উষ্নতার অনুভূমিক বণ্টন (Horizontal Distribution of Temperature) :
পৃথিবীতে আলো ও তাপের প্রধান উৎস হল সূর্য। সূর্য থেকে আগত আলোকরশ্মি থেকেই বায়ুমণ্ডল পরোক্ষভাবে উত্তপ্ত হয়। কারণ বায়ুমণ্ডল সরাসরি সূর্যের আলোকরশ্মি শোষণ করতে পারে না। ভূ-ত্বক তা শোষণ করে পরিবহণ, পরিচলন, বিকিরণ পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। একই পদ্ধতিতে সমগ্র বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হলেও নানা কারণে স্থান ও কালভেদে বায়ুমণ্ডলের উয়তা এক থাকে না, কারণ তাপমাত্রার অনুভূমিক বণ্টনের ক্ষেত্রে অনেকগুলি বিষয় বা নিয়ন্ত্রক প্রভাব বিস্তার করে।
উন্নতার অনুভূমিক বণ্টনের নিয়ন্ত্রকসমূহ (Factors Influencing Horizontal Distribution of Temperature):
1. আগত সৌরকিরণ ও সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল: সূর্য থেকে আগত সৌরশক্তি ক্ষুদ্র আলোকতরঙ্গরূপে বিরামহীনভাবে ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায়। একেই আগত সৌর বিকিরণ (insolation) বলে। এই আগত সৌর বিকিরণের 30% (Critch field অনুসারে) মেঘ, ধুলিকণা ও ভূপৃষ্ঠ থেকে সরাসরি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় এবং বাকি 70% ভূপৃষ্ঠকে সরাসরি উত্তপ্ত করে। ভূপৃষ্ঠ থেকেই বায়ুমণ্ডল পরোক্ষভাবে উত্তপ্ত হয়। একেই সৌরশক্তির তাপীয় ফল বলা হয়। তবে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল স্থলভাগ ও জলভাগের অসম বণ্টন, ভূ-আবরণের বৈচিত্র্যময়তা, বায়ুমণ্ডলের অবস্থা, সূর্য- রশ্মির পতনকোণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যা উয়তার অনুভূমিক ও উল্লম্ব বণ্টনকে প্রভাবিত করে।
সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের সাপেক্ষে উয়তার অনুভূমিক বণ্টনের নির্ণায়কগুলি হল-
(ক) ভূপৃষ্ঠে পতিত সৌররশ্মির পতনকোণ: নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্যরশ্মি সারাবছর প্রায় লম্বভাবে পতিত হওয়ায় 1 একক সৌরশক্তি তুলনামূলকভাবে কম জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ুমণ্ডলের কম গভীরতা ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। কিন্তু মেরু অঞ্চলে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পতিত হওয়ায় ওই 1 একক সৌরশক্তি অপেক্ষাকৃত অনেকটা বেশিস্থান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং অধিক বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসায় সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল নিরক্ষীয় অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলে অনেকটাই কমে যায়। ফলস্বরূপ নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমশ কমতে থাকে। অনুরূপভাবে দিনের বেলায় সূর্যরশ্মির আপতন কোণের পার্থক্যের দরুন অনুভূমিকভাবে উয়তার বণ্টনের তারতম্য সৃষ্টি হয়।
(খ) দিবাভাগের দৈর্ঘ্য : যে সমস্ত অঞ্চলে দিন ও রাতের সময়কাল সমান সমান থাকে অর্থাৎ 12 ঘণ্টা দিন ও 12 ঘণ্টা রাত থাকে সেখানে দিনের বেলায় যে পরিমাণ সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠ তথা বায়ুমণ্ডল লাভ করে, তার সমপরিমাণ শক্তি রাতের বেলায় মহাশূন্যে ফিরে যায়। ফলে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল সমান থাকে। কিন্তু যেখানে 12 ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সূর্যালোক পায় সেখানে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল বেড়ে যায়। আবার, যেখানে 12 ঘণ্টার অধিক সময় ধরে রাত থাকে সেখানে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফল কমে যায়। অক্ষাংশ ভেদে দিবাভাগের দৈর্ঘ্যের তারতম্যের কারণে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের তারতম্য ঘটে। এই কারণে ঋতুভেদে উন্নতার অনুভূমিক বণ্টনেও তারতম্য লক্ষ করা যায়।
