অধঃক্ষেপণের ভৌগোলিক বণ্টন (Geographical distribution of Precipitation) :
বায়ুর সম্মিলন, প্রতিসরণ, বায়ুমণ্ডলীয় গোলযোগ, উচ্চভূমির অবস্থান ইত্যাদি বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়াও যেখান থেকে বায়ুপুঞ্জের উৎপত্তি ঘটে এবং যেসব স্থানের ওপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয় তার ওপরও বৃষ্টিপাতের বণ্টন নির্ভর করে। তাই বৃষ্টিপাতের ভৌগোলিক বণ্টনকে দুটি আঙ্গিকে বর্ণনা করা যায়। যথা-
(ক) দ্রাঘিমা বরাবর বৃষ্টিপাতের বণ্টন (Meridional distribution of Precipitation) :
পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিভিন্ন অক্ষাংশে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের বণ্টনের পার্থক্যের ভিত্তিতে এই ধরনের শ্রেণিবিভাজন করা হয়। যথা-
(i) 0°-15° উঃ/দঃ অক্ষাংশ অঞ্চল বা নিরক্ষীয় বলয় (Equitorial zone): নিরক্ষরেখার উভয়পার্শ্বে প্রায় 15° অক্ষরেখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে বছরে গড়ে প্রায় 160-200 সেমির অধিক বৃষ্টিপাত হয়। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়নবায়ুর সম্মিলন বলয়ে সূর্যরশ্মি সারাবছর প্রায় লম্বভাবে পতিত হওয়ায় ভূপৃষ্ঠ দ্রুত উত্তপ্ত হওয়ায় এবং স্থলভাগ অপেক্ষা জলভাগ অধিক হওয়ায় উয় ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে ওপর দিকে উঠে যায় এবং ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাতের আকারে নীচের দিকে নেমে আসে। অধিক উয়তার কারণে এই অঞ্চলে সর্বদাই নিম্নচাপ কেন্দ্রগুলি অবস্থান করে বলে এই সম্মিলন অঞ্চলে প্রতিদিন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
(ii) 15°-40° উঃ/দঃ অক্ষাংশ অঞ্চল বা ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় বলয় (Tropical and subtropical zone): এই অংশে বছরে গড়ে 80-100 সেমি বৃষ্টিপাত হয় (চিত্র: 13.16)। এই দুই উপক্রান্তীয় অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হওয়ায় এবং বায়ুর প্রতিসরণ (divergence) ঘটায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কমে আসে। এই কারণেই পৃথিবীর বেশির ভাগ মরুভূমিই এই অক্ষরেখায় অবস্থিত মহাদেশগুলিতেই বিস্তৃত।
(iii) 40°-60° উঃ/দঃ অক্ষাংশ অঞ্চল বা মধ্যঅক্ষাংশীয় বলয় (Mid-latitudinal zone):
এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের আধিক্য বেশি। দ্রাঘিমারেখা বরাবর বৃষ্টিপাতের বণ্টনের ভিত্তিতে এই অংশ পৃথিবীর দ্বিতীয় মাত্রাধিক বৃষ্টিপাত বলায়। এই অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 100-120 সেমি উভয়পার্শ্বের ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে বায়ু মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে ছুটে আসে এবং বায়ু প্রাচীরের সৃষ্টি হয় বলে এই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। তবে দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় উত্তর গোলার্ধের এই অক্ষাংশীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অনেকটা কম হয়। এই কারণে উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ায় বৃষ্টিপাতের অভাবে কয়েকটি মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
(iv) 60°-90° উঃ/দঃ অক্ষাংশ মধ্যবর্তী অঞ্চল বা মেরু বলয় (Polar Zone): উভয় গোলার্ধের মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চল থেকে মেরুর দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে। এই অঞ্চলের গড় বার্ষিক অধঃক্ষেপণের (Precipitation) পরিমাণ মাত্র 50 সেমি বা এরও কম। মেরু অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপের অবস্থান এবং অতি নিম্ন তাপমাত্রার জন্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া বৃষ্টিপাতও সর্বত্র সমান হয় না।
(খ) মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস (Classification based on amount of rainfall):
মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ভিত্তিতে সমগ্র পৃথিবীকে তিনটি বৃষ্টিপাত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। যথা-
1. অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল:
2000 মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলগুলিকে এই অংশে রাখা হয়। সাধারণত চরম বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিতিশীলতা, উচ্চ পরিবেশগত তাপবিযুক্তির হার, অধিক বাষ্পীভবন, পাহাড়ের ঢালে বাধা পেয়ে বায়ুর ঊর্ধ্বগমন, ঝড়ের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি কারণে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটতে দেখা যায়। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে চারটি বলয়ে অধিক বৃষ্টিপাত লক্ষ করা যায়। যেমন-
(a) ITCZ সংলগ্ন অঞ্চল (আমাজন অববাহিকা, পশ্চিম আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া)।
(b) নাতিশীতোষ্ম মণ্ডলের পশ্চিম উপকূল সংলগ্ন অঞ্চল (উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল সংলগ্ন ক্যালিফোর্নিয়া ও রকি পর্বতের পশ্চিম ঢাল; দক্ষিণ চিলি; উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ডের নিম্ন মালভূমি ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল; তাসমানিয়ার পশ্চিম উপকূল এবং নিউজিল্যান্ড)।
(c) এশিয়ার মৌসুমি জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চল (পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পশ্চিম ঢাল; উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম; মায়ানমারের আরাকান পার্বত্য এলাকা)।
(d) উপক্রান্তীয় পূর্ব উপকূল (আমেরিকার পূর্ব উপকূল; ওয়েস্ট ইন্ডিজ; দক্ষিণ ব্রাজিল; মাদাগাস্কারের পূর্ব উপকূল ও চিনের পূর্ব উপকূল)।
২. মাঝারি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল :ge
মোটামুটিভাবে 2000 থেকে 250 মিলিমিটারের মধ্যে বৃষ্টিপাত হয় এমন অঞ্চলকে মাঝারি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল বলা হয়। এই অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বলয়গুলি হল-
(a) ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল।
(b) উত্তর আমেরিকার মধ্য ও দক্ষিণ ভাগ (সানফ্রান্সিসকো, লস এঞ্জেলস)।
(c) মধ্য চিলি।
(d) দক্ষিণ আফ্রিকা।
(e) দক্ষিণ ও পূর্ব অস্ট্রেলিয়া (সিডনি, ব্রিসবেন)।
(f) পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল।
3. স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল :
250 মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলগুলিকে এই বলয়ের অন্তর্গত করা হয়। সাধারণত স্থিতিশীল জলবায়ু, পাহাড়ের প্রতিবাত ঢাল, শুষ্ক মহাদেশীয় জলবায়ু, প্রতীপ ঘূর্ণবাতের উপস্থিতি, স্বল্প উয়তা ও আর্দ্রতা এই অঞ্চল সৃষ্টির জন্য দায়ী।
সমগ্র পৃথিবীতে স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল তিনটি বলয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। যথা-
(a) উপক্রান্তীয় শুষ্ক উচ্চচাপ বলয় (উত্তর আমেরিকার মরুভূমি; চিলির আটাকামা; আন্দিজ পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল; অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চল ইত্যাদি)।
(b) মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে মহাদেশগুলির মধ্যভাগ (রাশিয়া ও তুর্কিস্তানের মরুভূমি, মধ্য আফ্রিকার সাহারা; উত্তর আমেরিকার নেভাদা পার্বত্য অঞ্চল)।
(c) মেরু অঞ্চল (আন্টার্কটিকা ও আর্কটিক অঞ্চল)।