বায়ুমণ্ডলীয় উপাদানের সঙ্গে আগত সৌরবিকিরণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (Effects of Insolation on Atmospheric Elements) :
সৌর ধ্রুবক রূপে আগত এই সৌর বিকিরণ বায়ুমণ্ডলের বহিঃআবরণ থেকে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসার সময় বিভিন্নভাবে বাধা পায় এবং কতকগুলি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে। এই প্রক্রিয়াগুলি হল-
1. প্রতিফলন (Reflection)
2. বিচ্ছুরণ (Scattering)
3. শোষণ (Absorption) এবং
4. সঞ্চলন (Trans- mission
1. প্রতিফলন (Reflection):
আলোকরশ্মি একটি সমসত্ত্ব মাধ্যম থেকে অন্য সমসত্ত্ব মাধ্যমে আপতিত হওয়ার সময় ওই আলোকরশ্মির কিছু অংশ মাধ্যমের বিভেদ তল থেকে দিক পরিবর্তন করে প্রথম মাধ্যমের দিকে ফিরে যায়। এই ঘটনাকেই প্রতিফলন বলে। আগত সৌর বিকিরণ বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর কিছু অংশ মেঘ ও ধুলিকণা থেকে এবং কিছুটা ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার পর প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় মহাশূন্যে ফিরে যায়। এই প্রতিফলন বোঝানোর ক্ষেত্রে অ্যালবেডো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাওয়া সৌর বিকিরণ (R↑) ও আগত সৌর বিকিরণ, (R↓), এই দুইয়ের অনুপাত যখন দশমিক বা শতাংশে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে অ্যালবেডো (c) বলে। ("The ratio between the total radiation falling upon a surface and the amount reflected expressed as a decimal or a percentage is known as Albedo". - Monkhouse)। অর্থাৎ, এককথায় অ্যালবেডো হল প্রতিফলিত সৌর বিকিরণের শতকরা হার। সূত্রাকারে বলতে গেলে অ্যালবেডো হল- = R/R × 100. পৃথিবীতে আগত সৌর বিকিরণের গড়ে শতকরা 30% অ্যালবেডো রূপে প্রতিফলিত হয়ে মহাশূন্যে ফিরে যায়। এর মধ্যে শতকরা 20 ভাগ মেঘ দ্বারা, 6 ভাগ ধুলিকণা এবং 4 ভাগ ভূপৃষ্ঠ দ্বারা সরাসরি প্রতিফলিত হয়। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদান তথা পৃথিবীতে অবস্থিত বিভিন্ন বস্তুর অ্যালবেডোর পরিমাণ Table (3.1)-এ দেখানো হল।
উৎস: Ahrens (2008), Meteorology today and Linacre and Geets (1997), Climates and Weather Explained
পৃথিবীপৃষ্ঠে আগত সৌর বিকিরণ বায়ুমণ্ডলীয় স্তর ভেদ করার সময় মেঘ দ্বারাই সর্বাধিক আলোর প্রতিফলন ঘটায়। এই প্রতিফলনের হার মেঘাচ্ছন্নতার ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে প্রতিফলন 40 থেকে 90 শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আগত সৌরবিকিরণ প্রতিফলনে জলভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ পৃথিবীর প্রায় 70% ভূমিভাগ জল দ্বারা আবৃত। তবে জলভাগ থেকে প্রতিফলনের হার সূর্যরশ্মির পতনকোণের ওপর নির্ভর করে। সূর্য যখন দিগন্তে অবস্থান করে তখন জলভাগ থেকে প্রতিফলনের হার বেশি হয়। সূর্য যত মধ্য আকাশে আসতে থাকে প্রতিফলনের হার তত কমতে থাকে। ভূত্বক আগত সূর্যরশ্মিকে প্রায় 40 থেকে 50 শতাংশ প্রতিফলন করে। তবে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলনের হার নির্ভর করে ভূ-আবরণের প্রকৃতির ওপর। ভূপৃষ্ঠ যদি বরফাবৃত হয় তবে প্রায় 75% আলো প্রতিফলিত হবে, আবার বালুকাময় হলে প্রতিফলন হবে 35% ।
