ঘূর্ণবাত বিকাশের প্রাচীন তত্ত্ব (Classical Concept on development of Cyclone):
1. ডাভের ধারণা (Dove's Concept) 1827:
1827 সালে ডাভ (Dove) আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাচীন পদ্ধতিগুলিকে বাদ দিয়ে স্থানীয় পর্যবেক্ষণগুলিকে (Local synopsis) গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেন। প্রাশিয়ার আবহাওয়া দপ্তরের সঞ্চালক হিসেবে কার্যনির্বাহ করার সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্যগুলিকে পর্যালোচনা করে লক্ষ করেন যে, নাতিশীতোয় অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার পিছনে দায়ী দুটি ভিন্ন বায়ুস্রোত। একটি মেরু স্রোত (Polar Current) এবং অপরটি নিরক্ষীয় স্রোেত (Equatorial Current)। বস্তুত ডাভ প্রদত্ত ধারণাটিই ছিল তৎকালীন ইউরোপের নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত উৎপত্তির সর্বপ্রথম যুক্তিপূর্ণ একটি মডেল।
2. ফিটজরয়-এর ধারণা (FitzRoy's Concept), 1863 :
ডাভ-এর পর নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় 1863 সালে ব্রিটিশ আবহবিদ রবার্ট ফিজ় রয় (Robert FitzRoy)-এর কাছ থেকে। 1831 থেকে 1836 সাল পর্যন্ত চার্লস ডারউইন (Charles Darwin)-এর সঙ্গে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণের সময় ফিটক্রয় বিভিন্ন পরিবেশের আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানগুলির ওপর পর্যবেক্ষণ করেন এবং এর ফলে নাতিশীতোয় অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ বিকাশের একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মায়। এরপর 1954 সালে ব্রিটিশ আবহাওয়া দপ্তরের (British Meterological Department)-এর প্রথম সঞ্চালক (Director) হিসেবে নিযুক্ত হলে, তিনি নাতিশীতোঘ্ন অঞ্চলে কীভাবে গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়, সেই বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ডারউইনের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণের সময় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ফিজ়রয় এই সিদ্ধান্তে আসেন যে দুটি ভিন্ন উয়তা ও আর্দ্রতা সম্পন্ন বায়ুপুঞ্জের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলেই নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত
ফিটজরয় কৃত নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত মডেল |
বিকাশলাভ করে। এই দুই বায়ুপুঞ্জের প্রভাবে সৃষ্ট ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘূর্ণায়মান আবর্ত (Anticlockwise Vortex) ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করে (উত্তর গোলার্ধে)। উয়তার পার্থক্যই এই ঝড়বৃষ্টির প্রধান কারণ। উয় ও আর্দ্র বায়ুপুঞ্জ ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উত্তরমুখী এবং মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও শুষ্কবায়ু দক্ষিণমুখী হলে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে এদের সম্মিলনে গভীর নিম্নচাপের বিকাশ ঘটে। তবে তৎকালীন সময়ে উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে এবং খুব স্বল্পসংখ্যক আবহাওয়া কেন্দ্রের উপস্থিতির জন্য আবহাওয়ার উপাদানগুলির পরিবর্তন সংক্রান্ত দৈনন্দিন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় তিনি যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে তাঁর মতামতটিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। উপরন্তু 1865 সালে ফিজ়রয়ের অকালমৃত্যুতে তাঁর গবেষণাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রসঙ্গত ফিটজরয় 'নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত' শব্দটিকে তাঁর বক্তব্যের কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি। তিনি কেবলমাত্র আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা দিতে গিয়ে গভীর নিম্নচাপ কীভাবে সৃষ্টি হয় সেই সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণগুলিকে উপস্থাপন করেছিলেন। এমনকি তিনি কোনো সীমান্ত সৃষ্টির ধারণাও তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেননি। তবে এই ধারণাকেই ব্যবহার করে পরবর্তীকালে প্রায় 60 বছর পর বার্কনেস নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সংক্রান্ত মেরু সীমান্ত তত্ত্বটি প্রস্তুত করেন।
