার্জেরন (Tor Bergeron) ওয়েগনার বর্ণিত তত্ত্বের ওপর গবেষণা শুরু করেন এবং বাস্তবিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। 1933 খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগালের লিসবন শহরে অনুষ্ঠিত International Union of Geodesy and Geophysics-এর পণ্যম বার্ষিক সম্মেলনে (5th Conference) বার্জেরন যুক্তিনিষ্ঠভাবে তত্ত্বটি উপস্থাপনা করেন। বার্জেরনের এই উপস্থাপনাটি 1935 খ্রিস্টাব্দে 'On the physics of cloud and precipitation' শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। তিনি বরফকেলাস তত্ত্বে ওয়েগনারের সম্পৃক্ত বাষ্পচাপ তত্ত্বটির সঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করেন। তাঁর মতে, হিমাঙ্কের চেয়ে কম তাপমাত্রায় সম্পৃক্ত বায়ুতে জলকণার তুলনায় অল্প পরিমাণে বরফকণা উপস্থিত থাকে।

পরবর্তীকালে 1938 খ্রিস্টাব্দে জার্মান আবহবিদ ওয়াল্টার ফিন্ডিসন (Walter Fiendeisen) তাত্ত্বিক যুক্তি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বার্জেরন প্রদত্ত তত্ত্বটিকে আরো যুক্তিনিষ্ঠ ও বিজ্ঞাননির্ভর করে তোলেন এবং মেটেওর (Meteor) পত্রিকায় "Kolloid - meteorologische Vorgänge bei Neiderschlags- bilding", শীর্ষকে প্রকাশ করেন।

এই কারণেই বরফকেলাস তত্ত্বকে ওয়েগনার বার্জেরন-ফিন্ডিসন (Wegener Bergeron - Find eisen) তত্ত্ব বলেও অভিহিত করা হয়।


পূর্বশর্তসমূহ (Pre-requisites):

1. বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে থাকা প্রয়োজন (sub-freezing atmosphere)

2. বায়ুমণ্ডলে পরিবেশগত তাপবিযুক্ত হার অধিক হওয়া দরকার।

3. বায়ুমণ্ডলে অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট মেঘের বিকাশের আদর্শ পরিবেশ থাকা প্রয়োজন।

4. মেঘের নিম্নতল শিশিরাঙ্ক তাপমাত্রার কাছাকাছি এবং সর্বোচ্চ অংশটি ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থান করা প্রয়োজন। মেঘের নীচের অংশ থেকে শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতার পার্থক্য বেশি হলে অ্যাডিয়াবেটিক পদ্ধতিতে শীতলীকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

5. হিমায়িত ও আংশিক হিমায়িত (freezing and sub-freezing) বায়ুমণ্ডলীয় স্তরের উপস্থিতি একান্ত বাঞ্ছনীয়।


• তত্ত্বের ভিত্তি ও ব্যাখ্যা :  এই তত্ত্ব অনুযায়ী বৃষ্টিবিন্দু বিকাশ লাভ করে বরফকেলাস থেকে। অধিক উচ্চতায় অবস্থিত শীতল মেঘপুঞ্জে হিমাঙ্কের অনেক নীচে-40° সেঃ উন্নতা পর্যন্ত অতিশীতল জলকণার (Supercooled water) উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।


• বরফকেলাস তত্ত্বটি জলের দুটি বিশেষ ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা-


