ভারতের মৌসুমি বায়ু (Indian Monsoon) :
ভারতবর্ষ মৌসুমি বায়ুর আদর্শ বিচরণক্ষেত্র। মৌসুমি বায়ুর আগমনকাল ও প্রত্যাগমনকাল সুনির্দিষ্ট নয়। কোনো কোনো বছরে এর আবির্ভাব অনেক আগে ঘটে, আবার অনেক বছর এটি দেরিতে আসে। মৌসুমি বায়ু যে বছর আগে আসে, সে বছর আগে ফিরে যায়। কোনো বছরে মৌসুমি বায়ু পরে এলে ফিরেও যায় দেরি করে। এই বায়ুর আগমনকাল ও প্রত্যাগমনকালের কোনো ধারাবাহিকতা নেই।
এই বায়ু পরপর দু-বছর একই সময়ে নাও আসতে পারে। এ ধরনের চরম অনিশ্চয়তার জন্য মৌসুমি বায়ুকে খামখেয়ালি চরিত্রের (Pulsatory Character) বলা হয়। মৌসুমি বায়ু প্রতি বছর গড়ে 1 জুন তারিখে কেরালায় এসে পৌঁছায় এবং 15 জুলাই-এর আগেই সারা ভারত দখল করে নেয়। সাধারণত এর স্থায়িত্বকাল 100 দিন থেকে 120 দিন।
1 সেপ্টেম্বর থেকে এই বায়ু ফিরে যেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এক মাসের মধ্যে সমগ্র ভারত থেকে এই বায়ু চলে যায়। মৌসুমি বায়ু তার প্রত্যাগমন শুরু করে রাজস্থানে এবং শেষ করে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে। ভারতের ঋতু পর্যায় এই বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন দ্বারা চিহ্নিত হয়।
ভারতের মৌসুমি বায়ুকে সময়ের নিরিখে দু-ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-(1) গ্রীষ্মকালীন বা বর্ষাকালীন মৌসুমি বায়ু এবং (2) শীতকালীন মৌসুমি বায়ু।
এ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের সময়সূচি দেখানো হল।
1. গ্রীষ্মকালীন বা বর্ষাকালীন মৌসুমি বায়ু (Summer or Rainy Monsoon)
গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি হঠাৎ এসে পড়ে না। এক স্বল্পকালীন অবস্থা বা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এই বায়ুর আগমন ঘটে। এই পর্যায়ে আবহাওয়া মণ্ডলের চরম উয় বাতাস ধীরে ধীরে হালকা বৃষ্টিপাতযুক্ত ভারী আর্দ্র বাতাসে পরিণত হয়। এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বাতাস সাধারণত মে মাসের শেষ কিংবা জুন মাসের প্রথম থেকে বর্ষাকালীন মৌসুমি বায়ুরূপে ভারতবর্ষে প্রবাহিত হতে শুরু করে। সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ ভারতের কেরালা ও তামিলনাড়ু উপকূলে এই বায়ু প্রথমে এসে পৌঁছায়।
তারপর ধীরে ধীরে গোটা ভারতে বিস্তার লাভ করে এবং সবশেষে হাজির হয় রাজস্থানের পশ্চিমাংশে। এ সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতে গভীর নিম্নচাপ ও সবল ট্রাফের অবস্থানের জন্য ভারত মহাসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ- পূর্ব আয়ন বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুরূপে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আরবসাগরীয় শাখায় ও বঙ্গোপসাগরীয় শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। জলীয় বাষ্প সমেত আরবসাগরীয় শাখা মালাবার উপকূলের পশ্চিমঘাট পর্বতে ও বঙ্গোপসাগরীয় শাখা পূর্ব হিমালয়ে আছড়ে পড়ে এবং হঠাৎ প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। একে মৌসুমি বিস্ফোরণ (Burst of Mon- soon) বলে।
ভারতে বর্ষাকাল শুরু হয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে। ভারতের 90 ভাগ বৃষ্টি গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর দ্বারাই ঘটে থাকে।
আরবসাগরীয় শাখা (Arabian sea branch) :
মৌসুমি বায়ুর আরবসাগরীয় শাখাটি 1 জুন কেরালার তিরুবনন্তপুরম উপকূলে প্রথম এসে পৌছায় এই উপকূলে প্রবেশ করেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পশ্চিম ঢালে বাধা পেয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। এরপর পশ্চিমঘাট পর্বত অতিক্রম করে যখন পূর্ব ঢালে চলে আসে তখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে আসায় বৃষ্টিপাত কমে যায়। তাই পশ্চিমঘাটের পূর্বঢাল বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে (Rain Shadow Zone) পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমঘাটের প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত মহাবালেশ্বরে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 650 সেমি সেখানে অনুবাত ঢালে অবস্থিত পাঁচগনিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় 16 সেমি। এরপর ধীরে ধীরে এই বায়ু দাক্ষিণাত্যের মালভূমির দিকে এগোয়। তবে জলীয় বাষ্পের অভাবে এখানে বিশেষ বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। এরপর ধীরে ধীরে আরবসাগরীয় শাখাটি যত উত্তরে সরতে থাকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে আসতে থাকে। এই শাখাটি ধীরে ধীরে নর্মদা-তাপ্তি উপত্যকা অতিক্রম করে ছোটোনাগপুর মালভূমির নিকটে এলে বঙ্গোপসাগরীয় শাখার সঙ্গে মিলিত হয়।
