উন্নতার তারতম্য অনুসারে স্তরবিন্যাস (Division of Atmospheric layer based on Temperature difference):
ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উয়তার তারতম্য লক্ষ করা যায়। এই তারতম্য মূলত উচ্চতা ভেদে গ্যাসীয় উপাদানের অনুপাতের তারতম্য, বায়ুর ঘনত্ব ও চাপের পার্থক্য, বিভিন্ন প্রকার তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্যাসের বিভিন্ন আচরণ, বায়ুমণ্ডলের উত্তপ্ত হওয়ার পদ্ধতি প্রভৃতি কারণে সৃষ্টি হয়। তাই উয়তার তারতম্য অনুয়ায়ী ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুমণ্ডলকে চারটি প্রধান স্তরে ভাগ করা হয়। যথা-
(a) ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere),
(b) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার (Stratosphere),
(c) মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) ও
(d) থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere)
(a) ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere):
ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরটির নাম ট্রপোস্ফিয়ার। ট্রপোস্ফিয়ার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বিজ্ঞানী টেসারেন্স-দ্য-বোস্ট (Tesserence-de-Bost) |
• বৈশিষ্ট্য:
1. গ্রিক শব্দ 'Tropos'-এর অর্থ হল মিশ্রণ (mixing)। এই স্তরটিতে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থের 75 শতাংশ এবং জলীয় বাষ্প ও ধুলিকণাসহ অন্যান্য উপাদানগুলির 99.9 শতাংশ অবস্থান করে। তাই এদের সর্বাধিক মিশ্রণের কারণে বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তরটির নাম দেওয়া হয়েছে ট্রপোস্ফিয়ার।
2. বায়ুমণ্ডলের এই স্তরটি প্রত্যক্ষভাবে ক্ষুদ্র তরঙ্গের আগত সৌর বিকিরণ শোষণ করতে পারে না। ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু ভূপৃষ্ঠ থেকে দীর্ঘ তরঙ্গের পার্থিব বিকিরণ শোষণ করে। তারপর পরিচলন (Convection) প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বমুখে উত্থিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে তাপের প্রবাহ ঘটায়। তাই ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধিতে এই স্তরের উয়তা একটি সুনির্দিষ্ট হারে হ্রাস পায়। স্থিতিশীল অবস্থায় মোটামুটি প্রতি কিলোমিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে ট্রপোস্ফিয়ারে গড়ে 6-4° সেঃ হারে তাপমাত্রা হ্রাস পায়। একে উন্নতার স্বাভাবিক হ্রাসের হার (Normal lapse rate) বলে। এভাবে তাপমাত্রা কমতে কমতে ট্রপো- স্ফিয়ারের শেষ সীমায় নিরক্ষীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা এসে দাঁড়ায় -80° সেঃ এবং মেরু অঞ্চলে -60° সেঃ।
3. নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবে পতিত হওয়ায় পরিচলন প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। তুলনামূলকভাবে মেরু অঞ্চলের দিকে এই প্রক্রিয়ার প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে। উপরন্তু নিরক্ষীয় অঞ্চলে এই প্রক্রিয়ার প্রভাবে জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন, মেঘ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ইত্যাদি বায়ুমণ্ডলীয় বিভিন্ন কার্যাবলি অব্যাহত থাকে। তাই নিরক্ষীয় অঞ্চলে ট্রপোস্ফিয়ারে উচ্চতা সর্বাধিক, প্রায় 18 কিমি; অন্যদিকে মেরু অঞ্চলে উচ্চতা সর্বনিম্ন, প্রায় 8-9 কিমি।
4. ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় উপাদান, জলীয় বাষ্প, ধুলিকণার পরিমাণ কমতে থাকায় ট্রপোস্ফিয়ারে উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুর চাপ ক্রমশ কমতে থাকে এবং ট্রপোপজে বায়ুর চাপ কমে দাঁড়ায় 250 মিলিবার।
