সৌর বিকিরণের নিয়ন্ত্রকসমূহ (Factors affecting Insolation):
পৃথিবীতে আগত সৌর বিকিরণের মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে আগত সৌর বিকিরণ ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র সারাবছর ধরে সমানভাবে পড়ে না। ক্রান্তীয় অঞ্চলে বার্ষিক আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণ সর্বাধিক, মেরু অঞ্চলে সর্বনিম্ন। সৌর বিকিরণের এই অসম বণ্টন কতকগুলি নিয়ন্ত্রক দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই নিয়ন্ত্রকগুলি হল-
সারা বছর ধরে আগত সৌরশক্তির বন্টন ক্যালার/সেমি/বছর- এ (After lands berg) |
1. সূর্যরশ্মির পতনকোণ (Angle of the sun rays) :
আগত সৌর বিকিরণ একটি নির্দিষ্ট কোণে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। একেই সূর্যরশ্মির পতনকোণ বলে। সূর্যরশ্মির এই পতনকোণের মান সময় ও অক্ষাংশ ভেদে পরিবর্তিত হয়। ফলে আগত সৌর বিকিরণের তীব্রতার তারতম্য লক্ষ করা যায়। সূর্যরশ্মির পতনকোণ আগত সৌর বিকিরণকে দুইভাবে প্রভাবিত করে-
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সূর্য রশ্মির পতন কোণের পরিমাণ |
(a) মধ্যাহ্নের সময় সূর্যালোক ভূপৃষ্ঠের ওপর প্রায় লম্বভাবে এবং প্রভাত ও অপরাহ্নের সময় তির্যক বা অতি-তির্যকভাবে পতিত হয়। ফলে পতনকোণের পার্থক্যের দরুন একক পরিমাণ সৌরশক্তি প্রভাত ও অপরাহ্নে মধ্যাহ্নের তুলনায় অধিক পরিমাণ ভূভাগে পতিত হয়। ফলে ভূপৃষ্ঠ মধ্যাহ্নের তুলনায় অন্য সময় কম সৌর বিকিরণ লাভ করে।
(b) আবার, অক্ষাংশভেদেও সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সূর্যের আপাত বার্ষিকগতি নেই বলে ধরে নিলে সৌর বিকিরণ নিরক্ষরেখার ওপর 90° পতনকোণে এবং মেরু অঞ্চলে 30°-এর কম পতনকোণে পতিত হয় । ফলে একক পরিমাণ সৌরশক্তি নিরক্ষীয় অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলে অধিক পরিমাণ ভূভাগে পতিত হয়।
ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলে আগত সৌর বিকিরণের হার বেশি থাকে। আপাত বার্ষিক গতির জন্য নিরক্ষীয় অঞ্চলে পতনকোণ 90° থেকে 66°30′, ক্রান্তীয় অঞ্চলে 90° থেকে 43° এবং মেরু অঞ্চলে ০° থেকে 47° পর্যন্ত হয় |
2. অক্ষাংশের পরিবর্তন (Change of lati- tude):
অক্ষাংশ আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণকে দুইভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমত, নিরক্ষরেখায় প্রায় লম্বভাবে ও নিরক্ষরেখা থেকে দূরত্ব বৃদ্ধিতে সূর্যরশ্মি ক্রমশ তির্যক ও অতি তির্যকভাবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চলে এক একক ক্ষেত্রমানযুক্ত ভূভাগ যতটা পরিমাণ আগত সৌর বিকিরণ লাভ করে, মেরু অঞ্চলে ওই সম ক্ষেত্রমানযুক্ত ভূভাগ তুলনায় অনেক কম সৌর বিকিরণ পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, উচ্চঅক্ষাংশীয় অঞ্চলে তির্যকভাবে পড়ায় আগত সৌর বিকিরণ নিম্ন অক্ষাংশের তুলনায় বায়ুমণ্ডলে অনেকটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। এর ফলেও আগত সৌর বিকিরণের তীব্রতা অনেকটাই কমে যায়
3. সূর্য থেকে দূরত্ব (Distance from the sun):
পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হওয়ায় সারাবছর ধরে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব একই থাকে না। জুলাই মাসের 4 তারিখ সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সর্বাধিক থাকে, প্রায় 15 কোটি 20 লক্ষ কিমি, একে অপসূর (aphelion) অবস্থান বলে। আবার, জানুয়ারি মাসের ও তারিখ সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব সবচেয়ে কম হয়, প্রায় 14 কোটি 70 লক্ষ কিমি, একে অনুসূর (Perihelion) অবস্থান বলে (চিত্র: 3.10)। বিকিরণের Inverse Square Law অনুযায়ী (P = ₤/)' পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব যত বাড়বে আগত সৌর বিকিরণের তীব্রতা তত কমবে। তাই অনুসূর অবস্থানের সময় আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হবে এবং অপসূর অবস্থানে সর্বনিম্ন হবে। একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঋতুভেদে সূর্যের সঙ্গে দুরত্বের পার্থক্যের জন্য 6% আগত সৌর বিকিরণের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।
