জেট বায়ুপ্রবাহের উৎপত্তির কারণ (Machanism of Jet stream):
জেট বায়ুর উৎপত্তি, তীব্র গতিবেগ, জীবনচক্র ইত্যাদি সকল বিষয় নিয়ে আবহবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রকারের জেট প্রবাহগুলির অবস্থান লক্ষ করে এবং ওই অঞ্চলগুলির আবহাওয়াগত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জেট বায়ুগুলির উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়।
1. মেরুবৃত্তপ্রদেশীয় অঞ্চলে আড়াআড়িভাবে অনুভূমিক দূরত্বে অতিরিক্ত উন্নতা ও বায়ুর চাপের পার্থক্য তৈরি হওয়ায় মেরু সীমান্ত জেট প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এই জেট প্রবাহটি সাধারণত মেরুসীমান্তের ঠিক ওপর দিয়েই পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আসা উয়-পশ্চিমা বায়ু এবং মেরু অঞ্চল থেকে আসা শীতল মেরু বায়ু এই মেরুবৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ে এসে মেরু সীমান্তের সৃষ্টি করে। দুই ভিন্ন উন্নতা ও ঘনত্বের বায়ু এই সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থান করায় মেরু সীমান্তে তাপমাত্রার বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়।চিত্র:1-এ মেবুসীমান্তবর্তী অঞ্চলের বায়ুমন্ডলের একটি ত্রিমাত্রিক ছবি তুলে ধরা হল। এই ছবি থেকে স্পষ্টত লক্ষ করা যায় যে-20°C-এর সমোয়রেখাটি মেরুসীমান্তকে অত্যন্ত খাড়া ঢালে অতিক্রম করে। এভাবে তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তনে মেরু সীমান্তে বায়ুচাপেরও দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। তাই এই চিত্রটিতে 500 মিলিবারের সমচাপ তলটি (Isobaric surface) সীমান্তকে অতিক্রম করার সময় সামান্য ঢালু হয়ে যায়। সুতরাং, সীমান্ত সৃষ্টির ফলে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে হঠাৎ বায়ুর চাপের অধিক পার্থক্য তৈরি হওয়ায় খুবই খাড়া বায়ুচাপীয় ঢালের সৃষ্টি করে, যার প্রভাবে তীব্র গতিসম্পন্ন মেরু জেট বায়ুর সৃষ্টি হয়। আবার, ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে প্রায় 7 কিমি উচ্চতায় এই বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায় বলে ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বাধা (frictional force) অনুপস্থিত থাকায় বায়ু জিওস্ট্রফিক ভারসাম্য বজায় রেখে সমচাপরেখার সমান্তরালে বাধাহীনভাবে প্রবাহিত হয়।
চিত্র -1 |
2. উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহটি প্রায় 12 কিমি উচ্চতায় 200 মিলিবার সমচাপ তলের ওপর হ্যাডলি চক্রের শেষে সক্রিয়ভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। মূলত হ্যাডলি চক্রের মাধ্যমে নিরক্ষীয় অঞ্চলের উন্ন বায়ু বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তর দিয়ে মেরুমুখী হওয়ায় উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এসে পৌছায়। ফলে এই অঞ্চলে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে খাড়া তাপীয় ঢালের সঙ্গে সমতা রেখে খাড়া বায়ুচাপীয় ঢালের সৃষ্টি করে। এর ফলেই উপক্রান্তীয় অঞ্চলে জেট বায়ু প্রবাহিত হয়।
উপক্রান্তীয় জেট বায়ুর খাড়া বায়ুচাপ ঢাল ছাড়াও আরও একটি শক্তি এই জেট বায়ুর গতিবৃদ্ধি করে এবং পশ্চিম থেকে পূর্ব অভিমুখে চালনা করে। এই শক্তিটি হল পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট কৌণিক ভরবেগ (Angular Momentum)। এই কৌণিক ভরবেগের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে উপক্রান্তীয় বায়ুর ওপর। কারণ এই জেট বায়ু উৎপত্তির পিছনে উপক্রান্তীয় অঞ্চলে যে বায়ুচাপীয় ঢালের উল্লেখ করা হয়েছে তা এই বায়ুটির গতিবৃদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট নয়। কৌণিক ভরবেগ হল বস্তুর ভর (m), গতিবেগ (v) এবং গতিশীল বস্তুর ঘূর্ণায়মান অক্ষ থেকে বস্তুর দূরত্বের (r) গুণফল। অর্থাৎ, কৌণিক ভরবেগের সূত্রটি হল mvr। নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে জানা যায় যে, বাইরে থেকে কোনো বল প্রযুক্ত না হলে কৌণিক ভরবেগের কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ, কৌণিক ভরবেগের পরিমাণ সর্বদাই স্থির থাকে। তাই কোনো অঞ্চলে নির্ণীত কৌণিক ভরবেগ (mvr) অবশ্যই গণনাকৃত 'mvr'-এর সমান হবে। একখণ্ড বায়ুর ওপর পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সৃষ্ট কৌণিক ভরবেগের প্রভাব থাকায় উত্তর গোলার্ধে বায়ুর পূর্বাভিমুখে বিক্ষেপণ ঘটে। একটি শান্ত দিনে নিরক্ষীয় অঞ্চলে একখণ্ড উন্নবায়ু ওপরে উঠে ট্রপোপজের কাছাকাছি এসে প্রত্যয়নবায়ুরূপে মেরু অভিমুখে বিক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু যতই মেরু অভিমুখী হতে থাকে ততই পৃথিবীর অক্ষ থেকে দূরত্ব (1) কমতে থাকায় কৌণিক ভরবেগ কমে যাওয়ার কথা কিন্তু যেহেতু কৌণিক ভরবেগের নীট ফল একই হতে হয় তাই কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। যেহেতু বস্তুর ভর (m) সর্বদাই স্থির থাকে তাই কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের জন্য বায়ুর গতিবেগ (v) বৃদ্ধি পায়। আবার, ওপরের স্তরে বায়ুপ্রবাহের ক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠে ঘর্ষণজনিত বাধা অনুপস্থিত থাকায় কোরিওলিস বলের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বায়ুপ্রবাহের ওপর কাজ করে। কোরিওলিস বল আবার বায়ুর গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক। এই বল আবার বায়ুপ্রবাহের সমকোণে কাজ করে। তাই ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে উত্তরমুখী বায়ুচাপ ঢালের বিপরীতে কোরিওলিস বল কাজ করায় প্রত্যয়ন বায়ু জিওস্ট্রফিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ক্রমশ পূর্বাভিমুখী হয়ে পড়ে এবং কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ হেতু তীব্র গতিবেগ লাভ করে। এভাবে উপক্রান্তীয় অঞ্চলে এসে সম্পূর্ণ পূর্বাভিমুখী উচ্চগতিসম্পন্ন বায়ুপ্রবাহে পরিণত হয়, যা উপক্রান্তীয় পশ্চিমি জেট বায়ুর সৃষ্টি করে।