অধঃক্ষেপণের বিভিন্ন রূপ (Forms of Precipitation):
বায়ুমণ্ডলীয় আর্দ্রতা সাধারণত তরল ও কঠিন-এই দুটি রূপেই ভূপতিত হয়। তবে অধঃক্ষেপণ যে রূপেই হোক না কেন, অধ্যক্ষেপণের রূপভেদকেই একত্রে 'hydrometeors' নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে 50 ধরনের hydrometeor-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান রূপভেদগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-
(ক) তরলরূপে অধঃক্ষেপণ (Precipitation in liquid forms): তরলরূপে অধঃক্ষেপণের গুরুত্বপূর্ণ রূপভেদগুলি হল-
1. বৃষ্টি (Rain): তরলরুপে অধঃক্ষেপণের সবচেয়ে সাধারণ এবং অতিপরিচিত রূপ হল বৃষ্টি। পৃথিবীতে শতকরা 90 ভাগেরও বেশি অধঃক্ষেপণ বৃষ্টিরূপেই ভূ-পতিত হয়। International Cloud Atlas, 1956 অনুযায়ী, 0-5 মিলিমিটারের অধিক ব্যাসযুক্ত জলকণা ভূপতিত হলে তাকে বৃষ্টি বলে। বৃষ্টিপাত সাধারণত অধিক ঘনত্বযুক্ত উঁচু মেঘ থেকেই সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিবিন্দুগুলি বেশির ভাগই রবফকনা (Snow- flakes) থেকে সৃষ্ট। এই বরফকণাগুলি বায়ুমণ্ডলের স্তর ভেদ করে ভূপতিত হওয়ার সময় যখনই হিমাঙ্কের ওপরে চলে আসে তখনই বৃষ্টিবিন্দুতে (rain drop) পরিণত হয়। ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হলে অনেকসময় বৃষ্টিবিন্দুগুলি সম্পূর্ণরূপে বাষ্পীভূত হয়ে পড়ে। ফলে আর ভূপতিত হতে পারে না। একে virgae' বলে।
2. ঝিরঝিরে বৃষ্টি (Drizzle): সাধারণত ক্ষুদ্রাকৃতির বৃষ্টিবিন্দুগুলি যখন বায়ুপ্রবাহ দ্বারা আন্দোলিত হয়ে ভুপৃষ্ঠে পতিত হয় তখন তাকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি বলে। International Cloud Atlas, 1956 অনুযায়ী জলকণার ব্যাস 0-5 মিলিমিটারের কম হলে তখনই তাকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি বলা হয়। সাধারণত হিমাঙ্কের ওপরে থাকা অবস্থায় বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা 100 শতাংশে পৌঁছালে ও ঘনীভবন শুরু হয়ে গেলে এই ধরনের বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। প্রধানত স্ট্যাটাস গোত্রীয় নীচু মেঘ থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি হতে দেখা যায়।
(খ) কঠিনৰূপে অধঃক্ষেপণ (Precipitation in solid form): কঠিনরূপে অধঃক্ষেপণের রূপভেদগুলি হল-—
1. তুষার (Snow): জলকণা ঘনীভূত হয়ে অতি সুক্ষ্ম বরফকণা বা পেঁজা তুলোর মতো অবস্থায় ভূপতিত হলে তাকে তুষারপাত বলে। হিমাঙ্কের তুলনায় কম উন্নতায় অতিশীতল পরিবেশে অতিশীতল (Super cooled) জলকণাগুলি ষড়বাহুবিশিষ্ট সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বরফকেলাস গঠন করে। কতকগুলি বরফকেলাস জমাটবদ্ধ হয়ে তুষার কেলাস (snow flakes) গঠন করে। এই তুষার কেলাসগুলি আবার জলীয় বাষ্পকে আকর্ষণ করে সরাসরি বরফকেলাসে পরিণত করে আয়তনে বাড়ে এবং একসময় মাধ্যাকর্ষণের টানে নিম্নমুখী হয়ে কঠিন অবস্থায় ভূপতিত হয়। একেই তুষারপাত বলে। প্রধানত অধিক উচ্চতার মেঘ থেকেই এগুলি সৃষ্টি হয়।