5. পরিচলন প্রক্রিয়ায় জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ, চাপের হ্রাস, ঘনীভবন ঘটার অনুকূল পরিবেশ প্রভৃতির কারণে বায়ুমণ্ডলের এই স্তরে মেঘের সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ ট্রপোস্ফিয়ারে ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত সহ সকল প্রকার আবহাওয়াগত গোলযোগ লক্ষ করা যায়। এই কারণে ট্রপোস্ফিয়ারকে ক্ষুদ্ধমণ্ডল বলা হয়।
• শ্রেণিবিভাগ: ট্রপোস্ফিয়ারকে আবার দুটি উপস্তরে বিভক্ত করা হয়। যথা- (i) নিম্ন ট্রপোস্ফিয়ার ও (ii) ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ার।
(1) নিম্ন ট্রপোস্ফিয়ার: ট্রপোস্ফিয়ারের নীচের স্তরটি ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ও কিমি উচ্চতার মধ্যে অবস্থান করে। এই স্তরটিতে আবহাওয়ার উপাদানগুলির দৈনিক পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। এই স্তরটি আবার ঘর্ষণ স্তর (friction layer) নামেও পরিচিত। প্রধানত এই স্তরে ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে বায়ুর ক্রমাগত সংঘর্য লক্ষ করা যায়। ফলে বায়ুর গতিবেগ কমে যায়। কোরিওলিস বলের প্রভাবে এই স্তরে বায়ুর দিক পরিবর্তন ঘটে। এ ছাড়াও ট্রপোস্ফিয়ারের এই স্তরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, সেটি হল-উয়তার বৈপরীত্য (Inversion of temperature)। অর্থাৎ, উচ্চতা বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা হ্রাস না পেয়ে বৃদ্ধি পায়। এই ধরনের পরিস্থিতি সাধারণত শীতকালে মেঘমুক্ত রাত্রিতেও পার্বত্য উপত্যকায় সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়।
(ii) উর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ার: ট্রপোস্ফিয়ারের ওপরের স্তরটি ভূপৃষ্ঠের ওপরে গড়ে ও থেকে 11 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত (যদিও অক্ষাংশভেদে উচ্চতার পার্থক্য লক্ষ করা যায়)। এই স্তরটিতে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের সংঘর্ষ না হওয়ায় আবহাওয়ার উপাদানগুলির খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। উপরন্তু ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বাধা কমতে থাকায় বায়ুতে কোরিওলিস বলের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ফলে বায়ু অধিকমাত্রায় বিক্ষিপ্ত হয়।
■ ট্রপোপজ (Tropopause):
ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে 11 কিমি উচ্চতা (নিরক্ষীয় অঞ্চলে 18 কিমি, মেরু অঞ্চলে 8-9 কিমি) ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বে 2 থেকে 3 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরকে ট্রপোপজ বলে। 'Tropo' শব্দের অর্থ মিশ্রণ এবং 'Pause' শব্দের অর্থ থামা। অর্থাৎ, বায়ুমণ্ডলের 11 কিমি উচ্চতায় বায়ু চলাচল তেমন হয় না, তাপের হ্রাসবৃদ্ধিও কমে যায়। তাই বায়ুমণ্ডলের এই বলয়ে মিশ্রণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে ট্রপোপজ (Where the mixing stop)। ট্রপোপজ একটি সঙ্কীর্ণ বলের আকারে অবস্থান করে যেখানে তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন হয় না। এরপর থেকে তাপমাত্রা উচ্চতা বৃদ্ধিতে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ট্রপোপজ শব্দটি প্রথম নেপিয়ার শ (Napier Sha) প্রথম ব্যবহার করেন।
(b) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার (Stratosphere):