(ক) ০° সেঃ উয়তার নীচে উপস্থিত জলকণাগুলি (cloud droplet) কদাচিৎ বরফকেলাস গঠনে সক্ষম হয়। হিমাঙ্কের নীচে উপস্থিত এই জলকণাকে অতিশীতল জলকণা (super- cooled water droplets) বলে। এমনকি -5° থেকে -10° সেঃ উয়তাতেও 1 মিলিয়ন জলকণার মধ্যে একটি মাত্র বরফকেলাসের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। -20° সেঃ উদ্বুতাতে মাত্র কয়েকটি বরফকেলাস তৈরি হয়। মোটামুটি -40° সেঃ উদ্বৃতাতে মেঘের একবারে মস্তকভাগে যে সমস্ত জলকণা পৌঁছায় তারাই কেবলমাত্র বরফকেলাসে পরিণত হতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে জলকণাগুলি বিশুদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মেঘের এই অঞ্চলকে হিমায়ন অঞ্চল (Glaciated zone) বলে। হিমাঙ্কের নীচে এত কমসংখ্যক বরফকেলাস সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হল বিশুদ্ধ জলের উপস্থিতি এবং জলকণার অতি ক্ষুদ্র আকৃতি। উপরন্তু বায়ুর সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে ঘনীভবনের লীন তাপ সৃষ্টি হওয়ায় তা জলকণাকে আরও উয় করে যা হিমাঙ্ক উয়তায় বৃহৎ আকৃতির জলকণা সৃষ্টিতে বাধা দেয়। জলকণা হোক বা বরফকণা প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি আণবিক বন্ধন থাকে। হিমাঙ্ক উয়তায় যখনই জলকণ। বরফকণায় পরিণত হয় লীনতাপ ত্যাগ করার জন্য বরফকণার মধ্যে তাপীয় আলোড়ন (thermal agita- tion) সৃষ্টি হয়। এই আলোড়ন বরফকণার আণবিক বন্ধনকে শিথিল করে পুনরায় জলকণায় পরিণত করে। ফলে একদিকে হিমাঙ্ক উয়তার নীচে যেমন বরফকণা সৃষ্টি হতে পারে না তেমনি এর আকৃতিও তেমন আয়তনে বাড়তে পারে না। -40° সেঃ উয়তায় পৌঁছে বরফকেলাস সৃষ্টি হতে পারে এবং আকৃতিও বড়ো হতে থাকে। তবে এই ধরনের ঘটনা কেবলমাত্র বিশুদ্ধ জলকণার ক্ষেত্রেই ঘটে। কিন্তু মেঘে যদি প্রচুর জলাকর্ষী কেন্দ্রাণুর উপস্থিতি থাকে তবে হিমাঙ্ক উয়তার সামান্য নীচে -5° সেঃ থেকে -25° সেঃ উন্নতার মধ্যেই বরফকেলাসের সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে জলাকর্ষী কেন্দ্রাণুগুলি যদি কেওলিনাইট খনিজ দ্বারা গঠিত হয়, তবে -9° সেঃ উয়তাতেই বরফকণায় পরিণত হতে পারে। এই সকল বরফকণার উপরিপৃষ্ঠে পাতলা জলীয় আস্তরণের উপস্থিতির কারণে পৃষ্ঠটানের প্রভাবে বরফকণাগুলি (snow-flakes) সংঘবদ্ধ হয় এবং বৃহদাকৃতির বরফকণার সৃষ্টি করে। কিন্তু ঊর্ধ্বাকাশে তীব্র সমান্তরাল বায়ুস্রোতের কারণে এই বৃহদাকৃতির বরফকেলাসগুলির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এগুলি ভেঙে গিয়ে পুনরায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফকণায় পরিণত হয়ে আকাশে ভেসে বেড়ায়। ফলে এই কারণেও অধঃক্ষেপণের জন্য পর্যাপ্ত আকৃতির বরফকেলাস-5° সেঃ থেকে -25° সেঃ-এর মধ্যে বিকাশলাভ করতে পারে না।


(খ) হিমাঙ্কের নীচে একই তাপমাত্রায় বরফকণার বাষ্পচাপের হ্রাসের হার জলকণার পৃষ্ঠতলের তুলনায় অধিক হয়। এর ফলে হিমাঙ্কের নীচে একই তাপমাত্রায় সম্পৃক্ত বাষ্পচাপ (Saturation vapour pressure) বরফের তুলনায় জলপৃষ্ঠের ওপর অধিক হয়। অর্থাৎ, জল বরফের তুলনায় অধিক জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতা রাখে সম্পৃক্ত অবস্থায় একটি বরফকণা ও একটি জলকণা যত ওপরে উঠতে থাকে বরফকণার ওপর জলীয়বাষ্প পতিত হওয়া মাত্রই শোষিত হয়। অন্যদিকে জলকণার পৃষ্ঠে জলীয় বাষ্প পর্যাপ্ত পরিমাণে উপস্থিত থাকে।


