মাসাই (masai)
ভূমিকা (Introduction) :
পূর্ব আফ্রিকার প্রায় 125টি আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পশুপালক 'মাসাই' (Masai)-রা হল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। পরাক্রমশালী, যোদ্ধা জনজাতি। “মাসাই’-রা মূলত ভূমধ্যসাগরীয় এবং নিগ্রো জনজাতির সংমিশ্রণ। গবাদি পশুপালন মাসই উপজাতির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বলে, কোনও কোনও ভৌগোলিক, এদের এই রীতিকে “the breath of life" আখ্যায়িত করেছেন। একসময় ব্রিটিশরা যখন আফ্রিকা দখল করতে এসেছিল ‘মাসাই’-রা তাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রক্ষণশীল মাসাইরা, স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন ঘটিয়ে তাদের পুরোনো রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগত কৌশলকে আজও টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
নামকরণ (Naming):
নিলোটিক সাহারার একটি গুরুত্বপূর্ণ আদিমতম ভাষা হল মা (Maa)। ভৌগোলিকদের মতে, এই 'মা' ভাষা থেকেই ‘মাসাই' নামের উদ্ভব ঘটেছে। মাসাই শব্দের মূল অর্থ হল "God's work" বা ঈশ্বরের কর্মী। অনেকে মনে করেন, “হিব্রু’ (Hebrew) ভাষা থেকেই মাসাই শব্দটি উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, আধুনিক পশ্চিমি সভ্যতার কিছু মানুষ মাসাইদের “Nobel savage” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
জনসংখ্যাগত তথ্য (Demographic Information) :
পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় 17 লক্ষেরও বেশি মাসাই উপজাতি বসবাস করছে। এর মধ্যে কেনিয়া এবং তানজানিয়াতেই সবচেয়ে বেশি মাসাই উপজাতির বাস। 2009 সালে কেনিয়ার জনগণনায় প্রায় 841,622 জন এবং 2011 জনগণনায় তানজানিয়ায় ৪,০০০০০ জন মাসাই জনগোষ্ঠীকে
চিহ্নিত করা গেছে।
1990 সাল থেকে 2011 সাল পর্যন্ত পাওয়া "Demography of Maasal Land"-এর তথ্য অনুযায়ী মাসাইদের জনসংখ্যাগত তথ্য হল
গড় আযু 57.596
জন্মহার 2.2 থেকে 4.9%
মৃত্যুহার 500 জন/লক্ষ
জনঘনত্ব- 30-50 জন/বর্গকিমি
সাক্ষরতার হার-10-15%
পরিচিতি (Identities) :
প্রকৃতপক্ষে মাসাই উপজাতি হল আফ্রিকার নীলনদ উপত্যকার একটি নৃতাত্ত্বিক জনজাতি ("A Nilotic Ethnine Group")। এদের প্রকৃত উৎপত্তিস্থল হল নীলনদের নিম্ন অববাহিকার তুর্কানা (Turkana) হ্রদের উত্তরাংশ (কেনিয়ার উত্তর-পশ্চিম দিক)। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় মাসাইদের পূর্বপুরুষগণ উর্বর জমির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে উত্তর কেনিয়ায় এসে হাজির হয়। সপ্তদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকে মাসাইরা পুনরায় স্থানান্তরিত হয়ে, বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকার শুষ্ক ও শুদ্ধপ্রায় জলবায়ুতে 1° উত্তর অক্ষাংশ থেকে 6° দক্ষিণ অক্ষাংশের গ্রেট রিফট (Great Rift) উপত্যকা বরাবর প্রায় 160000 বর্গ কিমি স্থান জুড়ে অবস্থান করছে।
ধর্ম (Religion):
মাসাহি অঞ্চলের চারপাশে খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য থাকলেও মাসাইবা ঐতিহ্যগতভাবে একেশ্বরবাদী (One High God) মহান দেবতার ওপর বিশ্বাসী। মাসাইরা হল 'একাই' (Enkai) দেবতার উপাসক। মাসাইরা কখনো করে তাদের এই দেবতা, দুটি, ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। কখনো এই দেবতা শাস্তিদাতা রূপে "Red God" এবং কখনো পরিষ্কাতা রূপে "Black God" নামে পরিচিত।
● ভৌগোলক অবস্থান :