4. দিনরাতের দৈর্ঘ্য (Lengths of the day and night):
পৃথিবীর অক্ষ কক্ষতলের সঙ্গে 66¹/2° কোণে অবস্থান করায় অক্ষাংশভেদে সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য সর্বদা এক থাকে না। উপরন্তু সর্বত্র দিন ও রাতের সময়ও এক থাকে না। ফলে একই অক্ষাংশে ঋতুভেদে আগত সৌর বিকিরণের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যে গোলার্ধে যে ঋতুতে দিবাভাগের দৈর্ঘ্য বেশি হয় সেই গোলার্ধে আগত সৌর বিকিরণের মাত্রা বেশি হয়। আপাত বার্ষিক গতির কারণে সূর্য সারাবছরে কেবলমাত্র দুই দিন (21 মার্চ ও 23 সেপ্টেম্বর) নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাসে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়। আবার, 21 মার্চের পর উত্তরায়ণের কারণে উত্তর গোলার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, ফলে 21 মার্চ থেকে 23 সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকায় উত্তর গোলার্ধে সৌর বিকিরণ অধিক লাভ করে। 21 জুন সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর লম্বভাবে অবস্থান করায় কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চলে আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়। 23 সেপ্টেম্বরের পর দক্ষিণায়নের কারণে দক্ষিণ গালার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, ফলে 23 সেপ্টেম্বর থেকে 21 মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ গোলার্ধ অধিক সৌর বিকিরণ লাভ করে। আবার, 22 ডিসেম্বর সূর্য মকরক্রান্তি রেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেওয়ায় মকরক্রান্তীয় অঞ্চলে আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়
5. ভূমির ঢাল (Slope of the land):
ভূপৃষ্ঠ অসমতল প্রকৃতির। তাই ভূমির ঢাল নিরক্ষরেখা অর্থাৎ সূর্যের দিকে অবস্থান করলে সৌর বিকিরণ প্রায় লম্বভাবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে সূর্যালোকের বিপরীত দিকে ভূমির ঢালে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পতিত হয়। ফলে একক পরিমাণ ভূমি তুলনামূলক কম সৌর বিকিরণ লাভ করে।
6. মেঘাচ্ছন্নতা (Cloudiness):
ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত মেঘের আবরণ আগত সৌর বিকিরণকে বাধা দেয় এবং অ্যালবেডোর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নিরক্ষীয় অঞ্চলে সর্বাধিক সৌর বিকিরণ লাভ করার কথা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সর্বাধিক সৌর বিকিরণ 20° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হল নিরক্ষীয় অঞ্চল সারাবছরই মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অধিক সৌর বিকিরণ লাভ করতে পারে না। আবার, দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি থাকায় উত্তর গোলার্ধের তুলনায় বেশি মেঘাচ্ছন্ন থাকে বলে কম সৌর বিকিরণ লাভ করে। তাই পৃথিবীব্যাপী গড় আগত সৌর বিকিরণের বণ্টন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় অধিক বিকিরণ লাভ করে।
মেঘের ঘনত্বের পরিমাণও আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণকে প্রভাবিত করে। মেঘ দ্বারা আগত সৌর বিকিরণের প্রতিফলন ও সঞ্চলনের পরিমাণ নির্ভর করে আকাশে মেঘের ঘনত্বের ওপর।