 জলপৃষ্ঠ ও বরফপৃষ্ঠে সম্পৃক্ত বাষ্পচাপের পার্থক্য উয়তা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এবং -14° সেঃ উয়তায় এই পার্থক্য সর্বাধিক হয়। সম্পৃক্ত বাষ্পচাপের এই পার্থক্য জলকণা



থেকে বরফকণার দিকে তীব্র চাপীয় ঢালের সৃষ্টি করে। এই পার্থক্য ক্রমশ বাড়তে থাকায় জলকণা থেকে বরফকেলাসের দিকে জলীয় বাষ্পকণাগুলি প্রবাহিত হতে থাকে এবং জলকণার পৃষ্ঠতল থেকে বাষ্পচাপ দ্রুত হারে কমতে থাকে। এভাবে জলকণা থেকে বাষ্পীয় অণুগুলি বিচ্ছিন্ন হতে থাকায় জলকণার আকৃতি ছোটো হতে থাকে এবং বরফকেলাসের ওপর ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation) প্রক্রিয়ায় বরফকণারূপে সঞ্চিত হতে থাকে। এভাবে বাষ্পীয় অবস্থা থেকে কঠিনে রূপান্তরিত হয়ে বরফকেলাসের সাথে যুক্ত হতে থাকায় বরফকেলাসের আকৃতি বাড়তে থাকে।




 এভাবে প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত চলতে থাকায় -40° সেঃ উয়তায় সমস্ত জলকণাগুলি বরফকেলাসে পরিণত হয়ে পড়ে। শীতল মেঘে বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই বরফকেলাসগুলি সৃষ্টি হয়। কোনো কোনৌৎহ্নত্রে সম্পৃক্ত অবস্থায় বরফ কেলাসের ওপর জলীয় বাষ্প সরাসরি সঞ্চিত (deposition) হয়ে বরফকেলীতে পরিণত হয়। একে অবক্ষেপ কেন্দ্রাণু (deposition nuclei) বলে। এতে বাষ্পগুলি তরল অবস্থায় না গিয়ে সরাসরি কঠিন অবস্থায় চলে আসে। আবার, অনেকসময় অতিশীতল জলকণাগুলি বরফকেলাসের সংস্পর্শে এলেই হিমায়িত হয়ে পড়ে। একে হিমন কেন্দ্রাণু (freezing nuclei) বলে। যদি অতিশীতল জলকণাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাহলেও বরফকেলাসে পরিণত হতে পারে। একে সংযোগ কেন্দ্রাণু (Contact Nuclei) বলে।

এভাবে বরফকেলাসগুলি বড়ো হতে হতে যখন অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে আর ভেসে বেড়াতে পারে না, তখনই নিম্নমুখী হয়। নীচে নামার সময় ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর স্রোতের সঙ্গে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ঘর্ষণজনিত কারণে বরফকেলাসগুলি গলে জলকণায় পরিণত হতে থাকে এবং সর্বোপরি হিমতল (freezing level) অতিক্রম করে হিমাঙ্কের অধিক উন্নতায় চলে এলে তা জলে পরিণত হয় ও বৃষ্টিরূপে ভূপতিত হয়।


তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা (Limitations of the theory):

 বরফকেলাস তত্ত্বটি বৃষ্টিবিন্দু বিকাশে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্ব হলেও তত্ত্বটি অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ। এগুলি হল-


(i) বরফকেলাস তত্ত্বে বলা হয়েছে যে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশলাভের জন্য মেঘ অবশ্যই হিমাঙ্ক উন্নতায় পৌঁছাবে। কিন্তু এমন অনেক মেঘ আছে যেগুলি হিমাঙ্ক উচ্চতার উয়তায় না পৌঁছানো সত্ত্বেও বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন-নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রতিদিন যে বৃষ্টিপাত হয় সেখানে মেঘ কদাচিৎ হিমাঙ্ক উন্নতার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।