যদিও মাসাইদের এলাকাটি নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, তবুও এখানকার উ 14°C-এর কাছাকাছি থাকে। দিনেরবেলায় গরম এবং রাতেরবেলায় ঠান্ডা। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বৃষ্টিপাত 100 সেমি.-র বেশি হয় না। বৃষ্টিপাত শৈলোৎক্ষেপ প্রকৃতির এবং বছরে বেশির ভাগ বৃষ্টি এপ্রিল-মে মাসে সংঘটিত হয়।
এ ধরনের জলবায়ু অঞ্চলে ঘাস জন্মায়। বৃষ্টিপাত যেখানে 50 সেমির কম, সেখানে ঘাসগুলির উচ্চতা এক ফুট বা তার কাছাকাছি হয়। একটু বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ঘন গাছপালা জন্মায়। এখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে বাবলা গাছ। জন্মায়। দীর্ঘ খরার সময় গাছগুলো শুকিয়ে যায়। গাছের পাতা ঝরে যায়। আবার, জানুয়ারিতে বৃষ্টি হলে ঘাসগুলো নতুন করে জন্মায়। একটু বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এবং যেখানে মাটিতে জল থাকে (sub-soil water) সেখানে কাঁটা জাতীয় গাছ ও ঝোপঝাড় জন্মায়। গাছগুলি এত কাছাকাছি জন্মায় যে সেখানে প্রবেশ করা কষ্টকর। এসব এলাকা গো-পালনের উপযুক্ত নয়।
বাসস্থান (Habitat) :
পূর্ব আফ্রিকার বেনিয়া, উত্তর তাঞ্জানিয়া এবং উগডার পাহাড়ী অঞ্চলে মাসাই উপজাতির বাস) এই অঞ্চলটি 1° থেকে দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে প্রায় 3800 বর্গকিমি স্থান জুড়ে অবস্থান করছে। এই অঞ্চলটি ভিক্টোরিয়া হ্রদের পূর্ব দিকে অবস্থিত উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত। এই অবস্থার যেটি পূর্ব আফ্রিকার বৃহৎগ্রস্ত জন্য এই অঞ্চলটি অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত যেখানে বহু । ছোট ছোট ঝিল এবং আগ্নেয়গিরি অবস্থিত। অগ্ন্যুৎপাতের জন্য এই অঞ্চলে লাভার আস্তরণ দেখা যায়। কিলিমানজারো, মাউন্ট বেনিয়া এই মালভূমি অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ আগ্নেয় শৃঙ্গ। চ্যুতিযুক্ত অঞ্চলে বহু জায়গায় উঁচু নীচু হওয়ার জন্য এখানে অনেক হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে।
মাসাই উপজাতি অঞ্চলটি নিরক্ষরেখার নিকট অবস্থিত হলেও এখানে উচ্চতার জন্য (গড়ে 1500 মিটার) সমভূমি অঞ্চলের থেকে তুলনামূলক ভাবে বেশি শীতল জলবায়ু দেখা যায়। এখানে উষ্ণতা 20°-30° সেন্টিগ্রেডের মতো থাকে। দৈনিক উষ্ণতার প্রসর বেশি থাকে। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত 100 সেমির বেশি হয়। বেশিরভাগ বৃষ্টি এপ্রিল-মে মাসে এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর শুষ্ক থাকে।
এখানে সমগ্র মালভূমি অঞ্চল জুড়ে সাভানা তৃণ জন্মায়। যেখানে বৃষ্টিপাত একটু কম হয় সেখানে জোট তৃণ জন্মায়। উচ্চ পাবর্ত্য অঞ্চলে যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি সেখানে দীর্ঘ ঘাস জন্মায় যাদের উচ্চতা প্রায় 1 মিটার। এগুলি এলিফ্যান্ট ঘাস নামেও পরিচিত। উচ্চ পাবর্ত্য অঞ্চলে স্তেপ তৃণ জন্মায় যা কম উষ্ণতার জন্য শুষ্ক ঋতুতেও যায় না।
শারীরিক লক্ষণ (Physical Trait) :
শারীরিক লক্ষণের দিক থেকে মাসাই উপজাতিরা ভূমধ্যসাগরীয় ও নিগ্রয়েড উপজাতিদের সংমিশ্রণ বলে মনে করা হয়। এদের উচ্চতা অনেক বেশি হয়। এদের আঙ্গুলগুলি লম্বা এবং হাত পা পাতলা হয়ে থাকে। এদের গায়ের রং ধূসর ও গাঢ় ধূসর প্রকৃতির হয়ে থাকে। এদের নাক লম্বা এবং পাতলা হয়। কপাল উঁচু এবং পাতলা হয়। এদের চুল কোঁকড়ানো এবং ঠোঁট মোটা হয়।
জীবিকা (Occupation) :
আগেই বলা হয়েছে যে পশুপালন মাসাই উপজাতিদের প্রধান জীবিকা। এরা পশুপালক উপজাতি এবং পশুই এদের প্রধান সম্পদ। পশুপালন এদের পরম্পরাগত জীবিকা।