ল্যাটিন শব্দ 'Stratum' যার অর্থ স্তর থেকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার শব্দটি এসেছে। 1902 সালে বিজ্ঞানে টেসারেন্স-দ্য-বোস্ট সর্বপ্রথম স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার শব্দটি ব্যবহার করেন। ট্রপোস্ফিয়ারের ওপরে অর্থাৎ ট্রপোপজের পর থেকে 50 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত মোটামুটিভাবে অপরিবর্তনশীল বা স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তরটির নাম স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার।
• বৈশিষ্ট্য:
1. বায়ুমণ্ডলের এই স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তবে ট্রপোপজ থেকে 25 কিমি পর্যন্ত উচ্চতা বৃদ্ধিতে উন্নতা বৃদ্ধির হার খুব সামান্য হলেও এরপর থেকে উয়তা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে 50 কিমি উচ্চতায় ০° সেঃ-তে এসে পৌছায়। তাপমাত্রার এই দ্রুত বৃদ্ধির কারণ হল ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি। বায়ুমণ্ডলে 15-35 কিমি উচ্চতার মধ্যে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় (চিত্র: 4-5)। এই গ্যাস সূর্য থেকে আগত ক্ষুদ্র তরঙ্গের অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই বিক্রিয়া তাপ উৎপাদক হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের এই অংশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
2. স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে জলীয় বাষ্পের কোনো উপস্থিতিই লক্ষ করা যায় না। ধুলিকণা সামান্য পরিমাণে থাকলেও এই স্তর প্রায় জলীয় বাষ্পশূন্য অবস্থায় থাকে। তাই এই স্তর সর্বদাই মেঘমুক্ত থাকে। ফলে কোনোপ্রকার ঝড়, বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাত লক্ষ করা যায় না। আবার, বায়ুপ্রবাহও তেমন বেগসম্পন্ন হয় না। তাই এই স্তরে সর্বদাই শান্তভাব বিরাজ করে। এই কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারকে শান্তমণ্ডলও বলা হয়। বায়ুমণ্ডল সর্বদা শান্ত থাকার কারণে দ্রুতগতিসম্পন্ন জেট বিমানগুলি ঝড়-বৃষ্টি এড়াতে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে চলাচল করে।
3. স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে কোনোপ্রকার বায়ুপ্রবাহ ঘটে না বলে জেট বিমানের ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়া ও জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে এই স্তরে পুচ্ছাকারে সাদা মেঘের সৃষ্টি করে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।
4. মেরু অঞ্চলে শীতকালে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে তাপমাত্রার একটা বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ওই সময় রাত্রিকালে এই স্তরের উন্নতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শীতের শেষে ও বসন্তের শুরুর দিকে এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। প্রায় 25 কিমি উচ্চতায় মাত্র 48 ঘণ্টার ব্যবধানে তাপমাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে -80° সেঃ থেকে বেড়ে প্রায়-40° সেঃ-তে পৌঁছায়। ফলে উর্ধ্বাকাশে বায়ু সঞ্চলনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
5. মেরু অঞ্চলে বসন্তকালে ট্রপোপজের উচ্চতা কমে আসে। উপরন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আবহাওয়াগত গোলযোগের কারণে বায়ু সঞ্চলনের ফলে কিছু পরিমাণ জলীয় বাষ্প স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে প্রবেশ করে এবং ঘনীভবনের কারণে সিরাস মেঘের সৃষ্টি হয়। যেহেতু এই স্তরে ধুলিকণার উপস্থিতি খুব একটা থাকে না তাই এই মেঘ কোনোপ্রকার বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। সাদা রঙের এই সিরাস মেঘকে mother-of-pearl বলে।
