welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ঘূর্ণবাতের আধুনিক ধারণাসমূহ (cyclone Modern theories):

ঘূর্ণবাতের আধুনিক ধারণাসমূহ (cyclone Modern theories):


মেরু সীমান্ত তত্ত্ব (The Polar Front theory) :

নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি সম্পর্কে সর্বপ্রথম একটি যুক্তিগ্রাহ্য পূর্ণাঙ্গ ধারণার অবতারণা করেন নরওয়ের একদল আবহবিজ্ঞানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই 1922 খ্রিস্টাব্দে তাঁদের এই তত্ত্বটি মেরু সীমান্ত তত্ত্ব (Po- lar front theory) নামে প্রকাশিত হয়। নরওয়ের "Bergen School of Metorologists"-এ একদল আবহবিদ, ভিলেম বার্কনেস (Vilhelm Bjerkness) ও তাঁর পুত্র জেকব বার্কনেস (Jakob Bjerkness), হ্যালভর সোলবার্গ (Halvor Solberg) এবং টর বার্জেরন (Tor Bergeron) নরওয়ের ওপর বিকাশমান নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে এবং বিভিন্ন আবহাওয়াকেন্দ্র (Weather station) থেকে দীর্ঘ 50 বছরেরও বেশি সময় ধরে তথ্য সংগ্রহ করে ঘূর্ণবাত বিকাশের এই তত্ত্বটির উপস্থাপনা করেন। বার্জেন স্কুলের আবহবিদগণ ঘূর্ণবাতের এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করায় এই তত্ত্বটিকে বার্জেন তত্ত্বও (Bergen theory) বলা হয়। আবার, নরওয়ে আবহবিদের দ্বারা এই তত্ত্বটির উদ্ভাবন হওয়ায় তত্ত্বটিকে নরওয়েজীয় মডেলও (Norwegian Model) বলা হয়। এই তত্ত্বে যেহেতু উয় ও শীতল বায়ুপুঞ্জ মেরু সীমান্ত বরাবর তরঙ্গাকারে বিস্তার লাভ করে ঘূর্ণবাতের বিকাশ ঘটায়, তাই এই তত্ত্বকে আবার তরঙ্গ তত্ত্বও (Wave theory) বলা হয়। তবে তত্ত্বটির সর্বাধিক প্রচলিত নাম হল মেরু সীমান্ত তত্ত্ব (Polar front theory)। দুটি ভিন্ন উয়তা ও ভিন্ন ঘনত্বের বায়ুপুঞ্জ মেরুবৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ে সীমান্ত সৃষ্টির দ্বারা ঘূর্ণবাতের বিকাশ ঘটানোয় এই তত্ত্বটির নাম দেওয়া হয়েছে মেরু সীমান্ত তত্ত্ব। 

নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র (Life cycle of Extratropical cyclone) :


বার্কনেস ও সোলবার্গ 1922 সালে প্রকাশিত "Life cycle of cyclones and the polar front theory" শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রথম নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বিকাশের মেরু সীমান্ত তত্ত্বটি (Polar Front Theory) জনসমক্ষে আনেন এবং এই নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত কীভাবে বিকাশ লাভ করে এবং বিলুপ্ত হয়, তা চিত্রের সাহায্যে কতকগুলি পর্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা (চ) করেন। নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলি হল। 

(i) ঘূর্ণবাত বিকাশের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে দুটি ভিন্ন তাপমাত্রা ও ভিন্ন ঘনত্ব বিশিষ্ট বায়ুপুঞ্জ পরস্পরের বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। এই দুটি বায়ুপুঞ্জ প্রায় সরলরৈখিক একটি সীমারেখা দ্বারা পরস্পর থেকে আলাদাভাবে অবস্থান করে। এই ধরনের সীমান্তকে স্থানু/স্থিতিশীল সীমান্ত (Stationary front) বলে। স্থানু সীমান্তের উত্তরে শীতল পুবালি মেরুবায়ু ও দক্ষিণে উষু পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়। এই দুই প্রকার বায়ুপুঞ্জ ভিন্ন উন্নতা ও ঘনত্ব বিশিষ্ট হওয়ায় কখনোই একে অপরের সঙ্গে মিশে যায় না, বরং সীমান্তের সৃষ্টি করে।


(ii) এর পরবর্তী পর্যায়ে ঘূর্ণবাত যখন বিকাশলাভ করতে শুরু করে তখন সরলরৈখিক এই স্থানু সীমান্তের রেখাটি শীতল বায়ুপুঞ্জের দিকে বাঁক নিতে শুরু করে এবং উয় বায়ুপুঞ্জটি উত্তরমুখী হয়ে জিহ্বার মতো একটি উপাংশের সৃষ্টি করে। ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রটি এই উপাংশটির ঠিক মাথায় অবস্থান করে। উষু বায়ুপুঞ্জটির ঘনত্ব কম হওয়ায় সেটি হালকা হয়। তাই এটি শীতল বায়ুপুঞ্জটির গা বেয়ে



মেরুসীমান্ত তত্ত্ব অনুযায়ী নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়

ঊর্ধ্বমুখী হতে বাধ্য হয়। এই ঊর্ধ্বমুখী হালকা উয় বায়ুর অগ্রভাগকেই উয় সীমান্ত (Warm front) বলে। অন্যদিকে শীতল বায়ুপুঞ্জটি ভারী হওয়ায় উয় বায়ুপুঞ্জের গা বেয়ে নিম্নমুখী হয়। এই শীতল বায়ুপুঞ্জের অগ্রভাগই শীতল সীমান্ত (Cold front)। এভাবে সাম্য সীমান্তটির বক্রতা বৃদ্ধি পেয়ে উয় ও শীতল-এই দুটি সীমান্তে ভাগ হয়ে যায় ।

(iii) এভাবে উয় বায়ুপুঞ্জটি আরও উত্তরমুখী হলে উয় তরঙ্গটির বক্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। শীতল বায়ুর গতিবেগ উয় বায়ুর তুলনায় অধিক হওয়ায় অধিক বাঁক নিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এসে ঘূর্ণবাতের শীর্ষবিন্দুর পিছন দিক থেকে উয় বায়ুর উপরিভাগকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। ফলে উয় সীমান্তের ক্ষেত্রটি ছোটো হতে শুরু করে এবং সীমান্তের বক্রতা বাড়তে থাকে। এভাবে ক্রমশ একটি আদর্শ ঘূর্ণবাত বিকাশ লাভ করে।

(iv) পরবর্তী পর্যায়ে অধিক গতিশীল শীতল বায়ুতরঙ্গ আরও বেশি বক্রতা লাভ করে উয় ক্ষেত্রটিকে ঘিরে ফেলতে থাকায় উয় ক্ষেত্রটি আরও ছোটো হতে থাকে। উয় ক্ষেত্রটির দক্ষিণভাগে অর্থাৎ নীচের দিকে এই সংকীর্ণতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি হতে থাকে। অর্থাৎ, ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে উয় ও শীতল সীমান্তটি আরও বেশি কাছে চলে আসে।

(v) ঘূর্ণবাত আরও বিকাশ লাভ করলে দ্রুতগামী শীতল বায়ুপুঞ্জটি উয়বায়ুর অংশটিকে একসময় সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলে এবং শীতল সীমান্তটি উয়ভাগের নীচের দিক থেকে অগ্রসর হয়ে উয় সীমান্তকে অতিক্রম করে। এই অবস্থাকে বার্কনেস 'Secluded' বলে অভিহিত করেন। কারণ এই অবস্থায় ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র সংলগ্ন উয় ভাগটি মূল উয় বায়ুপুঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তা বোঝানোর জন্য বার্কনেস 'Secluded' শব্দটি ব্যবহার করেন

(vi) এভাবে ধীরে ধীরে আরও সময় অতিবাহিত হলে উয় ও শীতল সীমান্ত দুটি ক্রমশ মিশে এক হতে থাকে এবং মাঝখানের উয় ভাগটি একেবারে অবলুপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভূমিভাগে সমস্ত অংশটাই শীতল বায়ুপুঞ্জ দ্বারা অধিকৃত হয়। এইভাবে দুটি সীমান্ত এক হয়ে একটি স্বতন্ত্র সীমান্তের উদ্ভব ঘটায়। একেই বার্কনেস অক্লুডেড সীমান্ত (Occluded front) বলে অভিহিত করেছেন এবং সীমান্ত সৃষ্টি হওয়ার ঘটনাকে বলেছেন অক্লসন (Occlusion)। এই অক্লুডেড সীমান্তটি বেশ খানিকক্ষণ স্থায়ী থাকে।

(vii) অবশেষে, অক্লুডেড সীমান্তটি বিলুপ্ত হয় এবং সম্পূর্ণ ঘূর্ণবাতটিতে শীতলবায়ুর কেন্দ্রমুখী আবর্ত (Symmetrical Vortex) তৈরি হয়। 

viii) সবশেষে শীতল বায়ুর ঘূর্ণায়মান আবর্তটি দুর্বল হতে থাকে, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সংগঠিত প্রবল বৃষ্টিপাত একেবারেই কমে যায়। তবে কিছু কিছু স্থানে তখনও হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টিপাত লক্ষ করা যায়। এই অবস্থাটি ঘূর্ণবাতের সম্পূর্ণ মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে।


★নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদ (Vertical Section of deve- lopment of a temperate cyclone) :


বার্কনেস মেরু সীমান্ত তত্ত্বে ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র আলোচনা করার সময় নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বিকাশের পর্যায়গুলিকে আরও জোরালো এবং বাস্তবসম্মত করে তুলতে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিটি পর্যায়ের উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদ অঙ্কন করেছেন। এর জন্য ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র থেকে দক্ষিণে একটি প্রস্থচ্ছেদের কল্পনা করেন এবং প্রতিটি পর্যায়ে প্রস্থচ্ছেদটির উল্লম্ব গঠনটিকে উত্তর অভিমুখে পর্যবেক্ষণ করলে আবহাওয়াগত অবস্থার কীরূপ পরিবর্তন ঘটে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। চিত্রগুলি থেকে স্পষ্ট যে উন্ন সীমান্তের ক্ষেত্রে সমোন্নরেখাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সমান্তরালে এবং ভূভাগের সঙ্গে অনুভূমিকভাবেই অবস্থান করে। এই সমোয়রেখাগুলি যখনই সীমান্তকে স্পর্শ করে তখনই সীমান্তের ঢালকে অনুসরণ করে নিম্নমুখী হয়। খানিকটা নিম্নমুখী হওয়ার পর ঠিক নীচের স্তরে রেখাগুলি সীমান্ত ত্যাগ করে শীতলভাগে পৌঁছালে পুনরায় পরস্পরের সমান্তরালে ভূমির সঙ্গে পুনরায় অনুভূমিকভাবে বিস্তার লাভ করে। বার্কনেসের মতে, উয় ক্ষেত্রের দুই পাশের শীতল বায়ুর অংশে তাপীয় অবস্থা প্রায় একই রকমের হয়। তাই একই মানের সমোেয়রেখাগুলির উচ্চতার তেমন কোনো পার্থক্য হয় না। 



মেরু সীমান্ত তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রে বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লম্ব প্রস্রচ্ছেদ

ঘূর্ণবাতের জন্ম থেকে শুরু করে অক্লুশান পর্যায় পর্যন্ত উয়ু বায়ু হালকা ও কম ঘনত্ব বিশিষ্ট হওয়ায় সীমান্ত বরাবর শীতল বায়ুর সাপেক্ষে ঊর্ধ্বমুখী হয়। উয় বায়ুর এই ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার কারণে বায়ুমধ্যস্থ স্থৈতিকশক্তি গতিশক্তিতে পরিণত হতে শুরু করে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত ঘূর্ণবাত অক্লুসন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় ততক্ষণ গতিশক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে। অনুরূপভাবে দ্রুতগতিসম্পন্ন শীতল বায়ু ভারী ও অধিক ঘনত্বযুক্ত হওয়ায় শীতল সীমান্ত বরাবর নিম্নমুখী হতে থাকে। এভাবে নিম্নমুখী শীতল বায়ু ভূমিভাগ স্পর্শ করলে অক্লুসন অবস্থা শুরু হয়। এই সময়ে শীতল বায়ুর অধোগামী অবস্থা বন্ধ হলেও উয় বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ তখনও বজায় থাকে। শীতল বায়ু ক্রমে ভূমিভাগ দখল করায় উষু বায়ুর ভাগ কমতে থাকে এবং এই শীতল বায়ুই উয় বায়ুকে আরও ওপরের দিকে ঠেলতে থাকে। এই প্রক্রিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ না উয় বায়ু অ্যাডিয়াবেটিক প্রক্রিয়ায় শীতল হয়ে তার চারদিকে ঘিরে থাকা বায়ুপুঞ্জের উন্নতার সমতুল্য না হয়। এভাবে ঘূর্ণবাতের চারদিকে উত্তাপের ভারসাম্য এলে বায়ুমণ্ডলে স্থিতিশীলতা আসে এবং ঘূর্ণবাতের সমস্ত স্থৈতিক শক্তি শেষ হয়ে যায় এবং ঘূর্ণবাতটি সম্পূর্ণ হয়।
              অক্লুসনের পর শীতল বায়ুপুঞ্জের অভিকর্ষের বিপরীতে ঊর্ধ্বমুখী উত্থানও ঘূর্ণবাত সম্পাদনে সাহায্য করে। এই উত্থান ঘূর্ণবাতে উপস্থিত গতিশক্তিকে নষ্ট করে ঘূর্ণবাতকে দুর্বল করতে থাকে। সাধারণত অ্যাডিয়াবেটিক পদ্ধতিতে শীতল হওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী শীতল বায়ু তার পারিপার্শ্বিক বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণতার তুলনায় শীতল হয়ে পড়ে কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘূর্ণবাতের মধ্যে তৈরি হওয়া গতিশক্তি অভিকর্ষজ বলের বিরুদ্ধে শীতল বায়ুকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে। এভাবে শীতল বায়ুর ঊর্ধ্বপ্রবাহ ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ গতিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট না হয়। একসময় স্থৈতিক শক্তি শেষ হলে এর গতিশক্তিতে রূপান্তর বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে শীতল বায়ুকে ওপরে তুলতে সহায়তাকারী গতিশক্তির পরিমাণ শেষ হয়ে পড়ে। পরিণামে ঘূর্ণবাতের সমস্ত শক্তিই নিঃশেষ হয়ে যায়।

এভাবে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চলে সীমান্ত সৃষ্টির প্রক্রিয়া (frontogenisis) দ্বারা উয় বায়ুকে সীমান্ত বরাবর ঊর্ধ্বমুখে চালিত করে বায়ুতে অবস্থিত স্থৈতিক শক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তর দ্বারা নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সম্পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। আবার, অক্লুসনের পর ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে উর্ধ্বমুখী উয় বায়ুর অ্যাডিয়াবেটিক পদ্ধতিতে শীতলীকরণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা লাভ করে গতিশক্তি পুনরায় স্থৈতিক শক্তিতে রূপান্তর এবং নিম্ন বায়ুমণ্ডলে সীমান্ত বরাবর শীতল বায়ুকে অভিকর্ষের বিপরীতে ওপরের দিকে চালিত করে গতিশক্তি ক্ষয়ের দ্বারা ঘূর্ণবাতটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01