(ii) পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, বৃষ্টিপাতের জন্য জলকণার হিমায়নের পর্যায়ে উপণীত হওয়ার কোনো আবশ্যিকতা নেই। একাধিক পতনশীল বৃষ্টিবিন্দুর সম্মিলনেও বৃষ্টিপাত হতে পারে।


2. সম্মিলন তত্ত্ব (The Coalescence theory):

বরফকেলাস তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলিকে উল্লেখ করে অস্ট্রেলিয়ান আবহবিদ বোয়েন (E. G. Bowen) 1950 খ্রিস্টাব্দে 'Australian Journal of Scientific Research'-এ প্রকাশিত 'The formation of rain by coalescence' শীর্ষক প্রতিবেদনে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশের সম্মিলন তত্ত্বটি (Coalescence theory)টি প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে জর্জ সিম্পসন ও ম্যাসন (George Simpson and Mason সহ বহু গবেষক ও আবহবিদ তত্ত্বটির পরিমার্জনা করেন।


মূল বক্তব্য:

বোয়েনের মতে, সমস্ত বৃষ্টিবিন্দুর (rain drops) উৎপত্তি বরফকেলাস থেকে হয় না। এমন অনেক মেঘ আছে যেগুলি হিমাঙ্ক উয়তার উচ্চতায় (freezing temperature level) পৌঁছতেই পারে না কিন্তু বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই ধরনের মেঘকে উয় মেঘ (Warm Cloud) বলে। বরফকেলাস থেকে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ নাতিশীতোয় ও হিমমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কিন্তু ক্রান্তীয় বা নিরক্ষীয় অঞ্চলে সংঘটিত বেশির ভাগ বৃষ্টিপাতই উয় মেঘ থেকে হয় যেগুলি কদাচিৎ হিমাঙ্ক উন্নতায় পৌঁছতে পারে। এ ছাড়া শিশিরাঙ্ক তাপমাত্রায় এলেই আপেক্ষিক আর্দ্রতা 100 শতাংশ হওয়ায় জলীয় বাষ্প জলকণায় পরিণত হয়ে ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় মেঘের বিকাশ ঘটে। এর জন্য হিমাঙ্ক তাপমাত্রায় পৌঁছাতে হয় না। ০° সেঃ উন্নতায় পৌঁছানোর অনেক আগেই বায়ু শিশিরাঙ্ক তাপমাত্রায় পৌঁছতে পারে যদি বায়ুমণ্ডলে পর্যাপ্ত পরিমাণ জলীয় বাষ্প ও জলাকর্ষী কেন্দ্রাণুর উপস্থিতি থাকে। এরপর কেবলমাত্র মেঘে জলদকণাগুলির (cloud droplets) সম্মিলনের (Coale cence) মাধ্যমেই বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ ঘটে এবং আকৃতিতে বৃহৎ হয়ে পড়লে অধঃক্ষেপণরূপে ভূপতিত হয়। তবে এই ধরনের অধঃক্ষেপণে শিলাবৃষ্টি বা তুষারপাত ঘটে না।


• পূর্বশর্তসমূহ (Pre-requisites)

সম্মিলনের মাধ্যমে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশের জন্য বোয়েন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল-


1. মেঘের শীর্ষ কদাচিৎ-15° সেঃ উন্নতায় পৌঁছায় এবং মেঘের বেশির ভাগ অংশই হিমাঙ্ক উদ্বুতার ওপরে থাকে। এই ধরনের মেঘকে উদ্বু মেঘ (warm cloud) বলে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটায় এমন মেঘেরই শীর্ষদেশের উন্নতা 7° সেঃ উদ্বুতা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ফলে বরফকেলাস বিকাশের কোনো সুযোগই থাকে না।


