যন্ত্রশিল্পের অবস্থানের ওপর বাজারের প্রভাব(Influence of Market on Location of Industries)
বাজার বলতে ক্রেতা ও বিক্রেতা অর্থাৎ বায়ার অ্যান্ড সেলার (buyer and seller) বা উৎপাদক ও উপভোক্ত অর্থাৎ প্রোডিউসার অ্যান্ড কনজিউমার (producer and consumer)-এর মধ্যে সম্পর্ককে বোঝায়। যেখানেই শিল্প বা জনবসতি আছে, সেখানেই বাজার গড়ে ওঠে। বাজারের আয়তন ও বাজারের নিকটবর্তী লোকজনের বৈষয়িক সমৃদ্ধি, শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে থাকে। তবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, চাহিদা, রুচি ও জনসংখ্যার পরিমাণের উপর বাজারের আয়তন ও পরিধি নির্ভর করে। যেমন- বিদেশি ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারীদের কাছে ভারত এক বিরাট বাজার। আবার ভারতের মধ্যে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই হল বড়ো মাপের বাজার। সে-তুলনায় ডায়মন্ডহারবার, দিঘা, পুরী, দার্জিলিং অনেক ছোটো বাজার। শিল্পের ধরন ও শিল্পের অবস্থানের উপর বাজারের গুরুত্ব হল-
(1) যে-সমস্ত শিল্পে 'বিশুদ্ধ' (Pure) শ্রেণির কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, সেই শিল্প-সংস্থাগুলি বাজার বা বাজারের নিকটবর্তী কোনো স্থানে গড়ে উঠতে পারে।
(2) ভৌগোলিক এস্টল ও বুখানান (1970)-এর মতে, কোনো জায়গায় কিছু শিল্প কেন্দ্রীভূত হলেই বাজার গড়ে ওঠে এবং শিল্পের সেই অবস্থানকে "বাজার-কেন্দ্রিক অবস্থান" (market location) বলে। এমনকি, কিছু শিল্প যদি কাঁচামালের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়, তবে সেই কাঁচামাল-নির্ভর অবস্থানকেও বাজার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, ["A concentration of industry at any point creates a market at that point and a raw material location can become a market location too" Estall, R.C. & Buchanan. R.O., (1970). Industrial activity and Economic Geography.]
(3) যে শিল্পে কাঁচামালের পরিবহন ব্যয়ের তুলনায় বাজারে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহের ব্যয় বেশি, সেই শিল্প, বাজার বা বাজারের নিকটবর্তী স্থানে গড়ে-ওঠার সম্ভাবনা বেশি, যেমন কাচের বাসন উৎপাদন শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প ইত্যাদি।
(4) যে-সমস্ত শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য ভঙ্গুর প্রকৃতির অর্থাৎ ফ্ল্যাজাইল (fragile), সেইসব শিল্প বাজারের কাছাকাছি গড়ে তোলার উপযুক্ত। যেমন- কাচ শিল্প।
(5) যেসব শিল্পসংস্থার উৎপাদিত পণ্য আয়তন বা আকারে বড়ো মাপের, সেই পণ্যগুলি বাজারে সরবরাহ করার খরচ বেশি। এই বাড়তি পরিবহন ব্যয় যাতে শিল্পের মোট লাভের অঙ্কটিকে কমিয়ে না দিতে পারে, সেজন্য ওই শিল্পগুলিকে বাজারের কাছাকাছি গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যেমন- রেফ্রিজারেটর উৎপাদন শিল্প, স্টিলের আসবাব উৎপাদন শিল্প প্রভৃতি।
(6) যেসব শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য ভারী বা ওজনদার, সেই শিল্পসংস্থাগুলিও বাজারের কাছাকাছি গড়ে-ওঠে, যেমন- ইট শিল্প। (7) যেসব শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য দ্রুত পচনশীল, সেই শিল্পগুলিকে বাজারের কাছাকাছি গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয়,
