যন্ত্রশিল্পের অবস্থানের ওপর পরিবহন ও পরিবহন মাধ্যমের প্রভাব(Influence of Transport and their Modes on Location of Industries)
পরিবহন মাধ্যমগুলিকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন (1) সড়ক পরিবহন, (2) রেল পরিবহন, (3) জল পরিবহন ও (4) বিমান পরিবহন।
(1) সড়ক পরিবহন বা রোড ট্রান্সপোর্ট (Road transport):
অল্প দূরত্বের মধ্যে স্বল্প পরিমাণ মালের জন্য সড়ক পরিবহন সবচেয়ে লাভজনক মাধ্যম। সড়ক পথে, একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত লরি, টেম্পো, ট্রলিভ্যান, রিক্সা প্রভৃতি মাধ্যমের পরিবহন ভাড়া বাবদ প্রত্যক্ষ ব্যয়, রেল, জাহাজ প্রভৃতি মাধ্যমগুলির তুলনায় অনেক কম
(2) রেল পরিবহন বা রেল ট্রান্সপোর্ট (Rail transport):
দেশের ভেতরে কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মাঝামাঝি দৈর্ঘ্যের দূরত্বের মধ্যে প্রচুর ভারী মাল পরিবহনের জন্য রেল। ব্যবস্থা, সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার তুলনায় সস্তা, কার্যকর এবং লাভজনক । এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বল্প দূরত্বের জন্য রেল পরিবহনের খরচ সড়ক পরিবহনের তুলনায় বেশি। তবে কোন্ নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত সড়ক পরিবহন লাভজনক এবং কতখানি দূরত্বের মধ্যে রেল পরিবহন সস্তা, এই দূরত্ব-নির্ধারক হিসাব এক-এক দেশে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে - ভূপ্রকৃতি, পরিবহন প্রযুক্তি, রাস্তাঘাটের অবস্থা, পরিবহন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, সরকারি নীতি ইত্যাদি কারণের জন্য
(3) জল পরিবহন বা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট (Water transport):
বিশাল দূরত্বের মধ্যে যে-কোনো ওজনের, যে-কোনো মাপের, প্রচুর জিনিস সরবরাহ করতে হলে, জল পরিবহন অদ্বিতীয়। সে-কারণেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জল পরিবহনের কোনো জুড়ি নাই। অর্থাৎ অল্প দূরত্বের জন্য সড়ক পরিবহন, মাঝামাঝি দূরত্বের জন্য রেল পরিবহন ও তার চেয়ে বেশি দূরত্বের জন্য জল পরিবহন লাভজনক (চিত্র 3.1)। এখানে উল্লেখ থাকে যে, জল পরিবহনে জ্বালানি, অর্থাৎ কয়লা, ডিজেল বাবদ খরচ সবচেয়ে কম। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সমস্যার কথা চিন্তা করে, ক্রান্তীয় বিশ্বের নদীমাতৃক দেশগুলিতে সেজন্য জল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
(4) বিমান পরিবহন বা এয়ার ট্রান্সপোর্ট (Air transport):
খুব দামি বা অতিদ্রুত পচনশীল সামগ্রী বা যে জিনিস সত্ত্বর পৌঁছনো দরকার, বা যেখানে রেল, সড়ক বা জল পরিবহনের সুযোগ অল্প বা থাকলেও অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ, যেমন- কলকাতা-ত্রিপুরা বা দিল্লি-পোর্ট ব্লেয়ার-এর মধ্যে মালপত্র আদান-প্রদান ইত্যাদি অবস্থার জন্য বিমান পরিবহন হল কার্যকর মাধ্যম। ফুল, দুধ, মাখন, সামরিক সাজ-সরঞ্জাম, রোগ-মহামারি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ বা সংগঠক-বিশেষজ্ঞ-ব্যাবসাদার-বণিক-প্রশাসক শ্রেণির লোকজনের যাতায়াতের জন্য বিমান পরিসেবার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। নচেৎ কোনো সাধারণ কাঁচামাল বা কোনো কমদামি জিনিস পরিবহনের জন্য বিমান পরিবহন মোটেই লাভজনক নয়।
একচেটিয়া পরিবহনকারীর গুরুত্বঃ
যে-সমস্ত অঞ্চলে পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষত সড়ক পরিবহন, কোনো একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া কারবার, সে-সমস্ত অঞ্চলে শিল্পায়নের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। কারণ একচেটিয়া বা মনোপলি (monopoly) কারবারের প্রকৃতি অনুযায়ী এক্ষেত্রে পরিবহন খরচ ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানিক সুবিধার নীতির ওপর নির্ভরশীল।
পরিবহন ব্যয়-কাঠামোর উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ:
শিল্পায়ন বা শিল্পের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে অনেক সময় কোনো সরকার বা প্রশাসন দূরত্বের আনুপাতিক পরিবহন ব্যয় বা আঞ্চলিক সমপরিবহন ব্যয় (ফ্রেট কস্ট বা ব্ল্যাংকেট রেট) কাঠামোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভরতুকি দিয়ে পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে ওই অঞ্চলে পরিবহন ব্যয় কাঠামো সংগঠকদের লাভজনক বলে মনে হয়। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সুপিরিয়র হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলে লৌহ-ইস্পাত শিল্প গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সরকার "পিটসবার্গ প্লাস" (Pittsburg Plus) পদ্ধতি চালু করেন।
এই পদ্ধতি অনুসারে দেশের যে-কোনো স্থানে ইস্পাত পরিবহনের খরচকে পিটসবার্গ থেকে ওই স্থানে ইস্পাত পরিবহন করতে হলে আসলে যে খরচ হত, সেই খরচ ধরা হয়। যেমন সান ফ্রানসিসকো থেকে সিয়াটলে ইস্পাত পরিবহনের ধার্য খরচ - পিটসবার্গ থেকে সিয়াটলে ইস্পাতের সরবরাহ ব্যয়; হাউসটন থেকে হাউসটনে ইস্পাত পরিবহনের ধার্য খরচ = পিটসবার্গ থেকে হাউসটনে ইস্পাতের সরবরাহ ব্যয়। অর্থাৎ এই নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যয়-কাঠামো অনুসারে পিটসবার্গে উৎপাদিত ইস্পাতের দাম সব সময় লাভজনক। এই নীতির ফলে পিটসবার্গ অঞ্চলে ইস্পাত শিল্পের একদেশিভক ঘটে।
1924 সালের পর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ইস্পাত প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির প্রচণ্ড প্রতিবাদের ফলে আমেরিকান সরকার "পিটসবার্গ প্লাস" পদ্ধতি প্রত্যাহার করেন।