প্রত্যেক মাসাই পরিবারে পৃথক পৃথক পশুর দল থাকে। পশু চরানোর কাজ পুরুষেরা করে থাকে এবং দুধ দুয়ানোর কাজ মহিলারা করে থাকে। এরা সকলে পশু চরানোর আগে এবং সন্ধ্যেবেলায় ফিরে পশুদের থেকে দুধ সংগ্রহ করে। দুধ সংগ্রহ করে এরা ঘি, মাখন প্রভৃতি তৈরী করে। মাসাই উপজাতিরা গরুর বা মোষের সাথে সাথে ভেড়াও প্রতিপালন করে তবে সামাজিক জীবনে ভেড়ার গুরুত্ব কম হয়ে থাকে। দুধ ও মাংসের জন্য এরা ছাগলও পালন করে। এছাড়া মাল পরিবহনের জন্য খচ্চর ও গাধাও পালন করা হয়। পশুদের পাহারা দেওয়ার জন্য এরা কুকুরও পালন করে।
খাদ্য (Food) :
মাসাইদের খাদ্য তালিকায় দুধ ও মাংস প্রধান। এরা ছাগল ও ভেড়ার মাংস এবং গোরুর দুধ ভক্ষণ করে। মাংসের জন্য এরা গরুকে হত্যা করে না। তবে গরু স্বাভাবিক ভাবে ঘরে গেলে এরা গরুর মাংস ভক্ষণ করে। এছাড়া জোয়ার, বাজরা, ভুট্টাও এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে তবে যোদ্ধারা এই খাদ্য গ্রহণ করে না। কলা ও অন্যান্য ফল কেবল শিশু ও মহিলারা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। খাদ্যশস্য এরা নিকটবর্তী স্থায়ী কৃষকদের কাছে পশুর বিনিময়ে সংগ্রহ করে। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা মধুও এদের খাদ্য এবং এর থেকে মদ তৈরী করেও পান করে। বিভিন্ন পশুর রক্তও এরা পান করে থাকে।
বস্ত্ৰ (Clothing)
মাসাই উপজাতিরা চামড়ার তৈরী সাধারণ পোশাক পড়ে থাকে। মহিলারা ছাগলের তৈরী পোশাক এবং যোদ্ধারা বাঘ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর পোশাক পরে) এরা চামড়ার তৈরী টুপীও ব্যবহার করে। উৎসবের সময় মহিলা এবং যুবকেরা কিছু গহনা পড়ে থাকে। ধনী মাসাই পরিবারের মহিলারা লোহার তারের তৈরী কুণ্ডলাকার গহনা পড়ে। চামড়াকে মসৃণ ও উজ্জ্বল করার জন্য এরা মাখন ও চর্বি দিয়ে ভালো করে ঘষে।
বসতি( habitation)
যাযাবর ভিত্তিক পশুপালক জন্য মাসাইদের স্থায়ী বসতি দেখা যায় না। তৃণের সন্ধানে এরা নিজের বসতিস্থান পরিবর্তন করে। একটি স্থানে কিছু মাস বা সপ্তাহ বাস করে। প্রত্যেক মাসাই পরিবার পৃথক পৃথক ঝুপড়ি বা তাঁবুতে থাকে যা ‘ক্রাল' (Kraal) নামে পরিচিত। এক একটি ক্রালে প্রায় 20 থেকে 50 টি ঝুপড়ি থাকে। ক্রাল ঝুপড়ি দ্বারা নির্মিত একটি ছোট ঘর যা কাঁটাযুক্ত বেত দ্বারা তৈরী। ক্রালের আকৃতি গোলাকার এবং সুরক্ষার দিক থেকে উপযুক্ত হয়। ক্রালের আগে পিছে পশুদের প্রবেশ করার জন্য দরজা রাখা হয়। প্রত্যেক ক্রালের মধ্যে প্রায় 100 বর্গমিটার ফাঁকা স্থান রাখা হয় যেখানে রাত্রে পশুরা থাকে। নতুন বসতি খোঁজার জন্য তৃণভূমি ও জলাশয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাসাই বাসীদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক ঝুপড়ি থাকে। সব দেখাশুনা এরা নিজেরা করে। ঝুপড়ির দেওয়াল বাঁশ, দীর্ঘ ঘাস ও কাঠ দ্বারা করা হয় এবং এর ওপর মাটির প্রলেপ লাগানো হয়। এদের ঘরের ছাদও কাঠ ও ঘাস দ্বারা নির্মাণ করা হয় এবং প্রত্যেক ঝুপড়িতে একটি দরজা থাকে যা চামড়ার তৈরী পর্দা দিয়ে ঢাকা হয়।
সামাজিক সংগঠন (Social Organisation)
মাসাই উপজাতিদের মধ্যে ব্যক্তি থেকে সম্প্রদায়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরা সাধারণত পিতৃতান্ত্রিক উপজাতি। মাসাইদের মধ্যে সমান বংশে বিবাহ সম্পন্ন হয় না অর্থাৎ এরা বহির্বিবাহে বিশ্বাসী। মাসাই উপজাতি সমাজে ব্যক্তির স্থান তার পশুর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে।