6. স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে উচ্চতার তারতম্যে বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতিরও পরিবর্তন হয়। নিম্ন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে 30 কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুর গতিবেগ উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। কিন্তু এর পর থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ বাড়ে। এখানে 18-30 কিমি উচ্চতায় 12-30 মাস বায়ু উল্টোদিক প্রবাহিত হয়। বায়ুর এই উল্টো গতিপথ প্রথমে উচ্চস্তর থেকে ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকে।
■ স্ট্যাটোপজ (Stratopause):
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্বসীমাকে স্ট্র্যাটোপজ বলা হয়। স্ট্র্যাটোপজের গড় উচ্চতা ভূপৃষ্ঠ থেকে 50 কিমি। স্ট্যাটোস্ফিয়ারে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উয়তা বাড়তে বাড়তে স্ট্র্যাটোপজে এসে ০° সেঃ-তে পৌছায়। এরপর উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে উন্নতা দ্রুত হ্রাস পায়।
(c) মেসোস্ফিযার (Mesosphere):
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওপরে অবস্থিত সবচেয়ে শীতল বায়ুমণ্ডলের তৃতীয় স্তরটি হল মেসোস্ফিয়ার। গ্রিক শব্দ 'Meso'-এর অর্থ হল middle বা মধ্যম। এই স্তরটি মোটামুটিভাবে বায়ুমণ্ডলের মাঝামাঝি অবস্থান করে। আবার, এই স্তরটি দুটি উন্ন স্তরের মধ্যবর্তী একটি শীতল স্তর। এই কারণেও এর নাম মেসোস্ফিয়ার।
• বৈশিষ্ট্য:
1. এই স্তরটি স্ট্যাটোপজ থেকে ৪০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত লক্ষ করা যায়।
2. উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং ৪০ কিমি উচ্চতায় তাপমাত্রা কমে প্রায় -90° সেঃ-তে এসে পৌছায়। এই স্তরটি বায়ুমণ্ডলের সর্বাধিক শীতলতম স্তর। উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুর চাপ দ্রুত হারে কমতে থাকার কারণেই সম্ভবত উন্নতা এত দ্রুত হ্রাস পায়।
3. এই স্তরে বায়ুর চাপ এতটাই কমতে থাকে যে 50 কিমি উচ্চতায় যেখানে বায়ুর চাপ সমুদ্র সমতলের বায়ুর চাপের ¹/ 10m ভাগ অর্থাৎ 1 মিলিবার" সেখানে ৪০ কিমি উচ্চতায় চাপ কমে দাঁড়ায় ¹/ 1000 ভাগ অর্থাৎ 0.01 মিলিবার।
4. বায়ুমণ্ডলের এই স্তরটিতে মহাকাশ থেকে যে সমস্ত উল্কাপিন্ড পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে সেগুলি মেসোস্ফিয়ারে প্রবেশ করে বায়ুর সঙ্গে সংঘর্ষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
5. মেসোস্ফিয়ারে মাঝে মধ্যে মেঘ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। প্রধানত এই স্তরে কিছু পরিমাণে জলীয় বাষ্পের অনুপ্রবেশ ঘটে যা উল্কাপিণ্ড জাত ধুলিকণা এবং উচ্চ বায়ুস্তরের ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন স্রোতের প্রভাবে সৃষ্টি হয়। কিন্তু অত্যন্ত ঠান্ডার কারণে মেঘে অবস্থিত জলকণাগুলি বরফকণায় পরিণত হয়। এই বরফকণা সমৃদ্ধ পাতলা সিরাস মেঘের স্তর Noctilucent নামে পরিচিত। সাধারণত সূর্যাস্তের পর গোধুলির সময় এই মেঘ থেকে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ পৃথিবী থেকে দেখা যায় বলে এটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সূর্য 4°-16° দিগন্তরেখার (Horizon) নিচে থাকলে এই মেঘ স্পষ্ট বোঝা যায়।
■ মেসোপজ (Mesopause):