3. গ্যালটন এবং লে (Galton & Ley) :
ফিজ়রয়ের মৃত্যুর পর স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন (Fransis Galton) মিটিওরোগ্রামের সাহায্যে ব্রিটিশ আইসেলে 7টি স্টেশনের বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে 1869 থেকে 1880 পর্যন্ত আবহাওয়ার রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। পর্যবেক্ষণের সময় যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার অনেকটাই নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উন্নু ক্ষেত্রের (Warm Sector) সঙ্গে মিল রয়েছে। এমনকি গ্যালটন এমন একটি যন্ত্রের আবিষ্কার করেন যার সাহায্যে বায়ুতে অবস্থিত বাষ্পীয় চাপ (vapour pressure) সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু رد গ্যালটন হঠাৎই এই পর্যবেক্ষণ বন্ধ করে দেন। এরপর লে (Ley) গ্যালটনের তথ্যগুলিকে ব্যবহার করে ঘূর্ণবাত বিকাশের একটি ত্রিমাত্রিক মডেল প্রস্তুত করেন যা অনেকটাই বর্তমানে দেখতে পাওয়া ঘূর্ণবাতের মডেলগুলির মতো। এই মডেলটিতে লে-ই প্রথম, যিনি ঘূর্ণবাত
লে-কৃত নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত মডেল |
বিকাশের পিছনে ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারের বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাবকে উল্লেখ করেন। তাঁর প্রস্তুত করা মডেলটির কেন্দ্রে গভীর নিম্নচাপ লক্ষ করা যায়। নিম্নচাপটির চারদিক বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরে সিরাস, সিরো-স্টাটাস, স্ট্রাটাস মেঘের স্তর দ্বারা ঘেরা। ঘূর্ণবাতের এই চিত্রটি ওপরের বায়ুমণ্ডলে মেঘের আস্তরণের মাধ্যমে তীব্র গতিসম্পন্ন বায়ুপ্রবাহের ধারণা আনে। যদিও লে প্রদত্ত এই চিত্রটি একটি অসম্পূর্ণ চিত্র। কারণ এই চিত্রের মাধ্যমে নাতিশীতোয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাত কীভাবে বিকাশ লাভ করে তার কোনো উল্লেখ নেই।
4. অ্যাবের ক্রম্বি (1987) ও ম্যারিয়ট (Aber Cromby and Marriott) :
নাতিশীতোয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি সংক্রান্ত পুরানো ধারণাগুলির মধ্যে অন্যতম সংযোজন হল অ্যাবের ক্রম্বির তত্ত্ব। নাতিশীতোয় মণ্ডলে দৈনন্দিন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি সংক্রান্ত গবেষণার সময় অ্যাবের ক্রম্বি ও ম্যারিয়ট 1883 সালে মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাতের একটি মডেল চিত্রায়িত করেন। এরপর তাঁদের পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য, গবেষণালব্ধ ফলাফল ও নাতিশীতোয় অঞ্চলে ঘূর্ণবাতের সময়কালীন দৈনন্দিন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়গুলি একত্রিত করে 1987 সালে 'Weather' শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করেন।এই পুস্তকটিতে তিনি দৈনন্দিন আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে (Weather synoptic study) গ্যালটন প্রবর্তিত মিটিওরোগ্রামের (Meteorogram) ব্যবহারকে মান্যতা দেন। এই পুস্তকে তিনি সমচাপীয় তলের জ্যামিতিক (Isobaric Geometry) গঠন নিয়ে আলোচনা করেন এবং ঘূর্ণবাতের সময় সমচাপীয় তলের জ্যামিতিক অবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন, যা অ্যাবেক্রম্বির নীতি (Abecromby's Principles) নামে পরিচিত। এই নীতিতে তিনি 7 ধরনের অবস্থায় সমচাপীয় তলের জ্যামিতিক গঠন কীরূপ হবে তা উল্লেখ করে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এগুলি হল মূখ্য ও গৌণ ঘূর্ণবাত, প্রতীপ ঘূর্ণবাত, বায়ুর উচ্চচাপ দ্রোণী (trough), উচ্চচাপ অক্ষ (ridge), কল (Col) এবং সরলরৈখিক সমচাপরেখা।
অ্যাবেক্রম্বির এই পর্যবেক্ষণগুলি নাতিশীতোয় মণ্ডলে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষণায় যথেষ্ট রসদ জোগান দিলেও তাঁর তত্ত্বে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। যেমন-
অ্যাবেরক্রমবি এন্ড ম্যারিয়ট কৃত নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত মডেল |