2. মেঘে বিভিন্ন ব্যাসের জলকণার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়। জলকণার ব্যাস যত বড়ো হবে তার নিম্নমুখী গতিবেগ (fall velocity) তত বেশি হবে। জলকণার নিম্নমুখী গতিবেগ বলতে বোঝায় একক সময় (৫) জলকণাটি Ah যতটা উচ্চতা (h) অতিক্রম করে নেমে আসে। অর্থাৎ, জলকণায় নিম্নমুখী গতিবেগ হল∆h/∆t। জলকণার এই নিম্নমুখী গতিবেগ নির্ভর করে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর ঘর্ষণজনিত বাধা (up draught velocity) এবং অন্তিম গতিবেগ (Terminal Velocity)-এর ওপর। বৃষ্টিবিন্দুর ওপর যখন বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী ঘর্ষণজনিত বাধা এবং অভিকর্ষজ বলের মধ্যে ভারসাম্য অবস্থা আসে তখন একটি নির্দিষ্ট বেগে বিন্দুটি পতিত হয়। একেই অন্তিম গতিবেগ বলে। আবার, ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর ঘর্ষণজনিত বাধা 'V' এবং অন্তিম বেগকে 'U' দ্বারা প্রকাশ করা হলে Ah পতিত জলকণার নিম্নমুখী গতিবেগ (fall velocity) হবে∆h/∆t= V-U। অর্থাৎ, অন্তিম বেগ যত বৃদ্ধি পাবে বৃষ্টিবিন্দুর নিম্নমুখী গতিবেগ তত বাড়বে। 

ল্যাংমুয়ের (Langmuir)-এর মত অনুযায়ী জলকণার ব্যাস যত বেশি হয় তার অন্তিম বেগও তত বাড়ে। তাই মেঘে বিভিন্ন আকৃতির জলকণা উপস্থিত থাকলে সেগুলির অন্তিম বেগ ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই নীচের দিকে নামার সময় বড়ো আকৃতির জলকণাগুলি অপেক্ষাকৃত ছোটো আকৃতির জলকণাগুলিকে অতিক্রম করে এবং পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে (Collision) লিপ্ত হয়। এভাবে জলকণাগুলি সংঘর্ষের দ্বারা সম্মিলিত হয়ে আরও বড়ো আকার ধারণ করে। তবে সম্মিলনের জন্য জলকণার ব্যাস 19µm-এর বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। যদি সমস্ত জলকণাগুলির ব্যাস সমান হয় তাহলে প্রত্যেকের অন্তিম বেগও সমান হয়। এই অবস্থাকে কলয়েডীয় স্থিতিশীলতা (Colloidal stability) বলে। এই অবস্থায় জলকণাগুলি কোনো ভাবেই সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারত না এবং সম্মিলন না হওয়ায় বড়ো আকৃতির জলকণাও সৃষ্টি হত না। ফলে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হত।


3. কেবলমাত্র বিভিন্ন আকৃতির জলকণার সংঘর্ষের ফলেই সম্মিলন ঘটে না। এর জন্য প্রয়োজন তীব্র বিপরীত তড়িতীয় আকর্ষণ বল (Opposite electrical charges)। বেনার্দ ভনগাট এবং চার্লস বি. মূর (Bernard Vonnegut and Charles B. Moore) বৃষ্টিবিন্দুর সম্মিলনের পিছনে মেঘের মধ্যে বিপরীত তড়িৎ আকর্ষণ বলের প্রভাব নিয়ে নানাভাবে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বৃষ্টিবিন্দুগুলির বিপরীত তড়িৎ আধানের পৃষ্ঠদেশ পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে তবেই এগুলি জুড়ে গিয়ে বৃহৎ আকৃতির জলকণা তৈরি করে। সমতড়িৎ আধানপৃষ্ঠের মধ্যে সংঘর্ষ হলে বিন্দুগুলি বিকর্ষণের কারণে একে অপরের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় এবং কখনোই সংযুক্ত হয় না।


