বজ্রঝড়ের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Thunderstorm):
উৎপত্তি ও গঠনের ওপর ভিত্তি করে বজ্রঝড়কে প্রধানত দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা- (একটি ছকের মাধ্যমে শ্রেণিবিভাজনটি দেখানো হল)
(A) বায়ুপুঞ্জ বজ্রঝড় (Airmass thunderstorm) :
বায়ুপুঞ্জ বজ্রঝড় মূলত বায়ুপুঞ্জের মধ্যেই যখন বায়ুর উল্লম্ব স্থানান্তর হয় তখনই সৃষ্টি হয়। স্থানীয় উন্নতার বৃদ্ধি, পর্বতের অবস্থান এবং উচ্চ আকাশে বায়ুর সমান্তরাল প্রবাহ প্রভৃতি কারণে এই ঝড় সৃষ্টি হয়।
(i) স্থানীয় উয়তার পার্থক্যজনিত কারণে সৃষ্ট বজ্রঝড় (Local heat thunderstorm):
গ্রীষ্মকালে প্রখর সৌরতাপে স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয় এবং সংলগ্ন বায়ু এই তাপ গ্রহণ করে হালকা হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বায়ু ওই স্থান দখল করতে ছুটে আসে এবং সেটিও উয় ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে উত্তপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। এর প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে তাপীয় পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয়। এভাবে বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিরতা (unstable) তৈরি হলে বজ্রঝড় সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। সাধারণত এই হালকা, উয়, ঊর্ধ্বমুখী বাতাস একটি শক্তিশালী পরিচলন কোশ বা চক্র সৃষ্টি করে, যার জন্য এই বজ্রঝড় ঘটে থাকে। উদাহরণ-নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে এই কারণে সারাবছর ধরেই বজ্রঝড়ের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মধ্য-অক্ষাংশীয় অঞ্চলে শুধুমাত্র গ্রীষ্মঋতুতেই বজ্রঝড় দেখা যায়। উভয় গোলার্ধে 45° অক্ষরেখার ঊর্ধ্বে এই ধরনের কোনোপ্রকার বজ্রঝড় সৃষ্টি হয় না।
(ii) পর্বত সহযোগী বজ্রঝড় (Mountain associated thunderstrom):
উয় ও আর্দ্র বায়ু পর্বতের প্রতিবাত ঢালে ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠতে বাধ্য হলে দ্রুত শীতলীভবনের জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে পড়ে। এভাবে বায়ুর ক্রমাগত ঘনীভবনের জন্য সৃষ্ট লীনতাপ বায়ুর উত্থানকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং ধীরে ধীরে বজ্রগর্ভ মেঘের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের বজ্রগর্ভ মেঘ থেকে প্রবল শিলাবৃষ্টি সংঘটিত হয়। স্থানীয় বায়ুর উত্থানের কারণে এবং অতিদ্রুত ঘনীভবন ঘটার ফলে এই বজ্রঝড় অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। উদাহরণ-ভুটানে এই কারণে সর্বদা বজ্রগর্ভ মেঘ সৃষ্টি হওয়ায় ঘন ঘন বজ্রপাত লক্ষ করা যায়। তাই ভুটানকে এশিয়ার 'Land of thunder' বলা হয়।
(iii) বায়ুর সমান্তরাল প্রবাহজনিত বজ্রঝড় (Advection thunderstrom):
ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু ওপরের বায়ুস্তরের তুলনায় উয় হলে বায়ুমণ্ডলে খাড়া তাপীয় অবক্রমের সৃষ্টি হয়। এই অবক্রমের হার আরও বৃদ্ধি পেলে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুর ঘনীভবন প্রক্রিয়া আরও দ্রুতগতিতে চলে এবং বজ্রগর্ভ মেঘ সৃষ্টির আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। সাধারণত প্রখর সূর্যের উত্তাপে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হওয়ায় ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু উত্তপ্ত হয়ে এই ধরনের খাড়া ঢালযুক্ত বায়ুচাপের অবক্রম সৃষ্টি করে।
(B) সীমান্তীয় বজ্রঝড় (Frontal thunderstorm):
সীমান্ত বরাবর উয়বায়ু ঊর্ধ্বমুখী হলে দ্রুত শীতলীভবনের কারণে বজ্রগর্ভ মেঘ এবং বজ্রঝড় সৃষ্টি হতে দেখা যায়। একেই সীমান্তীয় বজ্রঝড় বলে। সাধারণত তিন ধরনের সীমান্তীয় বজ্রঝড় সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যথা- (i) শীতল সীমান্তীয় বজ্রঝড়, (ii) উয় সীমান্তীয় বজ্রঝড় এবং (iii) প্রাক্-সীমান্তীয় বজ্রঝড়।
(i) শীতল সীমান্তীয় বজ্রঝড় (Cold front thunderstorm): নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত বিকাশের পরিণত
পর্যায়ে যখন শীতলবায়ু উয়বায়ুকে ঘিরতে শুরু করে তখন শীতলবায়ুর তাড়নায় উয়বায়ু সম্মুখে অবস্থিত শীতল সীমান্তের তল বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে বাধ্য হয়। এই তীক্ষ্ণ ঢালযুক্ত শীতল সীমান্তের ওপরে উয়বায়ু ও নীচে শীতল বায়ু অবস্থান করায় নিম্ন বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের উয়তার পার্থক্য তৈরি হয়। এর ফলে তৈরি হওয়া চরম অস্থিতিশীল পরিবেশে (unstable condition) বায়ু দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঘনীভূত হয় এবং ঘনীভবনের ফলে সৃষ্ট লীনতাপের শক্তির প্রভাবে শক্তিশালী বজ্রঝড়ের সৃষ্টি হয়। দিন বা রাত যে-কোনো সময়েই এই বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে।
(ii) উয় সীমান্তীয় বজ্রঝড় (Warm front thunderstorm):
শীতল বায়ুপুঞ্জের ওপর উয় সীমান্ত বরাবর উয় বায়ু ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলে অস্থিতিশীল পরিবেশে বজ্রঝড় সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়। তবে এই ধরনের বজ্রঝড় খুব একটা শক্তিশালী হয় না। এই বজ্রঝড়গুলি ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতেই সৃষ্টি হয়।
(iii) প্রাক্-সীমান্তীয় বজ্রঝড় (Pre-frontal thunderstorm):
প্রধানত শীতল সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার আগেই সংকীর্ণ বলয়ে বজ্রঝড় সৃষ্টি হতে দেখা যায়। পিটারসেন অনুযায়ী ঘূর্ণবাতের সম্মুখে Squal line থেকে শীতল ও উয় সীমান্ত পরস্পরকে ছেদ করায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে বজ্রঝঞ্ঝা তৈরি হয়।