(a) মেঘের ঘনত্বের পার্থক্যের ওপর মোট প্রতিফলনের 40 থেকে 90 শতাংশ নির্ভর করে। মেঘের ঘনত্ব কম হলে প্রতিফলনের হার কমে আসে। ফলে ভূপৃষ্ঠে আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণ বাড়ে। অন্যদিকে মেঘের ঘনত্ব বেশি হলে আগত সৌর বিকিরণ মেঘের ওপরের স্তর দিয়েই প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। ফলে ভূত্বক কম সৌর বিকিরণ লাভ করে।
(b) মেঘের ঘনত্ব কম হলে সঞ্চলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সঞ্চলনের হার বাড়লে আগত সৌর বিকিরণ ভূপৃষ্ঠ অধিক পরিমাণে লাভ করে।
এই কারণেই বায়ুমণ্ডলে বজ্রগর্ভ কিউমুলোনিম্বাস মেঘের উপস্থিতি কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে সূর্যালোকের অধিকাংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় এবং মেঘ দ্বারা শোষিত হয়। তাই অতি সামান্য অংশই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসতে সক্ষম হয়। তাই ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশকে কালো রঙের দেখায়। কিন্তু যদি মেঘের ওপর থেকে দেখা সম্ভবপর হত তাহলে আকাশকে উজ্জ্বল দেখাত এবং মেঘগুলিকে পেঁজা তুলোর ন্যায় মনে হত। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে পাতলা সিরাস মেঘের উপস্থিতি থাকলে আলো সহজেই ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসতে পারে। তাই এই ধরনের মেঘকে সাদা দেখায়।
7. ভূ-আবরণ (Land cover):
ভূ-আবরণ অ্যালবেডোর পরিমাণকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন উপাদানের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলনের হার এর জন্য দায়ী। ভূভাগ বরফাবৃত হলে প্রতিফলনের হার হয়ে দাঁড়ায় 75 থেকে 90 শতাংশ। জলভাগ আবার 30-70 শতাংশ
সূর্যালোক প্রতিফলিত করে। বনভূমির প্রতিফলনের পরিমাণ মাত্রা 3 থেকে 10 শতাংশ। তাই ভূ-আবরণের পার্থক্যের কারণে প্রতিফলনের হার ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় স্থানভেদে অ্যালবেডোর পরিমাণে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ফলস্বরূপ ভূপৃষ্ঠ সর্বত্র একই পরিমাণ সৌর বিকিরণ লাভ করে না।
৪. সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি (Presence of Sun spot):
সূর্যের আলোকমণ্ডলের অপেক্ষাকৃত শীতল অংশকে সৌরকলঙ্ক বলে। সূর্যের পৃষ্ঠে এরূপ অসংখ্য সৌরকলঙ্ক রয়েছে। এগুলি তুলনামূলক সূর্যের অনুজ্জ্বল অংশ। সর্বদা চলতে থাকা আণবিক বিস্ফোরণের কারণে সূর্যের পৃষ্ঠে এই সৌরকলঙ্কের সৃষ্টি হয়।
সূর্যের যে পৃষ্ঠটি পৃথিবীর দিকে অবস্থান করে সেই পৃষ্ঠে সৌরকলঙ্কের পরিমাণ বেশি থাকলে পৃথিবী স্বাভাবিকের তুলনায় কম আলোকশক্তি লাভ করে। ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপীয় ফল কমে যায়। সৌরকলঙ্কের পৃষ্ঠটি সরে গেলে পুনরায় পৃথিবী স্বাভাবিক পরিমাণ সৌর বিকিরণ লাভ করে। প্রতি 11 বছর অন্তর একই সৌরকলঙ্কের পৃষ্ঠ পৃথিবীর সামনে আসে।
(b) আবার, অক্ষাংশভেদেও সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সূর্যের আপাত বার্ষিকগতি নেই বলে ধরে নিলে সৌর বিকিরণ নিরক্ষরেখার ওপর 90° পতনকোণে এবং মেরু অঞ্চলে 30°-এর কম পতনকোণে পতিত হয় । ফলে একক পরিমাণ সৌরশক্তি নিরক্ষীয় অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলে অধিক পরিমাণ ভূভাগে পতিত হয়।
সূর্য রশ্মির পতন কোন অনুযায়ী ভিন্ন অংশে ভিন্ন তপোবলয় |
কর্কট সংক্রান্তি (২১জুন) |
2. অক্ষাংশের পরিবর্তন (Change of lati- tude):
অক্ষাংশ আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণকে দুইভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমত, নিরক্ষরেখায় প্রায় লম্বভাবে ও নিরক্ষরেখা থেকে দূরত্ব বৃদ্ধিতে সূর্যরশ্মি ক্রমশ তির্যক ও অতি তির্যকভাবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চলে এক একক ক্ষেত্রমানযুক্ত ভূভাগ যতটা পরিমাণ আগত সৌর বিকিরণ লাভ করে, মেরু অঞ্চলে ওই সম ক্ষেত্রমানযুক্ত ভূভাগ তুলনায় অনেক কম সৌর বিকিরণ পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, উচ্চঅক্ষাংশীয় অঞ্চলে তির্যকভাবে পড়ায় আগত সৌর বিকিরণ নিম্ন অক্ষাংশের তুলনায় বায়ুমণ্ডলে অনেকটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। এর ফলেও আগত সৌর বিকিরণের তীব্রতা অনেকটাই কমে যায়
