অক্ষরেখা বরাবর সঞ্চলন চক্র বা ওয়াকার চক্র (Latitudinal Circulation Model or Walker Circulation) ):
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দ্রাঘিমারেখা বরাবর যেমন হ্যাডলি, ফেরেল ও মেরু বায়ুর সঞ্চলন কোশ দেখা যায়, ঠিক তেমনভাবেই অক্ষরেখা বরাবর বিশেষত নিরক্ষরেখা বরাবরও কিছু বায়ুসঞ্চলন কোশের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। 1920-এর দশকে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও আবহবিদ স্যার গিলবার্ট থমাস ওয়াকার (Sir Gilbert Thomas Walker) ভারতীয় পর্যবেক্ষণশালার সঞ্চালক (Director of Indian Observetories) হিসেবে কাজ করার সময় মৌসুমি বায়ুর অনিশ্চয়তা সম্পর্কিত গবেষণায় তিনি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অক্ষরেখা বরাবর একটি পুবালি বায়ুর পৃষ্ঠপ্রবাহ সমন্বিত সঞ্চলন চক্রের উপস্থিতি লক্ষ করেন। এ ছাড়াও অক্ষরেখা বরাবর এ রকম আরও কয়েকটি পরিচলন কোশের অস্তিত্বের কথা তিনি উল্লেখ করেন। তাই আবিষ্কর্তা ওয়াকারের নামানুসারে অক্ষরেখা বরাবর এই সঞ্চলন কোশগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ওয়াকার সঞ্চলন চক্র (Walker Circulation)।
★ ওয়াকার সঞ্চলন চক্রের উৎপত্তি: ওয়াকার সঞ্চলন চক্রের উৎপত্তির পিছনে যে সকল নিয়ন্ত্রক রয়েছে তা হল-
(a) জলভাগ ও স্থলভাগের অসম বণ্টন:
আবহবিদ ওয়াকারের মতে, ক্রান্তীয় অঞ্চলে জলভাগ ও স্থলভাগের অসম বণ্টন ও উন্নতার বৈষম্যমূলক আচরণ অক্ষরেখা বরাবর বায়ুসঞ্চলন চক্র সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্থলভাগে নিম্নচাপ ও জলভাগের ওপর উচ্চচাপ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এই ধরনের চাপের পার্থক্যের জন্য বায়ু উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে অনুভূমিকভাবে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। নিম্নচাপ অঞ্চলের বায়ু উদ্বু ও আর্দ্র হয়ে ওপরের দিকে উঠে ক্রমশ শীতল ও ঘনীভূত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। ঘনীভবনের ফলে উৎপন্ন লীনতাপ জলীয় বাষ্পশূন্য বায়ুকে উন্ন ও শুষ্ক করে পূর্ব ও পশ্চিমে পৃষ্ঠপ্রবাহের বিপরীত দিকে চালিত করে। এই শুষ্ক বায়ু ক্রমাগত শীতল ও ভারী হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকায় উচ্চচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি করে এবং পুনরায় পৃষ্ঠপ্রবাহ রূপে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। এভাবে অক্ষরেখা বরাবর ভূপৃষ্ঠীয় এবং ঊর্ধ্বস্তরীয় বায়ুমণ্ডলীয় অংশে নিরবচ্ছিন্ন বায়ুপ্রবাহ বায়ু সঞ্চলন কোশকে সচল রাখে।
(b) সমুদ্রস্রোত:
ওয়াকার সঞ্চলন কোশগুলি আবার সমুদ্রস্রোত দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সাধারণত শীতল সমুদ্রস্রোত দ্বারা প্রভাবিত জলভাগে উচ্চচাপ কক্ষ তৈরি হয়। কিন্তু এমন কিছু অঞ্চল রয়েছে যেখানে কয়েকবছর অন্তর বা বছরের কিছু সময়ের জন্য শীতল স্রোতের পরিবর্তে উন্নস্রোত প্রবাহিত হয়। সেই সময় উন্নতা বৃদ্ধির জন্য আচমকাই উচ্চচাপ কক্ষটি দুর্বল উচ্চচাপ বা নিম্নচাপ কক্ষে পরিণত হয়। ফলে ওয়াকার সঞ্চলন কোশটির স্বাভাবিক বায়ু সঞ্চলন চক্র ব্যাহত হয়। এই ধরনের স্রোতের পরিবর্তন ঘটে জলপ্রবাহের বণ্টনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার জন্য। আমরা জানি, সমুদ্রস্রোত অনুভূমিকভাবে জলরাশিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যায়। ফলে যে স্থান থেকে জলরাশি নিষ্কাশিত হয় সেখানকার জলতলের উচ্চতা হ্রাস পায়। আবার, যে অঞ্চলে জলরাশি এসে জমা হয় সেখানকার উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। তাই সমোচ্চশীলতা ধর্মকে বজায় রাখার জন্য অনেকসময় প্রতিস্রোতরূপে জল পুনরায় ঘাটতি অঞ্চলের দিকে ফিরে আসে। এই ধরনের ঘটনায় যদি উয় জলরাশি প্রতিস্রোতরূপে ফিরে আসে তাহলে সেই উন্নস্রোতটি শীতল স্রোতকে সাময়িক সময়ের জন্য প্রতিস্থাপিত করে এবং ওই অঞ্চলে নিম্নচাপ কক্ষের সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ বায়ুচাপের তারতম্যের জন্য সঞ্চলন চক্রটি ব্যাহত হয়। El-nino হল এমন একটি উয় সমুদ্রস্রোত যা কর্ণওয়াল বা নিরক্ষীয় প্রতিস্রোতরূপে ক্রান্তীয় অঞ্চলের উয় জলপুঞ্জকে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু উপকূলের দিকে নিয়ে আসে যা ওই অঞ্চলে প্রবাহিত শীতল