যেমন- পাঁউরুটি, কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি প্রস্তুত করার জন্য বেকারি (bakery) শিল্প বা দুগ্ধশিল্প।
(৪) যে-সমস্ত শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য পরিবহন করা অসুবিধাজনক বা যে উৎপাদিত সামগ্রী দুর্ঘটনাপ্রবণ, সেই জাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলি বাজারের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত হয়, যেমন- রাসায়নিক শিল্প।
(9) যে-সমস্ত শিল্প সর্বাধুনিক "ফ্যাশন" ও "স্টাইল"-নির্ভর, সেই শিল্পগুলিও বাজারের কাছাকাছি গড়ে ওঠে, যেমন রেডিমেড পোশাক উৎপাদন শিল্প।
(10) যেসব শিল্পে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে নিকট সম্পর্কের প্রয়োজন, যেখানে ক্রেতার পছন্দ-অপছন্দ বিক্রেতার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে বা যেখানে উৎপাদিত দ্রব্যের নির্দিষ্ট "গ্যারান্টি পিরিয়ড" (guarantee period) বা "প্রতিশ্রুতি কাল" আছে বা যে-সমস্ত শিল্প তাদের ক্রেতাসাধারণকে মাল বিক্রির পরেও ওই মালের দেখভালের দায়িত্ব নেয় (after sales service), সেই শিল্পগুলি বাজার বা বাজারের নিকটবর্তী স্থানে গড়ে তোলা সবচেয়ে লাভজনক, যেমন- ইলেকট্রনিক শিল্প, সেলাই কল-পাখা-ফ্রিজ ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য উৎপাদন শিল্প প্রভৃতি।
(11) যেসব শিল্পে প্রচুর দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, সেই শিল্পগুলি বাজারের কাছাকাছি গড়ে ওঠে। আধুনিক শিল্পসংস্থাগুলির অধিকাংশই (যেমন- IT শিল্প) ব্যাবসায়িক সুযোগ-সুবিধার জন্য বাজারকেন্দ্রিক অবস্থান নির্বাচন করে।
যন্ত্রশিল্পের অবস্থানের ওপর শ্রমিকের প্রভাব (Influence of Labour on Location of Industries)
শ্রমিককে শিল্পের মুক্ত ও গতিশীল (free and mobile) উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে শ্রমিকের মজুরি, সংখ্যা, প্রাপ্যতা ও দক্ষতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি, শিল্প গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে, যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, (1) মজুরির ভৌগোলিক তারতম্য, (2) শ্রমিকের জোগানের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অসমতা, ও (3) দক্ষ শ্রমিকের অভিবাসনের (immigration) নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোগান শিল্পের গতিকে প্রভাবিত করে। যেমন- কার্পাস-বয়নশিল্প, জুতো উৎপাদন শিল্প (shoe industries) শ্রমনিবিড় চরিত্রের। স্বাভাবিক কারণেই এই শিল্পগুলি গড়ে তোলার সময় শ্রমিকের জোগান সংক্রান্ত বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়ে। আবার, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে বিদেশী শ্রমিকরা চাকরি করতে চাইলে, তাদের ওই দেশের ভিসা, অভিবাসন, শ্রমিক, স্বাস্থ্য বিমা প্রভৃতি নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। সুতরাং, শিল্পকে লাভজনক ও প্রতিযোগিতামূলক করে গড়ে তুলতে হলে অল্প মজুরিতে নির্ভরযোগ্য দক্ষ শ্রমিক কোথায় পাওয়া যায়, তার খোঁজ করা, শিল্প-সংগঠকদের এক অত্যাবশ্যকীয় কাজ।
সরকারি নীতি ও প্রশাসনিক মদতের প্রভাব(Influence of Government Policy and Administrative Support)