মাসাই উপজাতিদের মধ্যে বিবাহ শৈশব অবস্থাতেই ঠিক করা হয় কিন্তু বিবাহ যৌবনে পৌঁছালেই সম্পন্ন হয়। কোন যুবকের বিয়ে তখনই হবে যখন সে উপযুক্ত যোদ্ধা প্রমাণিত হবে। বিয়ের বয়স সাধারণত 20-25 বছর হয়ে থাকে। প্রথম শিশু জন্মানোর পর মেয়ের বাবা পন দেয় এবং তাকে মধুর তৈরী মদ উপহার দেওয়া হয়।
মাসাই উপজাতিদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি পৃথক পৃথক সময়ে অনেক বিবাহ করতে পারে। প্রথম স্ত্রীর তুলনায় দ্বিতীয় স্ত্রীর অধিকারে কম পক্ষ হয়। পিতার মৃত্যুর পর প্রত্যেক স্ত্রীর নির্দিষ্ট সম্পত্তি তার সমস্ত পুত্রের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়। একটি বয়স্ক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রী এবং প্রত্যেক স্ত্রীর সন্তানদের নিয়ে একটি পরিবার গঠিত হয়। একটি পরিবার একসাথে একটি ক্রালেই বসবাস করে যদিও প্রত্যেক স্ত্রীর পৃথক পৃথক ঝুঁপড়ি থাকে।
মাসাই উপজাতিদের মধ্যে যুবকদের নিয়ে একটি সৈন্যদল তৈরী করা হয়। বিভিন্ন সময়ে যুবকদের সেই সৈন্যদল পাঠানো হয়। যখন কোন সৈন্য বয়স্ক হয় তখন তার পরিবর্তে নুতন যুবককে পাঠানো হয়। বয়স অনুসারে যোদ্ধাদের শ্রেণি নির্ণয় করা হয়। মাসাইরা নিজেদের অঞ্চলে অধিকার বিস্তারের জন্য এইসব সৈন্যদের প্রয়োগ করে থাকে।
মাসাইদের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলি লোহার তৈরী। এদের মধ্যে তীর-ধনুক, পাতা আকৃতির তলোয়ার, ছড়ি, বল্লম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লোহার জিনিষ তৈরীর জন্য কামার রয়েছে।
যুদ্ধের সময় মাসাই যোদ্ধারা বুনো জীবজন্তু ও সিংহের চামড়ার তৈরী টুপি পরে। লোহা ও মোষের চামড়ার বাজু ও গলাবন্ধ এবং বোতামের সাথে শক্ত করে লাগানো কোমড়বন্ধ যোদ্ধাদের অন্যতম পোশাক। মাসাই যোদ্ধারা বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন, লুঠবাজ তে তরোবাড়' প্রভৃতি।
আফ্রিকার অন্যান্য যাযাবর পশুপালক বা শিকারী উপজাতিদের (পিগ্নী, ব্যুশম্যান) তুলনায় মাসাইদের সামাজিক সংগঠন অনেক বেশি সুদৃঢ়। এদের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট দণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। মাসাইদের মধ্যে দলপতি থাকে যিনি এদের ধর্মীয় নেতা বা পুরোহিত রূপেও বিবেচিত হন। এদের ‘লেইবন’ (Laibon) বলা হয়। এই পুরোহিতদের মাসাই সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে এরা কোন প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ না করলেও এদেরকে জাদু বিদ্যার অধিকারী মানা হয় এবং এদের ভবিষ্যৎবাণী বিশ্বাস করা হয়। লেইবন-এর পদটি বংশানুক্রমিক এবং পিতা থেকে পুত্র লাভ করে।
মাসাই উপজাতিদের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। মৃত্যুর পর এরা মৃতদেহ ঝুপড়িতে রেখে অন্যত্র পাড়ি দেয়।
মাসাইদের মধ্যে নৃত্য ও সংগীত খুবই জনপ্রিয়। এরা সাধারণত মৌনভাবে সংগীত পরিবেশন করে যা ‘ইউনেটো' উৎসব নামে পরিচিত। এরা লাফিয়ে লাফিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে। মাসাইদের পরম্পরাগত এই নৃত্য 'আড়ম্ব' (Adumu) নামে পরিচিত।
অর্থনৈতিক অভিযোজন (Economical Adaptation) :
মাসাইনের অর্থনৈতিক অভিযোজন এদের জীবিকা এবং সম্পত্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাসাইদের অর্থনৈতিক অভিযোজন কয়েকটি স্তরে আলোচনা করা হল।
(i) পশুসম্পদ (Livestock):