মেসোস্ফিয়ারের সর্বোচ্চ সীমায় যেখানে উন্নতা আর হ্রাস পায় না, সেই প্রান্তিক স্তরকে মেসোপজ বলে। এরপর থেকে উন্নতা পুনরায় বাড়তে থাকে। এটি প্রধানত একটি সমতাপ অঞ্চল (Isothermal Region)। মেসোপজই হল প্রকৃতপক্ষে সমমণ্ডলের (Homosphere) শেষ সীমা। এরপর থেকেই মূলত বিষমমণ্ডলের (Heterosphere) স্তর শুরু হয়।
(d) থার্মোস্ফিয়ার (Thermosphere):
মেসোস্ফিয়ারের ওপরে অবস্থিত সর্বনিম্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট এবং সর্বাধিক উয়তা বিশিষ্ট বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরটির নাম থার্মোস্ফিয়ার।
• বৈশিষ্ট্য:
1. বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরে উন্নতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। 120 কিমি উচ্চতায় তাপমাত্রা যেখানে প্রায় 500° সেঃ থাকে, 200 কিমি উচ্চতায় তা বেড়ে দাঁড়ায় 700° সেঃ এবং 480 কিমিতে তাপমাত্রা পৌঁছায় প্রায় 1232° সেঃ। তবে সৌরকলঙ্কের অবস্থানের পরিবর্তনে এই অংশের তাপমাত্রারও পরিবর্তন ঘটে। উন্নতা খুব বেশি থাকার কারণেই এই স্তরের নাম থার্মোস্ফিয়ার।
2. তবে 480 কিমির পর উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা তেমন বাড়েও না আবার কমেও না-প্রায় একই রকম থাকে। তাই এই অংশকে সমতাপ অঞ্চল (Isothermal Region) বলে। এই কারণে আবহবিদগণ এই অংশকে থার্মোস্ফিয়ারের অন্তর্ভুক্ত করতে পক্ষপাতী নন।
3. থার্মোস্ফিয়ারের অনবরত সৌর ঝড় (Solar wind)-এর প্রভাবে উচ্চশক্তিসম্পন্ন গামা (y-ray) ও রঞ্জন- 1 রশ্মির (x-ray) প্রভাবে গ্যাসীয় অণুগুলি ভেঙে গিয়ে আয়নিত হয়ে পড়ে এবং সর্বদা আণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এই স্তরে অনবরত উন্নতা বাড়তে থাকে।
4. থার্মোস্ফিয়ারে 90-120 কিমি উচ্চতার মধ্যে নাইট্রোজেন অণু ও 200-1100 কিমি উচ্চতার মধ্যে অক্সিজেন পরমাণুর প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।
5. থার্মোস্ফিয়ারের 90-400 কিমি উচ্চতার মধ্যে সূর্য থেকে আগত গামা ও রঞ্জন রশ্মির প্রভাবে গ্যাসীয় অণুগুলি বিশ্লিষ্ট হলে তড়িৎগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই এই স্তরকে আয়নমণ্ডল বা আয়নোস্ফিয়ার (Ionosphere) বলে। এই আয়নমণ্ডলে মুক্ত ইলেকট্রনের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রেরিত দীর্ঘ তরঙ্গের বেতারতরঙ্গ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় প্রতিফলিত হয়ে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। ফলে আমরা বেতার ও দূরভাষে শব্দ শুনতে পাই। ইলেকট্রনের ঘনত্বের পার্থক্যের ভিত্তিতে আয়নমণ্ডলকে D, E, F, G ও H-এই পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়।
6. উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলে একটানা 6 মাস রাত্রি চলাকালীন একধরনের আলোক প্রভা দেখা যায়। একে মেরুজ্যোতি (aurora) বলে। এই মেরুজ্যোতি সৃষ্টি হয় থার্মোস্ফিয়ার স্তরেই। সৌর ঝড়ের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসগুলি বিশেষত অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন অণু আয়নিত হয়ে বিভাজিত হয়ে পড়ে। ফলে মুক্ত ইলেকট্রনগুলি পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের দ্বারা আকর্ষিত হয়ে তীব্র গতি লাভ করে এবং দুই মেরু অঞ্চলে অতিদ্রুত 300 কিমি উচ্চতা থেকে 100 কিমি উচ্চতায় নেমে আসে। এই সময় এই ইলেকট্রনগুলি পারস্পরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে আলোর সৃষ্টি করে। সুমেরু অঞ্চলে এই আলোক প্রভাকে সুমেরু প্রভা (Aurora Borealis) এবং কুমেরু অঞ্চলে এই আলোক প্রভাকে কুমেরু প্রভা (Aurora Australis) বলে।