এই আরবসাগরীয় শাখার একটি অংশ গুজরাটের কচ্ছ এবং রাজস্থানের থর মরুভূমির ওপর দিয়ে ক্রমশ উত্তরে ধাবিত হয়। গুজরাট ও রাজস্থানে তাপমাত্রা অধিক হওয়ায় বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া আরাবল্লি পর্বতমালা মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান করায় মৌসুমি বায়ু খুব একটা বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না।
বঙ্গোপসাগরীয় শাখা (Bay of Bengal branch) :
মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটির শ্রীলঙ্কায় আগমন ঘটে মে মাসের শেষ সপ্তাহে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এটি তামিলনাডু উপকূলে এসে পৌঁছায়। এরপর এই শাখাটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। (i) একটি শাখা বাংলাদেশ হয়ে অসমে প্রবেশ করে। অন্য শাখাটি উত্তরবঙ্গে শিবালিকে ধাক্কা খেয়ে বামদিকে বেঁকে গাঙ্গেয় সমভূমির ওপর দিয়ে সোজা পাঞ্জাবের দিকে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশ ও অসমের দিকে অগ্রসর হওয়া শাখাটি মেঘালয়ের গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে ধাক্কা মেরে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। খাসি পাহাড়ের দক্ষিণঢালে অবস্থিত মৌসিনরাম ও চেরাপুঞ্জি যথাক্রমে বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষণসিক্ততম অঞ্চল। মৌসিনরামের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত যেখানে 1349 সেমি, সেখানে চেরাপুঞ্জিতে 1147 সেমি। খাসি পাহাড় অতিক্রম করে এই শাখাটি যখন উত্তরমুখী হয় তখন এর অনুবাত ঢালে অবস্থিত শিলং শহরে তেমন বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। ফলে সেখানে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। শিলং-এ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 205 সেমি। এই শাখাটি আরও উত্তরে অগ্রসর হয়ে অসমের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় এসে পৌঁছালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটাই কমে আসে। (ii) অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের দিকে অগ্রসরমান শাখাটি শিবালিকে ধাক্কা খেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এরপর এই শাখাটি যত গাঙ্গেয় অববাহিকা বরাবর পশ্চিমে অগ্রসর হয় বৃষ্টিপাত ততটাই কমতে থাকে।
প্রত্যাবর্তনকারী মৌসুমি বায়ু (Retreating monsoon) :
মোটামুটিভাবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মৌসুমী বায়ুর প্রভাব কমতে থাকে। ধীরে ধীরে মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তন শুরু হয় এবং অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সমগ্র উত্তর ভারত থেকে মৌসুমি বায়ু দক্ষিণে চলে যায় ও অবশেষে অন্তর্হিত হয়। মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তনকালে স্থলভাগের ওপর অবস্থিত নিম্নচাপটি দুর্বল হতে থাকে এবং দক্ষিণ দিকে সরতে থাকে। দুর্বল উচ্চচাপ নিম্নচাপের স্থান ক্রমশ দখল করে। এই অবস্থায় উত্তর দিক থেকে স্থলভাগের বায়ু দক্ষিণ দিকে অল্প অল্প বইতে শুরু করে। অথচ তখনও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ বজায় থাকে। এর ফলে পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই দুই বায়ুর সংঘর্ষে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চল এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে এই ঝড় আশ্বিনের ঝড় নামে পরিচিত।
শীতকালীন মৌসুমি (Winter Monsoon) :
মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনের পর ডিসেম্বর মাস থেকে সমগ্র ভারত উচ্চচাপ বলয়ের অন্তর্গত হয়। বায়ুচাপ বলয়গুলি আরও দক্ষিণে সরে যায়। জলভাগের ওপর নিম্নচাপ অবস্থান করে। এ সময় উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু শীতল ও শুষ্ক। ভারতে এই বায়ুপ্রবাহ শীতকালীন মৌসুমি বায়ু হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে এই বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময়ও প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে। তাই তামিলনাড়ু উপকূলে এসে এই বায়ু এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এভাবে শীতকালীন মৌসুমি ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর প্রভাবের জন্য তামিলনাড়ুতে বছরে দু-বার বৃষ্টি হয়