প্রসঙ্গত, আলোকরশ্মি প্রতিফলনের ক্ষেত্রে সকল বস্তু আগত সৌরবিকিরণকে বাধা দেয় এবং প্রতিফলনে বাধ্য করে। ওই বস্তুকণাগুলির ব্যাস অবশ্যই আগত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় বড়ো হবে। অর্থাৎ, বস্তুর ব্যাস d এবং আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য 入 হলে প্রতিফলনের ক্ষেত্রে d > 入 হবে।
আবার, বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মিকে প্রতিফলন করে বলে আমরা বস্তুর একটি নির্দিষ্ট রঙ নির্ধারণ করতে পারি। এই কারণেই আমরা উদ্ভিদের পাতার রং সবুজ দেখি। কারণ দৃশ্যমান আলো অর্থাৎ সাদা আলো পাতায় পতিত হলে কেবল সবুজ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (.55 µm) দৃশ্যমান আলোকেই প্রতিফলিত করে, আর দৃশ্যমান আলোর বাকি অংশ হয় শোষণ করে নতুবা পরিবহণ করে। এ ছাড়াও, অবলোহিত তরঙ্গরশ্মির (IR) 0.72 থেকে 0.98 µm তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে পাতা সর্বাধিক প্রতিফলিত করে, কিন্তু আমাদের চোখে তা ধরা না পড়ায় আমরা তা দেখতে পাই না। তাই দূরসংবেদন (Remote sensing) প্রক্রিয়ায় উপগ্রহচিত্রে সবুজ উদ্ভিদকে চিহ্নিতকরণের জন্য এই IR রশ্মির প্রতিফলনকে সংগ্রহ করে লাল বর্ণের ফিল্টার দিয়ে পাঠিয়ে ছদ্ম রঙের চিত্র (False Colour Composite) প্রস্তুত করা হয়। এর ফলে এই চিত্রে উদ্ভিদের রঙ লাল দ্বারা উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
2. বিচ্ছুরণ (Scattering) :
পূর্বে আমরা দেখেছি দৃশ্যমান আলোকরশ্মি (0.4 থেকে 0.7 µm তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট) 7টি বর্ণের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের আলোকরশ্মির সমাহার এবং একটি প্রিজমের মধ্য দিয়ে একে পাঠালে প্রতিসরণের কারণে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য অনুযায়ী লাল থেকে বেগুনি মোট 7টি রঙের উপাংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এভাবে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিভিন্নতার দরুন বহুবর্ণের সমন্বয়ে দৃশ্যমান আলোকরশ্মি (সাদা আলো) প্রিজম বা কোনো স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রতিসৃত হওয়ার সময় বিভিন্ন বর্ণের আলোকরশ্মিতে বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনাকে আলোর বিচ্ছুরণ বলে।
আগত সৌরবিকিরণ (Incoming Solar Radiation) বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠের দিকে আসার সময় বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান ও ধুলিকণায় আপতিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ বৈজ্ঞানিক Lord Rayleigh
(1842-1919) বিচ্ছুরণের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করে এই ধারণাটির বিকাশ ঘটান। তাই একে Rayleigh Scattering বলে। তবে বিচ্ছুরণের হার ও দিক নির্ভর করে বিচ্ছুরণকারী বস্তুকণার ব্যাসার্ধ ও আলোকরশ্মির দৈর্ঘ্যের অনুপাতের ওপর। আরো স্পষ্ট করে বললে বিচ্ছুরণের হার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ ঘাতের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতে সম্পর্কিত ('The amount of scatter is inversely proportional to the fourth power of the wavelength'. - Oliver & Hidore)। অর্থাৎ, ক্ষুদ্রতরঙ্গের বিচ্ছুরণের হার বৃহৎ তরঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি হয়। আবার, কোনো বস্তু (Particles) তখনই বিচ্ছুরণ করবে যখন তার ব্যাস আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় ছোটো হবে। বিচ্ছুরণের শর্ত-আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য (入) বস্তুকণার ব্যাস (d) অপেক্ষা বড়ো হলে তবেই বিচ্ছুরণ ঘটবে।