গবাদি পশু হল মাসাই অর্থনীতির অন্যতম ও প্রাথমিক ভিত্তি। মাসাইরা প্রচুর সংখ্যক ভেড়া, ছাগল, গোরু, মহিষ প্রভৃতি তাদের 'ক্লাল’-গুলিতে রাখে। সাধারণত এদের খাদ্য তালিকার মাংস, দুধ, রক্ত প্রভৃতি, পরিবারের পশুগুলির থেকেই পাওয়া যায়। তাই এই সকল পশু মাসাইদের কাছে সম্পদ স্বরূপ। বিশেষ করে 'গোরু' মাসাইদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি। তাই মাসাইরা সাধারণত গোহত্যা করে না। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে নাসাইরা মৃত গোরুর মাংস ভক্ষণ করে।
মাসাইরা সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে যাবতীয় ভার বহনের কাজে তাদের পালিত 'গাধা'-গুলিকেই বেশি ব্যবহার করে।
(ii) পশুপালন (Pastoralism):
পূর্ব আফ্রিকার যে অঞ্চলে মাসাইরা বসবাস করে সেখানে তৃণগুস্মের যথেষ্ট
প্রাধান্য থাকায়, অর্থনৈতিকভাবে পশুচারণ মাসাই সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গা হয়ে উঠেছে। মাসাইরা গবাদি পশুগুলিকে শুধু খাওয়া কিংবা বিক্রির জন্য প্রতিপালন করে না। মাসাইদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, যাদুবিদ্যা প্রদর্শনীতেও গবাদি পশুগুলি কাজে লাগে। মাসাইরা অনেকসময় ভেড়া, ছাগল, কিংবা গোরুকে আদর করে বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকে। মাসাইল্যান্ডে বিভিন্ন প্রজাতির গোরু একসঙ্গে বিচরণ করে। এই সমাজে যে সমস্ত গোৰু পাওয়া যায় তা মিশ্র প্রকৃতির। এখানকার কুঁজওয়ালা গোলু প্রতিদিন প্রায় আড়াই কেজির বেশি দুধ দেয়। মাসাই মহিলারা সূর্য ওঠার আগে এই দুধ সংগ্রহ করে রাখলে, তবেই মাসাই পুরুষরা গোরুগুলিকে নিয়ে বিচরণ ক্ষেত্রে নিয়ে যায়।
অর্থনৈতিক সমস্যা (Economical Problems ) :
অর্থনৈতিক দিক থেকে মাসাইদের বহুবিধ সমস্যা রয়েছে,
যেমন—
1. মাসাই সমাজে দারিদ্রতা (Poverty), অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সবচেয়ে বড়ো দিক। মাসাইল্যান্ডে কোনও ফসল উৎপাদন খুব একটা করা হয় না। কারণ মাসাইরা মনে করে "ফসল উৎপাদন মানেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিভিন্ন ভাবে জর্জরিত করা।" তাই মাসাইরা স্থানীয়ভাবে যে ন্যূনতম পশুস্রাত এবং সংগৃহীত খাদ্য পেয়ে থাকে তা অভাব মোচনের ক্ষেত্রে যথাযথ নয়।
2 মাসাইল্যান্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত, তাই বহিরাঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ভাবে যোগাযোগ স্থাপনে মাসাইরা বিরত থাকে।
3. মাসাই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যকেন্দ্র ও শহরাঞ্চলের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকেও এখানকার অধিবাসীরা বঞ্চিত থেকে যায়।
সামাজিক অভিযোজন (Social Adaptation) :
মাসাইনের সামাজিক অভিযোজনকে বেশ কয়েকটি ধাপে আলোচনা করা হল।
সামাজিক গঠন (Social Structure)
পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন জনজাতির তুলনায় গোষ্ঠীবদ্ধ মাসাইদের একটি স্বতন্ত্র সামাজিক গঠন রয়েছে। এখানে সমাজ গঠনে মাসাই পুরুষ এবং মাসাই মহিলারাই অন্যতম।
● মাসাই পুরুষ প্রায় 6 থেকে 6% ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দীর্ঘ দেহী মাসাই পুরুষরা 3 টি অংশে বিভক্ত, যথা—হাসছি বালক, মাসাই যোদ্ধা এবং মাসাই বয়স্ক পুরুষ।
● মাসাই বালক: মাসাই সমাজে 14 বছর পর্যন্ত পুরুষরা মাসাই বালক নামে পরিচিত। এরা গৃহে মায়ের সঙ্গে থেকে বেঁচে থাকার যাবতীয় শিক্ষা অর্জন এবং একই সঙ্গে বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনে অংশ নেয়।