(ক) অ্যাবে ক্রম্বি ঘূর্ণবাতের সময় সমচাপ তলের অবস্থা কীরূপ হবে তা আংশিকভাবে তুলে ধরলেও অনেকটাই বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ছিল।
(খ) সমচাপীয় তল সম্পর্কে আলোচনা করলেও তিনি সীমান্তের কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
(গ) অনেকে আবার অ্যাবেক্রম্বির তত্ত্বকে দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। কারণ তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষকগণ প্রচুর তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে ঘূর্ণবাতের গঠন সংক্রান্ত মডেল তৈরির দিকে না গিয়ে কেবলমাত্র কয়েক ধরনের সমচাপীয় তলের জ্যামিতিক অবস্থা নিয়েই আলোচনা করেছেন।
(ঘ) এমনকি অ্যাবেক্রম্বি তাঁর গবেষণায় মিটিওরোগ্রামের সাহায্য নেননি বা লে-র (Ley) দৈনন্দিন আবহাওয়ার যে বিশাল তথ্য ছিল তার উপযুক্ত ব্যবহারও করেননি। তাই কোনো কোনো আবহাওয়াবিদ মনে করেন যে, অ্যাবেক্রম্বির ঘূর্ণবাত সংক্রান্ত গবেষণাটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে চলে গিয়েছিল।
5. স্য ও ল্যামফার্ট (Show & Lampfert), 1941 :
নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি সংক্রান্ত পুরানো তত্ত্বগুলির (Classical theory) মধ্যে সর্বশেষ এবং যুক্তিসংগত তত্ত্ব হল নেপিয়ার স্য (Napier Shaw) এবং ল্যামফার্ট (R. G. K. Lamfert) প্রদত্ত তত্ত্বটি। মূলত স্য ও ল্যামফার্টের মডেলটির ওপর ভিত্তি করেই বার্জেন স্কুলের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন স্থানের তথ্য ও পর্যবেক্ষণের সমাহারে ঘূর্ণবাত বিকাশের মেরু সীমান্ত মতবাদটি উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। স্য ও ল্যামফার্ট 1906 সালে প্রকাশিত তাঁদের প্রথম প্রতিবেদন "Life History of Surface Air Current" শীর্ষক গ্রন্থে একটি নতুন ঘূর্ণবাত মডেলের উপস্থাপনা করেন। এই প্রতিবেদনটিতে তাঁরা (Dove) ও ফিজ়রয় (FitzRoy) প্রস্তাবিত দুই ধরনের ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট বায়ুপ্রবাহের অস্তিত্বকে প্রমাণ করেন এবং এই দুই ধরনের বায়ুপ্রবাহ কী প্রকার নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে তার একটি মডেল তৈরি করে দেখান। যদিও 1906 সালে প্রকাশিত এই মডেলটি ঘূর্ণবাতের কোনো পরিপূর্ণ মডেল ছিল না, এই প্রতিবেদনটিতে ঘূর্ণবাতের মডেল প্রসঙ্গে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে মাত্র। তবে স্য 1911 সালে "Fore- casting Weather" শীর্ষক প্রতিবেদনে একটি আদর্শ ঘূর্ণবাতের মডেল চিত্রায়িত করেন। নেপিয়ার স্য তাঁর মডেলে ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য যে দুটি উয় ও শীতল বায়ুকে দায়ী করেন তা আসে যথাক্রমে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং পশ্চিম দিক থেকে।
স্য-কৃত নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের মডেল |
তবে স্য প্রদত্ত এই মডেলটি যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এর ত্রুটিগুলি হল-
(i) স্য তাঁর এই নতুন মডেলটিকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার জন্য তেমনভাবে তথ্যনির্ভর করে তুলতে পারেননি। তিনি দৈনন্দিন আবহাওয়ার উপাদানগুলির (Synopsis basis) পর্যালোচনা করেও তাঁর তত্ত্বটিকে যুক্তিপূর্ণ করে তুলতে পারেননি। এমনকি দীর্ঘ কয়েকবছর ব্রিটিশ আবহাওয়া দপ্তরের সঞ্চালক (Director) থাকা সত্ত্বেও তাঁর যুক্তিগুলিকে ব্রিটেনের আবহাওয়ার ওপর প্রয়োগ করেও দেখেননি।
(ii) স্য ও ল্যামফার্ট প্রদত্ত তত্ত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দর্বলতা হল তাঁরা উভয়েই দুই প্রকার ভিন্ন উন্নতার বায়ুপুঞ্জকে নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে প্রতিষ্ঠিত করলেও কোনোপ্রকার সীমান্তের (front) ধারণা দেননি।
(iii) এমনকি নাতিশীতোয় ঘূর্ণবাতের জীবনচক্রও যে হতে পারে তার কোনো ধারণাই তাঁরা দিতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে সমালোচনা করতে গিয়ে ব্রুন্ট (Brunt) মন্তব্য করেন যে, স্য ও ল্যামফার্টের এই ধারণা আবহবিদ্যায় এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান, তথাপি ঘূর্ণবাতের জীবনচক্র সম্পর্কে কোনো বক্তব্য না থাকায় এই তত্ত্বটি নতুনত্বের তাৎপর্য হারিয়েছে।