(গ) অ্যালবেডোর তারতম্য: ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র অ্যালবেডোর পরিমাণ সমান নয়। তুষারাবৃত ভূমিভাগে যেখানে অ্যালবেডোর পরিমাণ 90 ভাগ সেখানে বনভূমিতে অ্যালবেডোর পরিমাণ শতকরা 0.20 ভাগ। বিভিন্ন ধরনের ভূ-তাত্ত্বিক বৈষম্যের কারণে ও অ্যালবেডোর বিভিন্নতার কারণে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের পার্থক্য দেখা যায়।
(ঘ) পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে দূরত্ব : পৃথিবীর অনুসূর ও অপসূর অবস্থান সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলকে নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্যকে পরিক্রমণকালে পৃথিবী সূর্যের যত নিকটবর্তী হতে থাকে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের পরিমাণও তত বাড়তে থাকে, আবার সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপীয় ফলের পরিমাণও কমতে থাকে। অপসূর অবস্থানের তুলনায় অনুসূর অবস্থানের সময় পৃথিবী প্রায় ৬ শতাংশ অধিক সৌরশক্তির তাপীয় ফল লাভ করে থাকে।
(ঙ) অক্ষাংশ: অক্ষাংশ পরিবর্তনে সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের পরিবর্তন হয়। নিরক্ষরেখার ওপর সূর্যরশ্মির পতনকোণ 90°-66°30′, কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার ওপর 90°-43°, সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তের ওপর 47°-0° এবং মেরুবিন্দুর ওপর 23°30′-0° এর মধ্যে হয়ে থাকে। এর ফলে একক পরিমাণ সৌরশক্তির নীট তাপীয় ফল বিভিন্ন অক্ষাংশে বিভিন্ন হয়। নিরক্ষরেখার ওপর এই নীট ফল সর্বাধিক এবং মেরুবিন্দুর ওপর সর্বনিম্ন।
2. উচ্চতা: ট্রপোস্ফিয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাপমাত্রা 6.4° সেঃ হারে হ্রাস পায়। একে স্বাভাবিক তাপমাত্রা হ্রাসের হার (Normal Lapse Rate) বলে। মূলত দুটি কারণে এই হ্রাস ঘটে। যথা-
(i) বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠ থেকে উত্তাপ গ্রহণ করে পরোক্ষভাবে উত্তপ্ত হয়। তাই ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু প্রথমে উত্তপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে বায়ু ওপরের বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
(ii) নিম্ন বায়ুমণ্ডলে ধুলিকণা, জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অধিক হওয়ায় উত্তাপের শোষণ ক্ষমতা ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের তুলনায় বেশি।
উদাহরণ: এই কারণে কলকাতা অপেক্ষা শিলিগুড়ি এবং শিলিগুড়ি অপেক্ষা দার্জিলিং-এর উয়তা কম।
3. স্থলভাগ ও জলভাগের বণ্টন: স্থলভাগ জলভাগ অপেক্ষা দিনের বেলায় দ্রুত তাপ গ্রহণ এবং রাত্রিবেলা দ্রুত তাপ বিকিরণ করে। তাই স্থলভাগের সন্নিহিত অংশে সমুদ্র থাকলে সেখানে দিনের বেলায় উচ্চচাপ বিরাজ করে। একই সময়ে সন্নিহিত স্থলভাগে নিম্নচাপ বিরাজ করে। বায়ুপ্রবাহের নিয়ম মেনে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলভাগ থেকে সমুদ্রবায়ু স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়। সূর্যাস্তের পর স্থলভাগ দ্রুত তাপ বিকিরণ করে। তাই সন্ধ্যার পর স্থলভাগের উচ্চচাপ থেকে বায়ু জলভাগের নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়। তাই স্থলভাগ ও জলভাগের বণ্টন বায়ুমন্ডলের উয়তার দৈনিক বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে।
4. বায়ুপ্রবাহ: বায়ুপ্রবাহ তাপের তারতম্যের এক উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে জুন মাসে আগত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তিস্থল ভারত মহাসাগর। এই বায়ুর প্রবাহপথ উত্তর ভারত মহাসাগর এবং আরব ও বঙ্গোপসাগরের ওপর বিস্তৃত। তাই এই বায়ু ভারতে প্রবেশ মাত্র এই উপমহাদেশের উন্মুতা তৎক্ষণাৎ প্রায় 10° সেঃ কমে যায়। আবার, 15 অক্টোবরের পর ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর দিয়ে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ শুরু হয়। এই বায়ুর উৎপত্তিস্থল সাইবেরিয়ার শীতল সমভূমি। এই বায়ু মূলত রাশিয়া ও চিনের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতে আসে। এই বায়ু ভারতের উয়তাকে কমিয়ে দেয়। হিমালয় পর্বত না থাকলে এই বায়ু ভারতের শীতলতা আরো বৃদ্ধি করত।
