পশ্চিমা বায়ু (The Westerlies):
মকরীয় উচ্চচাপ বলয় ও কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে যে দুটি বায়ু প্রবাহিত হয়, তাদের পশ্চিমা বায়ু বলে। প্রধানত পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এটি পশ্চিমা বায়ু নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য (Characteristics):
(i) উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুরূপে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মকরীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুরূপে প্রবাহিত হয়। উত্তর গোলার্ধে সাধারণত 30°-60° অক্ষরেখার মধ্যে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়ে থাকে।
(ii) উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তর দিয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চল ও মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চল থেকে আগত বায়ু শীতল ও ভারী হয়ে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসায় ক্রান্তীয় অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব বেড়ে যায়। তাই এই অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় বিরাজ করে। অন্যদিকে সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চলে কোরিওলিস বল অধিক কার্যকর হওয়ায় বায়ু অন্যত্র বিক্ষিপ্ত হয়। তাই এই অঞ্চলে স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। ফলে উভয় গোলার্ধের মেরুবৃত্ত অঞ্চলে বায়ুর শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হয়।
(iii) পশ্চিমা বায়ু উয় অঞ্চল থেকে শীতল অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং এই বায়ু প্রবাহিত হওয়ার ফলে শীতল অঞ্চলে শীতের তীব্রতা অনেক কমে যায়। এই বায়ু প্রধানত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং এই বায়ুর দ্বারা পশ্চিম দিকে বেশি এবং পূর্ব দিকে ক্রমশ কম বৃষ্টিপাত হয়। এই বায়ু শীতকালে বেশি বৃষ্টিপাত ঘটায়, কারণ শীতকালে জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ বেশি শীতল থাকে এবং জলীয় বায়ুপূর্ণ আর্দ্র বায়ু শীতল স্থলভাগের সংস্পর্শে এলে দ্রুত ঘনীভবন ঘটে থাকে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলে শীতকালে সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় স্থানান্তরিত হওয়ায় এই অঞ্চলে দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। এই কারণে শীতকালে এখানে কৃষিকার্যে সুবিধা হয় ও প্রচুর ফল উৎপাদন হয়।
(iv) পশ্চিমা বায়ু উভয় গোলার্ধে 30°-60° অক্ষরেখার মধ্যে প্রবাহিত হয়। উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগের বিস্তার অধিক হওয়ায় পশ্চিমা বায়ু বাধাহীনভাবে প্রবল গতিতে প্রবাহিত হতে পারে না। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে উক্ত অক্ষরেখার মধ্যে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ বেশি থাকায় পশ্চিমা বায়ু প্রবল গতিতে বাধাহীনভাবে সশব্দে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধের উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর গতিবেগ অনেক বেশি থাকে। আর সেই কারণেই উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুকে সাহসী পশ্চিমা বায়ু বা প্রবল পশ্চিমা বায়ু (Brave Westerlies) বলা হয়। এই কারণে সশব্দে প্রবাহিত পশ্চিমা বায়ু 40° দক্ষিণ অক্ষরেখায় গর্জনশীল চল্লিশা (Roaring Forties), 50° দক্ষিণ অক্ষরেখায় ভয়ংকর বা ক্রোধোন্মত্ত পঞ্চাশ (Furious Fifties) এবং 60° দক্ষিণ অক্ষরেখায় তীক্ষ্ণ চিৎকারকারী ষাট (Shrieking Sixties) নামে পরিচিত।
(v) পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহে অনবরত ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হতে দেখা যায় এবং সেগুলি পশ্চিমা বায়ুর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের দিক ও তীব্রতার দিক থেকে আয়ন বায়ু যত সুস্থিত ও নিয়মিত, পশ্চিমা বায়ু ঠিক ততটাই পরিবর্তনশীল। তবে উত্তর গোলার্ধের পশ্চিমা বায়ু অপেক্ষা দক্ষিণ গোলার্ধের পশ্চিমা বায়ু বেশি শক্তিশালী এবং প্রবাহের দিক থেকেও বেশি নিয়মিত।