4. সাধারণত মাঝারি থেকে স্বল্প ঘনত্ব বিশিষ্ট পাতলা স্ট্যাটাস মেঘ (মোটামুটি 500 মিটারের বেশি) থেকেই সম্মিলনের মাধ্যমে বৃষ্টি সংঘটিত হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলের বৃষ্টিপাত ঘটানো কিউমুলাস মেঘগুলি 2400 মিটার উঁচু হয়। ফিন্ডিসনকে অনুসরণ করে বোয়েন উল্লেখ করেন যে, কেবলমাত্র বৃহৎ আকৃতির বৃষ্টিবিন্দুগুলি বরফকেলাস থেকে সৃষ্টি হয় বলে অধিক ঘন ও গভীরতাযুক্ত শীতল মেঘের বিকাশ প্রয়োজন। কিন্তু মাঝারি থেকে ছোটো বৃষ্টিবিন্দুগুলি বরফকেলাস ছাড়াই সৃষ্টি হয়। এরজন্য কম ঘনত্বযুক্ত অগভীর মেঘই যথেষ্ট। বড়ো বিন্দুর তুলনায় এই ছোটো ছোটো বিন্দুগুলিই সম্মিলনে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করে।


5. সম্মিলনের মাধ্যমে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ হতে গেলে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর গতি প্রতি সেকেন্ডে 1 মিটারের মধ্যে থাকলে আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলের কিউমুলাস মেঘের পরিচলন কোশগুলির ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর সঞ্চলন সাধারণত 1 মিটার/সেকেন্ডের মধ্যেই থাকে। বোয়েন একটি গ্রাফের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। চিত্র: 1.1 a অনুযায়ী, 20 µm ব্যাসের একটি জলকণা মেঘের নিম্নতল (base of the cloud) থেকে 1 মিটার/সেকেন্ড গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হলে 45 মিনিট পর মোটামুটি 2200 মিটার উচ্চতায় ছোটো ছোটো জলকণার সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে সম্মিলিত হয়ে মোটামুটি 200 µm ব্যাসে এসে পৌঁছায়  অবস্থায় ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর সঙ্গে অভিকর্ষজ বলের ভারসাম্য আসায় জলকণাটি সাময়িকভাবে স্থিতিশীল হয়। অর্থাৎ, VU = 0 হয়। এই অবস্থায় অন্তিম বেগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলকণাটি অন্যান্য জলকণার সঙ্গে সংঘর্ষ ও সম্মিলনের মাধ্যমে আকৃতিতে বাড়তে বাড়তে 17 মিনিট পর ভূপতিত হয় (চিত্র: 13.8a) এবং এর সর্বশেষ ব্যাস হয়ে দাঁড়ায় 1500 µm (চিত্র: 13.8b)। এই ঊর্ধ্বমুখী বায়ুস্রোত যত মন্থর হবে ততই বৃষ্টিবিন্দুর আকৃতি বড়ো হবে।


6. ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর সঙ্গে জলকণার আকৃতিও নির্ধারণ করে কত দ্রুত তা বৃষ্টি হিসেবে মাটি স্পর্শ করবে। রিয়েল (Riehl)-এর মতে, একটি 500 µm ব্যাসের জলকণা বৃষ্টিবিন্দু হিসেবে পতিত হতে সময় নেয় 10 মিনিট। সেখানে 70 µm ব্যাসের কণা সময় নেয় 50 ঘণ্টা, যার ব্যাস যত বড়ো হবে সে তত সংঘর্ষের মাধ্যমে ছোটো ছোটো জলকণাগুলিকে গ্রাস করে বৃহৎ আকৃতি ধারণ করবে। জলকণার ব্যাস 500 µm-এর কম হলে ঝিরঝিরে বৃষ্টি এবং বেশি হলে বৃষ্টিপাতরূপে পতিত হয়।


• তত্ত্বের ব্যাখ্যা:


(i) এই তত্ত্ব অনুযায়ী উয় প্রকৃতির মেঘে বায়ু খুব দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দ্রুত সম্পৃক্ত ও শীতলীভূত হয়। ফলে জলীয় বাষ্পের দ্রুত ঘনীভবন ঘটে জলকণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই জলকণাগুলির আকৃতি এতটাই ছোটো হয় যে তা বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং ঊর্ধ্বমুখী বায়ুস্রোত (Updraft air) দ্বারা উপরে উঠতে থাকে।