মকর সংক্রান্তি (22)ডিসেম্বর |
অক্ষাংশভেদে আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণে পার্থক্য |
3. সূর্য থেকে দূরত্ব (Distance from the sun):
পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হওয়ায় সারাবছর ধরে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব একই থাকে না। জুলাই মাসের 4 তারিখ সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সর্বাধিক থাকে, প্রায় 15 কোটি 20 লক্ষ কিমি, একে অপসূর (aphelion) অবস্থান বলে। আবার, জানুয়ারি মাসের ও তারিখ সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব সবচেয়ে কম হয়, প্রায় 14 কোটি 70 লক্ষ কিমি, একে অনুসূর (Perihelion) অবস্থান বলে (চিত্র: 3.10)। বিকিরণের Inverse Square Law অনুযায়ী (P = ₤/)' পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব যত বাড়বে আগত সৌর বিকিরণের তীব্রতা তত কমবে। তাই অনুসূর অবস্থানের সময় আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হবে এবং অপসূর অবস্থানে সর্বনিম্ন হবে। একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঋতুভেদে সূর্যের সঙ্গে দুরত্বের পার্থক্যের জন্য 6% আগত সৌর বিকিরণের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।
পৃথিবীর অনুসুর ও অপসুর অবস্থান |
পৃথিবীর অক্ষ কক্ষতলের সঙ্গে 66¹/2° কোণে অবস্থান করায় অক্ষাংশভেদে সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য সর্বদা এক থাকে না। উপরন্তু সর্বত্র দিন ও রাতের সময়ও এক থাকে না। ফলে একই অক্ষাংশে ঋতুভেদে আগত সৌর বিকিরণের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যে গোলার্ধে যে ঋতুতে দিবাভাগের দৈর্ঘ্য বেশি হয় সেই গোলার্ধে আগত সৌর বিকিরণের মাত্রা বেশি হয়। আপাত বার্ষিক গতির কারণে সূর্য সারাবছরে কেবলমাত্র দুই দিন (21 মার্চ ও 23 সেপ্টেম্বর) নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাসে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়। আবার, 21 মার্চের পর উত্তরায়ণের কারণে উত্তর গোলার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, ফলে 21 মার্চ থেকে 23 সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকায় উত্তর গোলার্ধে সৌর বিকিরণ অধিক লাভ করে। 21 জুন সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর লম্বভাবে অবস্থান করায় কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চলে আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়। 23 সেপ্টেম্বরের পর দক্ষিণায়নের কারণে দক্ষিণ গালার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, ফলে 23 সেপ্টেম্বর থেকে 21 মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ গোলার্ধ অধিক সৌর বিকিরণ লাভ করে। আবার, 22 ডিসেম্বর সূর্য মকরক্রান্তি রেখার ওপর লম্বভাবে কিরণ দেওয়ায় মকরক্রান্তীয় অঞ্চলে আগত সৌর বিকিরণ সর্বাধিক হয়
অক্ষাংশ অনুযায়ী ঋতুভেদে আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণ |
ভূমির ঢালের সঙ্গে আগত সৌর বিকিরণের সম্পর্ক |
ভূপৃষ্ঠ অসমতল প্রকৃতির। তাই ভূমির ঢাল নিরক্ষরেখা অর্থাৎ সূর্যের দিকে অবস্থান করলে সৌর বিকিরণ প্রায় লম্বভাবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে সূর্যালোকের বিপরীত দিকে ভূমির ঢালে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পতিত হয়। ফলে একক পরিমাণ ভূমি তুলনামূলক কম সৌর বিকিরণ লাভ করে।
6. মেঘাচ্ছন্নতা (Cloudiness):
ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থিত মেঘের আবরণ আগত সৌর বিকিরণকে বাধা দেয় এবং অ্যালবেডোর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নিরক্ষীয় অঞ্চলে সর্বাধিক সৌর বিকিরণ লাভ করার কথা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সর্বাধিক সৌর বিকিরণ 20° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হল নিরক্ষীয় অঞ্চল সারাবছরই মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অধিক সৌর বিকিরণ লাভ করতে পারে না। আবার, দক্ষিণ গোলার্ধে জলভাগ বেশি থাকায় উত্তর গোলার্ধের তুলনায় বেশি মেঘাচ্ছন্ন থাকে বলে কম সৌর বিকিরণ লাভ করে। তাই পৃথিবীব্যাপী গড় আগত সৌর বিকিরণের বণ্টন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণ গোলার্ধের তুলনায় অধিক বিকিরণ লাভ করে।
মেঘের ঘনত্বের পরিমাণও আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণকে প্রভাবিত করে। মেঘ দ্বারা আগত সৌর বিকিরণের প্রতিফলন ও সঞ্চলনের পরিমাণ নির্ভর করে আকাশে মেঘের ঘনত্বের ওপর।
(a) মেঘের ঘনত্বের পার্থক্যের ওপর মোট প্রতিফলনের 40 থেকে 90 শতাংশ নির্ভর করে। মেঘের ঘনত্ব কম হলে প্রতিফলনের হার কমে আসে। ফলে ভূপৃষ্ঠে আগত সৌর বিকিরণের পরিমাণ বাড়ে। অন্যদিকে মেঘের ঘনত্ব বেশি হলে আগত সৌর বিকিরণ মেঘের ওপরের স্তর দিয়েই প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। ফলে ভূত্বক কম সৌর বিকিরণ লাভ করে।
(b) মেঘের ঘনত্ব কম হলে সঞ্চলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সঞ্চলনের হার বাড়লে আগত সৌর বিকিরণ ভূপৃষ্ঠ অধিক পরিমাণে লাভ করে।
এই কারণেই বায়ুমণ্ডলে বজ্রগর্ভ কিউমুলোনিম্বাস মেঘের উপস্থিতি কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে সূর্যালোকের অধিকাংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় এবং মেঘ দ্বারা শোষিত হয়। তাই অতি সামান্য অংশই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসতে সক্ষম হয়। তাই ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশকে কালো রঙের দেখায়। কিন্তু যদি মেঘের ওপর থেকে দেখা সম্ভবপর হত তাহলে আকাশকে উজ্জ্বল দেখাত এবং মেঘগুলিকে পেঁজা তুলোর ন্যায় মনে হত। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে পাতলা সিরাস মেঘের উপস্থিতি থাকলে আলো সহজেই ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসতে পারে। তাই এই ধরনের মেঘকে সাদা দেখায়।
7. ভূ-আবরণ (Land cover):
ভূ-আবরণ অ্যালবেডোর পরিমাণকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন উপাদানের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিফলনের হার এর জন্য দায়ী। ভূভাগ বরফাবৃত হলে প্রতিফলনের হার হয়ে দাঁড়ায় 75 থেকে 90 শতাংশ। জলভাগ আবার 30-70 শতাংশ
সূর্যালোক প্রতিফলিত করে। বনভূমির প্রতিফলনের পরিমাণ মাত্রা 3 থেকে 10 শতাংশ। তাই ভূ-আবরণের পার্থক্যের কারণে প্রতিফলনের হার ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় স্থানভেদে অ্যালবেডোর পরিমাণে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ফলস্বরূপ ভূপৃষ্ঠ সর্বত্র একই পরিমাণ সৌর বিকিরণ লাভ করে না।
৪. সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি (Presence of Sun spot):
সূর্যের আলোকমণ্ডলের অপেক্ষাকৃত শীতল অংশকে সৌরকলঙ্ক বলে। সূর্যের পৃষ্ঠে এরূপ অসংখ্য সৌরকলঙ্ক রয়েছে। এগুলি তুলনামূলক সূর্যের অনুজ্জ্বল অংশ। সর্বদা চলতে থাকা আণবিক বিস্ফোরণের কারণে সূর্যের পৃষ্ঠে এই সৌরকলঙ্কের সৃষ্টি হয়।
সূর্যের যে পৃষ্ঠটি পৃথিবীর দিকে অবস্থান করে সেই পৃষ্ঠে সৌরকলঙ্কের পরিমাণ বেশি থাকলে পৃথিবী স্বাভাবিকের তুলনায় কম আলোকশক্তি লাভ করে। ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপীয় ফল কমে যায়। সৌরকলঙ্কের পৃষ্ঠটি সরে গেলে পুনরায় পৃথিবী স্বাভাবিক পরিমাণ সৌর বিকিরণ লাভ করে। প্রতি 11 বছর অন্তর একই সৌরকলঙ্কের পৃষ্ঠ পৃথিবীর সামনে আসে।