● মাসাই যোদ্ধা মাসাই সমাজে 14-30 বছর পর্যন্ত বয়সি পুরুষরা মাসাই যোদ্ধা বা মোরান (Moran) নামে পরিচিত। এই বয়সের সমস্ত মাসাই পুরুষ সমাজের যাবতীয় অনুশাসন, রীতিনীতি মেনে, প্রকৃত যোদ্ধা রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। ) বয়স্ক মাসাই মাসাই সমাজে বয়স্ক পুরুষদের স্থান সকলের ঊর্ধ্বে। এরাই সমাজের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে : এবং মাসাই সমাজকে পরিচালিত করে। মাসাইদের দলপতি 'লেইবন' (Laibon) নামে পরিচিত। মাসাই সমাজে এরা অনেকসময় পুরোহিতের কাজও করে থাকে।
● মাসাই মহিলা : মাসাই সমাজে মহিলারা গৃহকর্মে অত্যন্ত নিপুণ হয়ে থাকে। মাসাই মহিলারা গৃহে সন্তান এবং পরে দেখাশোনার যাবতীয় দায়ীত্ব পালন করে থাকে।
পিতৃতান্ত্রিক মাসাই সমাজে, বাবা, মা এবং সন্তান নিয়ে একটি কুঁড়েঘরভিত্তিক পরিবার গড়ে উঠলেও এখানে ব্যক্তির মেয়ে সম্প্রদায়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আচার-অনুষ্ঠান (Ceremony):
মাসাই জনায় সমাজে যে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তা সম্পূর্ণর সেই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মায়াইল্যান্ড বৃষ্টিতে জমি ফসল ফলানোর উপযোগী হয়ে ওঠার জন্য মাসাইরা আনন্দে মেতে ওঠে। মাসাইদের কয়েকট আচার-অনুষ্ঠান হল-
● 'একিপাটা' (Enkipaata) • এটি এমন একটি প্রথা, যেখানে মাসাই সমাজের 14-16 বছরে একটি লা, মহাআনন্দে গ্রামের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে প্রায় ৫ মাস ধরে ঘুরে শেষ দিনে নিকটবর্তী বনে রাত্রিযাপন করার পর ভোর রাত থেকে সারাদিন নাচগান করে পুনরায় পুহে ফিরে আসে।
এমুয়াত্তা' (Emuratta) ● মাসাইরা নিজেদেরকে যোগা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে এমুরাতা অনুষ্ঠানটিকে উদযাপন করে। ● ইউনোটে)" (Eunoto) • এই অনুষ্ঠানটিকে মূলত মাসাইরা পালন করে নিজেদের একজন পরিণত যোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার আনন্দে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই মাসাইয়া বিবাহের অনুমতি পায়।
● নাচ ও গান (Dance and Music) মাসাইদের প্রত্যেক আচার-অনুষ্ঠানেই নাচ ও গানের ব্যবস্থা থাকে। মাসাইদের নাচ দেখতে অনেকটা লাকানোর (Jump) মতো লাগে। এরা লাফানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথাকেও একটি নির্দিষ্ট ছলে দোলায়। এনের বিখ্যাত 'আদুমু' (Adumu) নাম 'Jumping Dance-টি পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
মাসাইরা তাদের গানে আঞ্চলিকভাবে তৈরি কিছু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। এগুলি হল--কুড়ো হন, ইউনোটার প্রভৃতি।
সামাজিক সমস্যা (Social Problems) :
1. পিতৃতান্ত্রিক মাসাই সমাজের একটি বড়ো সমস্যা হল মহিলাদের উপেক্ষা করে রাখা। মাসাইদের অভ্যন্তরীণ ‘Kraal’-গুলি বাদে অন্যান্য বহির্জগতে মহিলাদের গমন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ফলে বেশির ভাগ মহিলারাই গৃহবন্দি রূপে, জীবন যাপন করে। তাছাড়া মাসাই সমাজে যেমন বিধবাদের পুনর্বিবাহের সুযোগ নেই তেমনই অসংখ্যমহিলা বহুবিবাহের শিকার, যাদেরকে মাসাই পুরুষরা শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্যই "স্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়। ফলে মাসাই সমাজের মহিলাদের স্বাভাবিক গুণাবলি বিকশিত হয় না।
2. মাসহিরা পশুপালন এবং সংগ্রহভিত্তিক জীবনধারার মধ্য দিয়ে যে সমস্ত খাদ্য পেয়ে থাকে তা সবসময় শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম। বর্তমান কেনিয়ার প্রায় 3.4 লক্ষ মাসাই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় চুগছে। এ ছাড়াও মাসাইল্যান্ডের যে সমস্ত চারণভূমিতে মাসাইরা পশুপালন করে, সেখানেও পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের অভাব রয়েছে। ফলে এখানকার অধিকাংশ পশুরা অনেকসময় না খেতে পেয়ে মারা যায়।
