জেট বায়ুতত্ত্ব (Jet stream theory) :
নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টি সংক্রান্ত মেরু সীমান্ত তত্ত্বে ঘূর্ণবাত উৎপত্তি থেকে অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে বার্কনেস যে মতামতগুলি দেন তা অনেকটাই সরলীকৃত এবং অনুমানভিত্তিক। একটি ঘূর্ণবাতকে শক্তিশালী হতে গেলে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গোলযোগের উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু ঘূর্ণবাতের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কেবলমাত্র উয় বায়ুতে অবস্থিত স্থৈতিক শক্তির গতিশক্তিতে রূপান্তর যথেষ্ট নয়। এর জন্য বাহ্যিক শক্তিরও প্রয়োজন। পরবর্তীকালে জেট বায়ুর আবিষ্কার, আবহবিদ্যায় নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের কারণে আবহাওয়া সম্পর্কিত আরও নতুন ও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ সম্ভবপর হওয়ায় ঘূর্ণবাতের বিকাশের কারণ সম্পর্কিত কিছু নতুন তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে মেরু সীমান্তের ওপর প্রবাহিত মেরু জেটের (Polar Jet) অভিসরণ (Convergence) ও বিক্ষেপণ (divergence)-এর ফলে তৈরি হওয়া উল্লম্ব বায়ুস্রোত (vertical wind shere) ঘূর্ণবাতকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রকে প্রলম্বিত করে।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে যে সকল তথ্য পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, যেসব অঞ্চলে মেরু সীমান্তের সৃষ্টি হয় সেখানে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে প্রবল শক্তিশালী মেরু সীমান্তীয় জেট বায়ু প্রবাহিত হয়। সুতরাং এটা খুবই স্পষ্ট যে, নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বিকাশে জেট বায়ু কোনো-না-কোনোভাবে সক্রিয় প্রভাব ফেলে। এই জেট বায়ু ঘূর্ণবাতের শক্তিবৃদ্ধিতে কীভাবে সাহায্য করে, তা আলোচনা করা হল-
★ জেট বায়ুর ফলে ঘূর্ণবাতের শক্তিবৃদ্ধি:
বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে উভয় গোলার্ধের মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে জেট বায়ু পশ্চিম থেকে পূর্বে সারা পৃথিবীকে তরঙ্গের আকারে বেষ্টন করে রয়েছে। এই তরঙ্গগুলি একাধিক নিম্নচাপীয় দ্রোণী (trough) এবং উচ্চচাপীয় অক্ষ (ridge) সমন্বিত। দুটি সন্নিহিত নিম্নচাপীয় দ্রোণী বা উচ্চচাপীয় অক্ষ-এর মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে। সাধারণত দুটি সন্নিহিত নিম্নচাপীয় দ্রোণী বা উচ্চচাপীয় অক্ষ-এর মধ্যবর্তী দূরত্ব কয়েকহাজার কিলোমিটার হওয়ায় এই জেট বায়ুর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃহৎ হয়। তাই একে দীর্ঘ তরঙ্গের জেটও বলে। সারা পৃথিবীব্যাপী এরকম ও থেকে 6টি দীর্ঘ তরঙ্গ জেট বায়ু প্রবাহিত হয়। আবহবিদ রসবি (Rossby) এই দীর্ঘ তরঙ্গবিশিষ্ট জেট বায়ুর অস্তিত্ব প্রথম জনসমক্ষে আনেন। তাই আবিষ্কর্তার নাম অনুসারে