(ii) এইভাবে আরও উপরের দিকে উঠতে থাকায় ঘনীভবনের দ্বারা আরও জলকণা তৈরি হতে থাকে এবং জলকণাগুলি একে অপরের সাথে সম্মিলনের ফলে জলকণার আকৃতি তথা ব্যাস বাড়তে থাকে।


(iii) এভাবে ক্রমশ আকৃতিতে বড়ো হতে হতে জলকণার ব্যাস এমন একটি সঙ্কটমাত্রায় পৌঁছায় যে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুস্রোত জলকণাকে আর ওপরের দিকে তুলতে পারে না। অর্থাৎ, VU = 0 হয়। এই অবস্থায় জলকণার ব্যাস পৌঁছায় গড়ে 1000 µm-এ।


(iv) এই অবস্থায় অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে জলকণা নীচের দিকে নামতে শুরু করে। নিম্নমুখী হওয়ার সময় অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকৃতির কণাগুলির অন্তিম বেগ বেশি হওয়ায় ক্ষুদ্রাকৃতির কণাগুলিকে অতিক্রম করে এবং পারস্পরিক সংঘর্ষের দ্বারা সম্মিলিত হয়ে আয়তনে বাড়তে থাকে। এভাবে আয়তনে বাড়তে বাড়তে জলকণাগুলির ব্যাস কখনো কখনো 5000 µm পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।


(v) বৃহৎ আকৃতির এই জলকণাগুলি দ্রুতবেগে যখন নামতে থাকে তখন অস্থিতিশীল (unstable) হয়ে পড়ে। ফলে জলকণাগুলি ছোটো ছোটো আকৃতিতে বিভাজিত হয়ে পড়ে। এভাবে 0.5 মিলিমিটারের অধিক ব্যাসযুক্ত জলকণা বৃষ্টিরূপে ভূপতিত হয় এবং 0.5 মিলিমিটারের কম ব্যাস নিয়ে পতিত জলবিন্দুগুলি ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামে অভিহিত হয়। চিত্র: 13.9-এ সংঘর্ষ ও সম্মিলন দ্বারা উয় মেঘে বৃষ্টিবিন্দু বিকাশের প্রক্রিয়াটি তুলে ধরা হল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঘনীভবন প্রক্রিয়া এককভাবে বৃষ্টিবিন্দুর বিকাশ ঘটাতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন জলকণার সম্মিলন। চিত্র : 13.10 পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়।


তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা (Limitations of the theory): সম্মিলন তত্ত্বটি বরফকেলাস তত্ত্বের ন্যায় যুক্তিপূর্ণ হলেও তত্ত্বটির বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। এগুলি হল-


(i) বড়ো আকৃতির জলকণার ভর ছোটো আকৃতির জলকণার তুলনায় অধিক হওয়ায় তাদের নিম্নমুখী গতিবেগ স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে। তাই খুব সহজেই বড়ো জলকণাগুলি ভূপতিত হয়ে যাওয়ায় ছোটো জলকণার সাথে সম্মিলনের সুযোগ অনেক কমই পাবে।


(ii) দুটি বিপরীত তড়িৎ আধানপৃষ্ঠ মুক্ত জলকণার পৃষ্ঠ কাছাকাছি এলেই সম্মিলন ঘটবে, এটি এত সরল ব্যাপার নয়। কারণ দুটি জলকণার নিম্নমুখী ত্বরণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে সম্মিলনের পরিবর্তে একে অপরের পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এক্ষেত্রে ল্যাবরেটরিতে বারে বারে পরীক্ষা করে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সম্মিলনের কোনো সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।


(iii) দুটি জলকণার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটলে জলকণার আকৃতি বিকৃত হয়। এই অবস্থায় দুটি জলকণার সম্মিলনের সম্ভাবনা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01