5. সমুদ্রস্রোত : উপকূল অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত উষ্ম ও শীতল স্রোত উপকূলের উয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ উয় উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম অংশে সারাবছর গড় উন্নতা বেশি থাকে। আবার, পেরু উপকূলে শীতল পেরু বা হামবোল্ড স্রোতের প্রভাবে সারাবছর উন্নতা কম থাকে।
6. ভূমির ঢাল : সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা ভূমির ঢাল অধিক তাপ গ্রহণ করে। সূর্যের বিপরীত দিকের ভূমির ঢাল স্বল্প তাপ গ্রহণ করে। সূর্যের উত্তরায়ণের সময় উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণমুখী ঢাল ও দক্ষিণায়নের সময় দক্ষিণ গোলার্ধের উত্তরমুখী ঢাল সূর্যের দিকে মুখ করে অবস্থান করে। তাই এই ঢালগুলি বেশি উত্তপ্ত হয়। অপরপক্ষে উত্তরায়ণের সময় উত্তর গোলার্ধে উত্তরমুখী ঢাল এবং দক্ষিণায়ণের সময় দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণমুখী ঢাল সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থান করে, তাই এই ঢালগুলি কম উত্তপ্ত হয়।
7. মেঘাচ্ছন্নতা ও অধঃক্ষেপণ: (i) দিবাভাগে আকাশে মেঘ সৃষ্টি হলে সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। (ii) আবার রাতে মেঘাচ্ছন্নতা ভূপৃষ্ঠে পতিত সূর্য রশ্মির প্রতিফলনে বাধা দিয়ে উত্তাপ বাড়ায়। (iii) অধঃক্ষেপণ বায়ুমণ্ডলের তাপ হ্রাস করে। (iv) গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাতের তুলনায় বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিপাতের তুলনায় শিলাবৃষ্টি আবার শিলাবৃষ্টির তুলনায় তুষারপাত অধিক মাত্রায় উত্তাপ কমায়।
৪. স্বাভাবিক উদ্ভিদ: মানুষের পরিচর্যা ছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠা উদ্ভিদকে স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে। উদ্ভিদ একাধিকভাবে বায়ুমণ্ডলের তাপের তারতম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে- (i) উদ্ভিদ ছায়াপ্রদানের মাধ্যমে দিনের বেলায় বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমায়। (ii) বাষ্পীয় প্রস্বেদনের মাধ্যমে বায়ুতে জলীয় বাষ্প যোগ করে উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমায়। (iii) সালোকসংশ্লেষের সময় বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
9. মৃত্তিকা: বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকার তাপ গ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা ভিন্ন বলে মৃত্তিকার তারতম্যে বিভিন্ন স্থানের উত্তাপের তারতম্য দেখা যায়। ল্যাটেরাইট মাটির তাপ গ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা বেশি। অন্যদিকে এঁটেল মাটির তাপ গ্রহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা কম।
10. নগরায়ণ ও শিল্পায়ন : কোনো একটি অঞ্চলের জনবসতি নগরের অন্তর্গত হওয়াকে নগরায়ণ বলে। একাধিক শিল্পের সমাবেশকে শিল্পায়ন বলে। উত্তাপ বাড়াতে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবগুলি হল-
(i) নগরায়ণের ফলে কংক্রিট বৃদ্ধি পাওয়ায় সূর্যরশ্মির দ্বারা এই অঞ্চল দ্রুত উত্তপ্ত হয়।
(ii) নগরে যানবাহনের কারণে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড প্রভৃতির মতো বায়ুমণ্ডল উত্তপ্তকারী গ্যাস বেড়ে গিয়ে উত্তাপ বৃদ্ধি করে।
(iii) শিল্পের দূষকগুলিও দূষণ মাত্রা বাড়িয়ে বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি করে।
(iv) নগরায়ণ এবং শিল্পায়নের ফলে আবর্জনার স্তূপ নির্গত গ্যাস ও শিল্প দূষকের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ দ্রুত বাড়িয়ে তোলে।