একে রসবি তরঙ্গও বলে। রসবি লক্ষ করেন, মাঝেমধ্যে ভূপৃষ্ঠীয় অংশে বায়ুমণ্ডলীয় গোলযোগ সৃষ্টি হলে তার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে প্রবাহিত এই দীর্ঘ তরঙ্গের জেট বায়ুপ্রবাহের মধ্যে ছোটো ছোটো তরঙ্গ প্রবাহের (short waves) সৃষ্টি হয়। এই ক্ষুদ্র তরঙ্গের দ্বারা সৃষ্ট নিম্নচাপীয় দ্রোণীগুলিতে সমচাপরেখাগুলি খুব কাছাকাছি সন্নিবেশের কারণে জেট বায়ু জিওস্ট্রফিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য গতি বাড়িয়ে দেয়। এভাবে নিম্নচাপীয় দ্রোণীগুলি আরও গভীর হলে সমচাপরেখাগুলি নিম্নচাপীয় দ্রোণী বরাবর দীর্ঘ অধোভঙ্গের সৃষ্টি করে। ফলে এই অধোভঙ্গের মধ্য দিয়ে জিওস্ট্রফিক বায়ুর গতিবেগ আরও বাড়তে থাকে। এই অধোভঙ্গীয় নিম্নচাপীয় দ্রোণীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তীব্র গতিসম্পন্ন জেট বায়ুকে অন্তঃস্থলের বেগসম্পন্ন জেট বায়ু (Jet stream core) বা বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন জেট বায়ু (Jet streak) বলে। এই বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন জেট বায়ু (Jet streak) প্রভাবিত অধোভঙ্গে সমচাপরেখাগুলি খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। কিন্তু এই অধোভঙ্গের দুই প্রান্তের দিকে সমচাপরেখাগুলির মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ফলস্বরূপ উক্ত দুই প্রান্তের দিকে বায়ুপ্রবাহের অভিসরণ (Convergence) এবং বিক্ষেপণ বা প্রসারণ (divergence) লক্ষ করা যায়। অধোভঙ্গের শুরুর প্রান্তে সমচাপরেখার মধ্যবর্তী দূরত্ব কমতে থাকায় দ্রুতগামী জেট বায়ুর (Jet streak) অতি শক্তিশালী অভিসরণ ঘটে (strong convergence)। অন্যদিকে অধোভঙ্গের শেষপ্রান্তে সমচাপরেখার মধ্যবর্তী দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকায় দ্রুতগামী জেট বায়ুর প্রসারণ বা বিক্ষেপণ (strong divergent) হতে থাকে।
দীর্ঘ তরঙ্গের জেট বায়ুপ্রবাহ |
দীর্ঘ তরঙ্গের জেট বায়ুপ্রবাহের মধ্যে ছোট ছোট তরঙ্গ প্রবাহের সৃষ্টি |
বেরোক্লিনিক অবস্থায় জেট বায়ুর সম্মেলন ও বিক্ষেপণ অঞ্চলের শীতল ও উষ্ণ বায়ু স্রোত সৃষ্টি |
(Warm advection) ঘটে। ফলে কেন্দ্র থেকে বায়ু অত্যন্ত দ্রুত ওপরের দিকে ওঠে। উপরন্তু নিম্নচাপের ঠিক ওপরের স্তরে জেট বায়ুর দ্রুত বিক্ষেপ (divergent) ঘটতে থাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্ব বায়ুস্রোত (verti- cal wind shere)-ও অব্যাহত থাকে। ফলে ঘূর্ণবাত আরও শক্তিশালী হয়ে কেন্দ্রের নিম্নচাপ (L চিহ্নিত অঞ্চলে) আরও শক্তিবৃদ্ধি করে।এভাবে ওপরের বায়ুমণ্ডলীয় স্তরে তরঙ্গাকারে জেট বায়ুপ্রবাহের শক্তিশালী অভিসরণ ও বিক্ষেপণ-এর ফলে এবং ব্যারোক্লিনিক অবস্থার দ্বারা তৈরি উল্লম্ব বায়ুস্রোতের প্রভাবে একদিকে যেমন নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতকে বিকাশে সাহায্য করে ঠিক তেমনি ঘূর্ণবাতের শক্তিবৃদ্ধি করে ঘূর্ণবাতকে সচলও রাখে।