3. স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মাসাহরা বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
(i) মাসাই উপজাতিরা তাদের জটিল রোগগুলিতেও প্রথাগত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করে থাকে বলে, অনেক ক্ষেত্রে অধিকাংশ মাসাইদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।
(ii) মাসাইল্যান্ডের অন্তত 10% থেকে 20% অধিবাসী HIV রোগে আক্রান্ত হয়।
(iii) এখানকার অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার একদিকে যেমন শিশুমৃত্যুর হারকে বৃদ্ধি করছে, তেমনই জমির ওপর জনসংখ্যার চাপও দিনে দিনে বাড়ছে।
(iv) মাসাইল্যান্ডের এমনকিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে মহিলাদের জন্ম দেওয়ার সময়, 50-70 মাইলেরও বেশি নূরত্বের কোনও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। ফলে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার যেমন একদিকে বাড়ে, তেমনই 30% থেকে 40% মাসাই মহিলাদের প্রসব রাস্তাতেই হয়ে যায়, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
4. মাসাই সমাজের প্রায় 80% মানুষ পর্যাপ্ত জলের অভাবে জর্জরিত। মাসাইল্যান্ডের অন্তর্গত কেনিয়ায় উন্নত জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকলেও এখানকার অধিকাংশ ভাগের পাইপলাইন মাসাই অঞ্চলের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেছে। ফলে মাসাই সম্প্রদায় এখানকার জলসম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মাসাই সমাজের ধর্মী ব্যক্তিরাই এই জলকে শুধু ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তা ছাড়া মাসাইল্যান্ডে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণও যথেষ্ট কম। সব মিলিয়ে মাসাইরা প্রবল জলকষ্টে ভোগে।
5. শিক্ষাব্যবস্থাতেও মাসাইরা যথেষ্ট পিছিয়ে। এখানে মাসাই সম্প্রদায়ের উপযোগী স্কুল, কলেজ এবং শিক্ষকদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তা ছাড়া মাসাই সমাজের মেয়েরা সর্বদা গৃহবন্দী থাকায়, এদের 10%-এরও কম প্রচলিত শিক্ষার আওতায় আসে।
6. মাসাইল্যান্ডের অধিবাসীরা পশ্চিমি সংস্কৃতির প্রভাবে প্রায়শই হুমকির মুখে পড়ে। ফলে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে মাসাইরা কখনোই নিজেদেরকে মিলিয়ে দেয় না।
সাম্প্রতিক পরিবর্তন (Recent Changes) :
বিগত কয়েক দশক ধরে মাসাই সমাজে একাধিক সমস্যার নিরিখে, এখানে সম্প্রতি বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন -
(i) খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন:
মাসাইরা বর্তমানে শুধু দুধ, রক্ত কিংবা মাংস খেতে অভ্যস্ত নয়, এর পাশাপাশি দই, মাখন, ছানা, প্যাকেটজাত ভুট্টা জাতীয় খাবার, চিনি এবং বিভিন্ন শাকসবজি খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
মাসাইদের সাম্প্রতিক খাদ্য তালিকা
(ii) প্রথাগত কৃষি অনুসরণ :
বিস্তীর্ণ মাসাইল্যান্ড জুড়ে তৃণভূমি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসায় মাসাইরা ধীরে ধীরে প্রথাগত কৃষি আয়ত্ত করে ফেলেছে। কেনিয়া ও তানজানিয়া সরকারও স্থায়ী কৃষি স্থাপনে মাসাইদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে মাসাইরা তাদের স্থানীয় কৃষিজমিগুলিতে ধান, আলু, সরগম প্রভৃতি শস্য উৎপাদন করছে।