2. তুষার দানা (Snow Grains): অধঃক্ষিপ্ত তুষারকণার ব্যাস 1 মিলিমিটারের কম হলে তাকে তুষারদানা বলে। এগুলি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও দানাদার আকৃতির।
![]() |
তুষারদানা। রাইম। তুষারগুটি। |
3. তুষার গুঁটি বা গুটলি (Snow Pellets): অধঃক্ষিপ্ত তুষারকণার ব্যাস 2 থেকে 5 মিলিমিটারের মধ্যে হলে তাকে তুষার গুঁটি বা গুটলি (Snow Pal- lets) বলে। এই তুষারকণাগুলি এতটাই ভঙ্গুর হয় যে ভূপৃষ্টে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এগুলি সাদা স্বচ্ছ বলের মতো দেখতে হয়। তযার গুঁটিকে গ্রাউপেল (Grouple) বলেও অভিহিত করা হয়।
4. স্লিট (Sleet): বৃষ্টিবিন্দু শীতল বায়ুস্তর ভেদ করে আসার সময় জমাট বেঁধে ছোটো ছোটো বরফকণার আকারে ভূপতিত হলে ওই বৃষ্টিবিন্দুকে স্লিট বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া পরিসেবা দপ্তর বা USNWS (United States National Weather Service) সর্বপ্রথম স্লিট কথাটি ব্যবহার করে। স্লিটের ক্ষেত্রে তুষারকণার ব্যাস 5 মিলিমিটারের কম হয়। একে বরফগুঁটি (ice pallet) নামেও অভিহিত করা হয়। পিটারসেনের (Petterssen) মতে, উচ্চ ও মধ্য অক্ষাংশে অধিক উচ্চতায় অধঃক্ষেপণ তুষার রূপে শুরু হয় কিন্তু হিমাঙ্ক উন্নতা (freezing point) অতিক্রম করে নিম্নমুখী হলে তা স্লিটে পরিণত হয় এবং অবশেষে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি এসে বৃষ্টিবিন্দুতে পরিণত হয়ে ভূপতিত হয়।
5. শিলাবৃষ্টি (Hail): বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ছোটো বড়ো বরফখণ্ড ঝরে পড়লে তাকে শিলাবৃষ্টি বলে। International Cloud Atlas, 1959 অনুযায়ী বরফখন্ডের ব্যাস 5 থেকে 50 মিলিমিটারের মধ্যে হলে তাকে শিলাবৃষ্টি (Hail) বলা যায়। তুষারকণার আকৃতি 50 মিলিমিটারেরও অধিক হতে পারে। সাধারণত বজ্রগর্ভ কিউমুলোনিম্বাস মেঘ থেকেই শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে। এই বজ্রগর্ভ মেঘগুলি শিশিরাঙ্ক তাপমাত্রার চেয়েও অনেক কম উয়তায় এবং অধিক উচ্চতায় সৃষ্টি হয়। এই উচ্চতায় অতিশীতল জলকণা (Supercooled water) বরফকুঁচির (ice crystal) সংস্পর্শে এলেই পাতন (deposition) প্রক্রিয়ায় সরাসরি বরফকণায় পরিণত হয় এবং বরফকুচিগুলি আয়তনে বাড়তে থাকে। এভাবে বৃহৎ আকৃতির বরফকুচিগুলি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে দ্রুতগতিতে নীচের দিকে নামতে শুরু করলে অনেকসময় এগুলি বৃষ্টিবিন্দুতে রূপান্তরিত হতে সময় পায় না, ফলে বৃষ্টিপাতের সঙ্গে কঠিন অবস্থাতেই বরফকুঁচি ভূপতিত হয়।
6. গ্লেজ (Glaze): ০° সেঃ-এর কম তাপমাত্রা বিশিষ্ট বায়ুস্তর দ্বারা আচ্ছাদিত ভূপৃষ্ঠে বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টিবিন্দুগুলি মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই বরফকণায় পরিণত হয়। একেই গ্লেজ বলে। এর প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ বরফে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে।