ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত উৎপত্তির শর্ত (Conditions for the development of Tropical cyclone) :
ক্রান্তীয় অঞ্চলে কীভাবে ঘূর্ণবাতের বিকাশ ঘটে তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তবে আবহবিদগণের ও বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বিকাশের কতকগুলি শর্ত সামনে আসে। এগুলি হল-
1. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাপ ও লীনতাপ সরবরাহ (Supply of sensible and latent heat):
ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উন্নতা ন্যূনতম 26° সেঃ থাকা বাঞ্ছনীয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর তাপমাত্রা 27° সেঃ হলে ঘূর্ণবাত বিকাশের আদর্শ অবস্থা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের এই উয়তা জলের বাষ্পীভবনে সাহায্য করে জলীয় বাষ্পের জোগান অব্যাহত রাখে। এই জলীয় বাষ্পই ঘূর্ণবাত সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় লীনতাপের (Latant heat) জোগান দেয়। নিম্ন বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের জোগান যত বাড়ে ঊর্ধ্ব আকাশে ঘনীভবন প্রক্রিয়া ততই দ্রুত ঘটতে থাকে। জলীয় বাষ্প দ্রুত ঘনীভবনের ফলে লীনতাপ ত্যাগ করায় ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণ লীনতাপ জমা হয়। এই লীনতাপ ঘূর্ণবাতে শক্তির জোগান অব্যাহত রেখে ঘূর্ণবাতকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। গ্রীষ্মের শেষে কিংবা শরতের শুরুতে ক্রান্তীয় সমুদ্র সবচেয়ে বেশি উয় থাকে। ফলে বেশির ভাগ ঘূর্ণবাতের বিকাশ এই সময়েই ঘটে।
2. উয় জলের গভীরতা (Depth of warm water):
সমুদ্রের উদ্বুজলের (27° সেঃ) গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে 60-70 মিটার গভীর হওয়া আবশ্যক। তা না হলে গভীর পরিচলন স্রোতের কারণে নীচের শীতল জল ওপরে উঠে আসবে। ফলে জলের বাষ্পীভবন প্রক্রিয়া বাধা পেয়ে ঘূর্ণবাতে লীনতাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে এবং ঘূর্ণবাত বিলীন হয়ে যাবে।
3. বায়ুমণ্ডলের নীচুস্তরে প্রাক-গোলযোগের উপস্থিতি (Presence of pre-existing low-level disturbances):
একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হতে গেলে নিম্নবায়ুমণ্ডলে দুর্বল প্রাক্-গোলযোগের উপস্থিতি বিশেষভাবে প্রয়োজন। গ্রীষ্মের সময় ITCZ-এর উত্তর গোলার্ধে অবস্থানের কারণে জলভাগের ওপর প্রবাহিত পুবালি বায়ুতরঙ্গের (Easterly wave) সঙ্গে জলভাগের উয়তার স্থানীয় পার্থক্যের ফলে ছোটো ছোটো অনেকগুলি বজ্রঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়। এর ফলে গ্রীষ্মের শেষে বা শরতের শুরুতে বজ্রঝঞ্ঝার পরিত্যক্ত নিম্নচাপকক্ষগুলি দুর্বল অবস্থায় পড়ে থাকে। এই দুর্বল ছোটো ছোটো নিম্নচাপ কক্ষগুলিই পরবর্তীকালে উন্ন সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে ভয়াবহ ঘূর্ণবাতের বিকাশ ঘটায়।
4. ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গোলযোগের উপস্থিতি (Presence of disturbances in the upper atmos- phere):
নিম্নবায়ুমণ্ডলের গোলযোগগুলি এককভাবে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের বিকাশ ঘটাতে পারে না। এর জন্য ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলেও গোলযোগের উপস্থিতি প্রয়োজন। ঊর্ধ্বট্রপোস্ফিয়ারে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের পরিত্যক্ত ট্রাফ (trough) এই অভাব পুরণ করে। এই ট্রাফগুলির কেন্দ্রে শীতল বায়ুর (Cold core) অবস্থানের কারণে নিম্নবায়ুমণ্ডলের সঙ্গে তাপমাত্রার এক বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়। ফলে বায়ুপুঞ্জের তাপবিযুক্তি হার (lapse rate) বৃদ্ধি পেলে বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়।
5. কোরিওলিস বল (Coriolis parameters):