হামবোল্ড স্রোতকে প্রতিস্থাপিত করে। স্বাভাবিক অবস্থায় পেরু উপকূল থেকে শীতল হামবোল্ড স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় পেরু উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ কক্ষ বিরাজ করে। এই কক্ষ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু অস্ট্রেলিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপ কক্ষের দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলে বায়ু শীতল জলপুঞ্জকে ওই নিম্নচাপ বলয়ের দিকে নিয়ে আসে এবং জলরাশি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়। এই অবস্থায় ইন্দোনেশিয়া উপকূলে জলতলের উচ্চতা বাড়লে ওই উয় জলপুঞ্জ নিরক্ষীয় প্রতিস্রোত বা কর্ণওয়াল স্রোতরূপে পেরু উপকূলের দিকে ফিরে আসে এবং শীতল হামবোল্ড স্রোতের পরিবর্তে উয় এল-নিনো স্রোত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পেরু উপকূলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। উয় স্রোতের উপস্থিতির জন্য উচ্চচাপ কক্ষটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর ওয়াকার চক্রটি দুর্বল এবং ইন্দো-অস্ট্রেলিয় উপকূল থেকে পেরু উপকূলের দিকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে ভূপৃষ্ঠে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই ঘটনাকেই ওয়াকার এল-নিনো দক্ষিণী দোলন (El-nino South- ern Oscillation) বলে অভিহিত করেছেন।
সমুদ্রস্রোতের এই ধরনের পরিবর্তন হেতু ওয়াকার সঞ্চলন চক্রে দুটি পর্যায় লক্ষ করা যায়। যেমন-
1. সক্রিয় পর্যায় (High phase) :
এটি ওয়াকার চক্রের সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থা। এই পর্যায়ে অক্ষরেখা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে 6টি বায়ুসঞ্চলন কোশ লক্ষ করা যায়। আমাজন, মধ্যআফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা এবং ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয় এবং এই অঞ্চলগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর, পশ্চিম ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ তৈরি হতে দেখা যায়। ফলে এই অঞ্চলগুলিতে নিম্নমুখী শীতল বায়ুর প্রভাবে সর্বদা শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। এই সময় প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর আয়ন বায়ুপ্রবাহ প্রবল হয় এবং উভয় গোলার্ধে উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহ ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিস্থিত হ্যাডলি সঞ্চলন কোশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতে মৌসুমি টাফ্ সক্রিয় হয় ও প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
2. নিষ্ক্রিয় পর্যায় (Low phase):
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উয় জলপুঞ্জ প্রতিস্রোতরূপে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু উপকূলের দিকে চলে আসায় বায়ুর চাপীয় অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ফলে এই অবস্থায় পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত 6টি কোশ 4টি সঞ্চলন কোশে পরিণত হয়। দক্ষিণ আটলান্টিক, পশ্চিম ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলে উন্ন জলপুঞ্জের প্রভাবে উচ্চচাপ কক্ষগুলি নিম্নচাপ কক্ষে পরিণত হয়, ফলে উন্ন ও আর্দ্র বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে আমাজন, কঙ্গো অববাহিকা, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল এবং মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত নিম্নচাপ দুর্বল হয়ে পড়ে। উপরন্তু এই অঞ্চলে শীতল ও শুষ্ক বায়ুর অবতরণের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়। ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরার প্রাদুর্ভাব ঘটে। উভয় গোলার্ধে উপক্রান্তীয় জেট বায়ু ও প্রশান্ত মহাসাগরস্থিত
হ্যাডলি সঞ্চলন কোশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষে মৌসুমি টাফ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ঘাটতি দেখা যায়। পেরু উপকূলে শীতল হামবোল্ড স্রোতের পরিবর্তে উয় এল-নিনো স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় উপকূলের উষ্ণতা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়।
ওয়াকার সঞ্চালন চক্র |