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সরকার তাদের গৃহীত ভিন্ন ভিন্ন নীতি অনুসারে কখনও শিল্প গড়ে তুলতে মদত জোগায়, আবার কখনও শিল্পায়নের গতিকে স্তব্ধ করে। যেমন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে ভারতে ভারি শিল্পের সূচনা করতে দুর্গাপুর, রাউরকেলা ও ভিলাই-এ লৌহ-ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলা হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পিটসবার্গ ও সন্নিহিত অঞ্চলে লৌহ-ইস্পাত শিল্পে মদত জোগাতে আমেরিকা সরকার "পিটসবার্গ প্লাস" (Pittsburg Plus) নামক নীতি চালু করেন। আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশই কম বেশি শিল্পসমৃদ্ধির পথে বৈষয়িক উন্নয়নে আগ্রহী। সেজন্য বিভিন্ন সরকার শিল্পপতিদের কাছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় "প্যাকেজ" প্রস্তাব রাখা শুরু করেছেন। যেমন শিল্প স্থাপনে আগ্রহী শিল্পপতিদের প্রথম পাঁচ বছর কর-সংক্রান্ত ছাড়, দ্রুত জমির বন্দোবস্ত, সত্বর বিদ্যুৎ সংযোগের সুবিধা ইত্যাদি নানা পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ভারতে মেক-ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পে বিদেশী শিল্প সংস্থাকে ভারতে উৎপাদন করার জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে।
শিল্পের অবস্থানকে প্রভাবিত করার মতো অন্যান্য উপাদান (Other Determinants of Industrial Location)
(1) মূলধন (Capital): মূলধনের প্রাপ্যতা বা জোগান, জনগণের সঞ্চয় প্রবণতা, সঞ্চয়ের হার, সঞ্চিত মূলত কীভাবে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার ধরন, শিল্প উন্নয়ন ব্যাংকগুলির ভূমিকা, বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক অবস্থা বা পরিস্থিতি যেখানে যত অনুকূল, শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও সেখানে তত প্রবল।
(2) শিল্পের একদেশিভবন (Localisation of industries): কোনো জায়গায় একাধিক শিল্পের একত্র সমালে ঘটলে ওই জায়গায় শুধু যে একটি বাজার গড়ে ওঠে তাই নয়, ছোটো ছোটো শিল্পসংস্থাগুলি বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেরে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সাহায্যও পেয়ে থাকে। ফলে ওই অঞ্চলে শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক শিল্পায়নের অনুকূল বাতাবর সৃষ্টি করে।
(3) বিনিয়োগ এবং FDI-এর সুযোগ (Investment and scope of FDI): আর্থিক সম্পদকে উৎপাদনমুগ্ধ বস্তুগত সম্পদে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট (investment) বলে। কোনো দেশে কোনো নির্দিধু সময়ে প্রকৃত মূলধনী দ্রব্যের মোট পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধিকে বিনিয়োগের অঙ্কে বোঝা যায়। বিনিয়োগের বৃদ্ধি ঘটলে শিল্প পরিসেবাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজের পরিধি বাড়ে। দেশের প্রাথমিক মজুত মূলধনের সঙ্গে নতুন কারখানা, নতুন যন্ত্রপারি নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়।
FDI বলতে Foreign Direct Investment অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগকে বোঝায়। কোনো বিদেশী সংস্থা অন্য কোনো দেশে নতুন কোম্পানির সহযোগী হিসাবে অথবা কোনো কারবার খরিদ করে বিনিয়োগ করতে পারে। যেমন- ভারতে মারুতি মোটরগাড়ি উৎপাদক সংস্থার সঙ্গে জাপানের সুজুকি কোম্পানি সহযোগী হিসেবে বিনিয়োগ করেছে। ফলে আধুনিক ও উন্নত জাপানি প্রযুক্তিতে তৈরি মারুতি-সুজুকি মোটরগাড়ি ভারতে ভালো ব্যবসা করছে। মোটরগাড়ি উৎপাদন শিল্পের প্রসার ঘটছে।