(iii) শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন :
শিক্ষাক্ষেত্রে মাসাইদের একাধিক সমস্যার প্রেক্ষাপটে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়া সরকার বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। যেমন– (i) নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার (ii) উন্মুক্ত বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসাইদের পঠন-পাঠনের সুযোগ করে দেওয়া (iii) পর্যাপ্ত পরিমাণে পুস্তক সরবরাহ (iv) মাসাইল্যান্ডের শিক্ষাঙ্গনগুলিতে নতুন নতুন শিক্ষক নিয়োগ (v) বিদ্যালয়গুলিতে চেয়ার, টেবিল ও শেডের ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি।
(iv) চিকিৎসাক্ষেত্রে পরিবর্তন :
বর্তমানে মাসাইল্যান্ডের অধিকাংশ অধিবাসী আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় এসেছে। এখানকার বেশ কিছু এলাকায় নতুন করে অনেক সরকারি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। ফলে কেনিয়া ও তানজানিয়া সরকার বিনামূল্যে মাসাইদেরকে বহু মূল্যবান জীবনদায়ী ঔষধ সরবরাহ করে থাকে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার ও নার্সদের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে মাসাই মহিলাদের প্রসবকালীন মৃত্যুহার ও শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই ঠেকানো গেছে। সম্প্রতি HIV টেস্ট এবং স্যানিটারি ক্ষেত্রের পরিবর্তন, গর্ভাবস্থায় সুষম খাদ্যগ্রহণে মাসাইরা যথেষ্ট দায়বদ্ধ।
(v) বস্ত্র পরিধানে পরিবর্তন:
অধিকাংশ মাসাই সমাজের মানুষ আধুনিক বিশ্বের সংস্পর্শে আসায় তাদের পোশাক-পরিচ্ছদেও যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে অনেক অভিজাত মাসাইরা বর্তমানে ‘শুকা’ (Shuka)-র পরিবর্তে বারমুন্ডা, জিনস প্যান্ট, টপ, কিংবা টিশার্ট পরিধান করছে।
(vi) জীবিকায় পরিবর্তন :
জীবিকা ক্ষেত্রে মাসাইদের সম্প্রতি পরিবর্তন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রচুর সংখ্যক সচেতন মাসাই জনগোষ্ঠী তাদের পশুপালক অধযাযাবর জীবিকাবৃত্তি ত্যাগ করে, বর্তমানে দুগ্ধজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, মজুরির চাকুরি (ওয়েটার, তৈলখনি শ্রমিক, ওষুধ বিক্রি প্রভৃতি), ট্যুরিস্ট গাইড, সুরক্ষাকর্মী প্রভৃতি পেশায় নিযুক্ত রয়েছে।
(vii) ধর্মীয় পরিবর্তন:
মাসাই সমাজের অধিবাসীরা প্রথাগতভাবে তাদের স্বকীয় ধর্মে বিশ্বাসী হলেও, বিগত কয়েক দশকে অধিকাংশ মাসাই জনগোষ্ঠী ক্রমশ ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হয়ে উঠছে।
(viii) রাজনীতিতে অংশগ্রহণ :
বর্তমানে কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মাসাই জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিবেশকে নিয়ে সচেতনভাবে নানা আন্দোলনে নেমেছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসন এবং মাসাইল্যান্ডের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে।
একবিংশ শতকে মাসাইদের জীবনযাত্রা খুব দ্রুত বিকৃত হয়েছে। যদিও সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং প্রগতিশীলতা কিছুটা হলেও মাসাইদের জীবনধারায় নতুন করে বাঁচতে রসদ জুগিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন নাসাইদের মৌলিকতাকে বিভিন্নভাবে বিনষ্ট করেছে। তাই বর্তমান সভ্যতায় মাসাইদেরকে তাদের নিজস্ব পরিবেশ ও সম্পদ অনুযায়ী স্বনির্ভর করে তুলতে না পারলে মাসাই সমাজের বিকৃতি আরও বাড়বে।