শর্ত অনুযায়ী, 入>d হলে অর্থাৎ 入/d> 1 হলেই বিচ্ছুরণ ঘটবে
বায়ুমণ্ডল থেকে বিচ্ছুরণের ধরন ও আকাশের রঙ নির্ধারণ করা হয় বায়ুমণ্ডলের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। বায়ুমণ্ডলে যদি ধুলিকণার পরিমাণ বেশি থাকে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন হয় তখন আগত সৌর বিকিরণের দৃশ্যমান তরঙ্গের সবটাই বিচ্ছুরিত হয়। তখন আবার আকাশ অনেকটা সাদা রঙের মতো দেখতে হয় (চিত্র: 3.4)।
3. শোষণ (Absorption):
বস্তু বিকীর্ণ তাপ শোষণ করলে উত্তপ্ত হয়, এই উত্তাপই ইন্দ্রিয়- গ্রাহ্য উয়তা (sensible heat)। আবার, বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাস বর্ণালীর অন্তর্গত সুনির্দিষ্ট কিছু কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মিকে শোষণ করতে সক্ষম হয়। তবে এদের অধিকাংশ গ্যাসই দীর্ঘতরঙ্গের আলোকরশ্মি শোষণে অধিক সক্ষম।
আগত সৌর বিকিরণের অধিকংশটাই ক্ষুদ্র ও দৃশ্যমান তরঙ্গরূপে পৃথিবীতে আসে এবং এর সর্বাধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্য 0.5 µm-এর মধ্যে থাকে। বায়ুমণ্ডলের মোট আয়তনের 99% নাইট্রোজেন (N₂), অক্সিজেন (O₂) গ্যাস ও জলীয় বাষ্প (H₂O) দ্বারা গঠিত। এর মধ্যে নাইট্রোজেন আগত সৌরবিকিরণকে খুব একটা শোষণ করতে পারে না এবং জলীয় বাষ্প দীর্ঘতরঙ্গবিশিষ্ট অবলোহিত বিকিরণের (IR) উত্তম শোষক হলেও ক্ষুদ্র তরঙ্গের বিকিরণকে শোষণ করে না, তবে অক্সিজেন (০₂) ও ওজোন (O₃) গ্যাস 0.3 µm-এর কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আগত সৌর বিকিরণকে উত্তমরূপে শোষণ করতে পারে। এর বেশির ভাগটাই ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে শোষিত হয়। কিন্তু এদের মধ্যে কোনোটাই দৃশ্যমান আলোকরশ্মিকে শোষণ করতে পারে না।
4. সঞ্চলন (Transmission):
বিকিরণের যে অংশটুকু বস্তু দ্বারা শোষিত, বিচ্ছুরিত বা প্রতিফলিত না হয়ে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে চলে আসতে পারে, তাকেই সঞ্চলন বলে। আগত সৌর বিকিরণের যে অংশটুকু বায়ুমণ্ডলের স্তর ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে আসে তাকে সঞ্চলনশীলতা হার (Transmissivity) বলে। সঞ্চলনশীলতা আবার বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে বিকীর্ণ তাপ কতটা দূরত্ব অতিক্রম করে সেই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
সুতরাং আগত সৌর বিকিরণের বেশ কিছু অংশ (গড়ে 30%) বায়ুমণ্ডলীয় স্তর ভেদ করার সময় প্রতিফলিত, বিচ্ছুরিত ও অতি সামান্য অংশ শোষিত হচ্ছে এবং বাকি অংশটুকু (70%) ভূপৃষ্ঠে সরাসরি এসে পড়ছে এবং ভূপৃষ্ঠও ধীরে ধীরে সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করছে। আগত সৌর বিকিরণের এই অংশকে কার্যকরী সৌর বিকিরণ (Effective Solar Radiation) বলে।
সারা বছর ধরে আগত সৌরশক্তির বন্টন ক্যালার/সেমি/বছর ( After Lands berg ) উৎসঃ G. Trewartha (1980), An Introduction to Climate |