ঘূর্ণাবর্ত (Cyclonic Vortex) সৃষ্টির জন্য ন্যূনতম কোরিওলিস বল প্রতি সেকেন্ডে 105 ডাইন হওয়া বাঞ্ছনীয়। নিরক্ষরেখায় কোরিওলিস বলের মান 'শূন্য' হওয়ায়, নিরক্ষীয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাত কদাচিৎ বিকাশ লাভ করে। কিন্তু অক্ষাংশ (৫) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে sino-এর মান বৃদ্ধি পাওয়ায় কোরিওলিস বল দ্রুত বাড়তে থাকে এবং 5° অক্ষাংশ অতিক্রম করলেই কোরিওলিস বল ঘূর্ণবাত বিকাশের সঙ্কটমানে (criti- cal value) এসে পৌছায়। এই কারণেই প্রায় 65 শতাংশ ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতই 10° থেকে 20° অক্ষাংশের মধ্যে বিকাশ লাভ করতে দেখা যায়। তবে অক্ষাংশের মান বৃদ্ধিতে কোরিওলিস বল বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য কারণের ঋণাত্বক প্রভাবে উচ্চ অক্ষাংশের দিকে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের প্রকোপ হ্রাস পায়। কারণ অক্ষাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের পতনকোণ হ্রাস পাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ শীতল হতে শুরু করে। ফলস্বরূপ জলভাগ থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাপ ও জলীয় বাষ্পের জোগান কমতে শুরু করে। ফলে ঘূর্ণবাতের শক্তি কমতে থাকায় ঘূর্ণবাতও দুর্বল হয়ে পড়ে।
6. বাতাসের ন্যূনতম উল্লম্ব বিভেদন (Minimal vertical wind shear) :
বায়ুর উল্লম্ব বিভেদন বলতে বোঝায় উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের দিক ও গতির পরিবর্তন। নিম্নবায়ুমণ্ডলের সাপেক্ষে ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলে বিপরীত মুখী বায়ুপ্রবাহ থাকলে ঘূর্ণবাত বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় না। এই ধরনের বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ উর্দ্ধবায়ুমন্ডলে অবস্থিত উষ্ণ কেন্দ্রগুলিকে (warm core) তাড়িয়ে অন্যত্র নিয়ে চলে যায়। ফলে ঘূর্ণবাত বিকাশে বাধা পায়। অন্যদিকে বায়ুর উল্লম্ব বিভেদন না থাকলে উয়কেন্দ্রগুলি ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং ঘূর্ণবাতকে সক্রিয় রাখে। এই কারণে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ সংলগ্ন সমুদ্রে জলের উন্নতা ও কোরিওলিস বল পর্যাপ্ত থাকলেও ভূপৃষ্ঠ বরাবর উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলে পশ্চিমা বায়ুর প্রবাহের কারণে ঘূর্ণবাত কদাচিৎ বিকাশ লাভ করে। অনুরূপভাবে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গ্রীষ্মকালে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এবং ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বায়ুপ্রবাহের কারণে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ঘটে না।
7. ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে কেন্দ্র বহির্মুখী বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি (Divergence in upper troposphere):
ঘূর্ণবাতের শক্তি অব্যাহত থাকার জন্য ট্রপোস্ফিয়ারের ওপরের দিকে কেন্দ্রবহির্মুখী বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি আবশ্যিক। কারণ ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে কেন্দ্রবহির্মুখী বায়ুপ্রবাহ নিম্নবায়ুমণ্ডলে নিম্নচাপ কেন্দ্রকে আরও গভীর করে তোলে এবং বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী কুণ্ডলী প্রবাহকে বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪. বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতার উপস্থিতি (Existance of High humidity level):
একটি শক্তিশালী ঘূর্ণবাত সৃষ্টির জন্য মধ্য ট্রপোস্ফিয়ারে আর্দ্রতা অধিক থাকা বাঞ্ছনীয়। জলীয় বাষ্পের জোগান বেশি হলে দ্রুত কিউমুলোনিম্বাস মেঘ বিকাশ লাভ করতে পারে এবং এর ফলে ঘূর্ণবাত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে তবে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ সৃষ্টিতে বাধা পায়। বায়ুতে আপেক্ষিক আর্দ্রতা 50-60%-এর কম হলে পরিচলন প্রক্রিয়ার অভাবে মহাসাগরীয় অঞ্চলে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ সৃষ্টিতে বাধা পেয়ে ঘূর্ণবাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।