বায়ুচাপের অনুভূমিক বণ্টন: বায়ুর চাপবলয়: (Horizontal distribution of pressure: Pressure Belts):
পৃথিবীপৃষ্ঠে সৃষ্ট চাপ বলয়গুলি কেবলমাত্র একটি তাপীয় প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং এগুলি তাপীয় ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মিলিত ফসল। কালভেদে তাপীয় নিরক্ষরেখা পার্থিব নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর ও দক্ষিণে কিছুটা স্থান পরিবর্তন করলেও তাপীয় নিরক্ষরেখা বরাবর নিম্নচাপ এবং উভয় মেরুর দিকে ক্রমান্বয়ে উচ্চচাপ সৃষ্টি হত, কোনো স্বতন্ত্র চাপবলয় সৃষ্টি হত না। বায়ুচাপ নিয়ন্ত্রণে তাপীয় প্রভাব বা প্রক্রিয়ার সাথে যান্ত্রিক প্রভাব বা প্রক্রিয়ার মেলবন্ধনে পৃথিবীপৃষ্ঠে 'টি সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র চাপবলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
যান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে বায়ুর অবক্ষেপণ জনিত কারণে কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় এবং বায়ুর বিক্ষেপণ জনিত কারণে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চল বা বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আবার উভয় মেরুতে অতি শীতলতার কারণে তাপীয় প্রক্রিয়ায় ও উভয় মেরু প্রদেশ থেকে বিক্ষিপ্ত বায়ুপুঞ্জের অবনমনজনিত কারণে উচ্চচাপ অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এদের নির বিচ্ছিন্ন বিস্তৃতির ক্ষেত্রে জলভাগ ও স্থলভাগের অবস্থান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই মুখ্য প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট চাপবলয়গুলির মধ্যে আছে 4টি উচ্চচাপ বলয় ও 3টি নিম্নচাপ বলয় । এগুলি হল-
1. নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়, 2. কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয়, 3. মকরীয় উচ্চচাপ বলয়, 4. সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়, 5. কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়, 6. সুমেরু উচ্চচাপ বলয় ও 7. কুমেরু উচ্চচাপ বলয়।
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় (Equatorial Low Pressure Belts):
এই অঞ্চলে নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে 5° থেকে 10° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে এই নিম্নচাপ বলয়টি বিস্তৃত। বায়ুর চাপ কম হওয়ার অন্যতম চারটি কারণ হল-
(a) নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য সারাবছরই প্রায় উল্লম্বভাবে কিরণ দেয়। তাই ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু দ্রুত তাপ শোষণ করে উয় ও হালকা হয়ে পড়ে। উন্ন বায়ু প্রসারিত হওয়ায় এর ঘনত্ব কমে যায়। তাই এই বায়ু পার্শ্বচাপের প্রভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়। ফলে এই অঞ্চলে বায়ুর চাপ কম থাকে।
(b) এই অঞ্চলে স্থলভাগ অপেক্ষা জলভাগ বেশি। তাই প্রচণ্ড উত্তাপে জল বাষ্পে পরিণত হয় এবং বায়ুতে জলীয় বাষ্পের মিশ্রণ ঘটে। জলীয় বাষ্প শুষ্ক বায়ুর তুলনায় হালকা হওয়ায় জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে।
(c) নিরক্ষীয় অঞ্চলে বায়ুর ভরকেন্দ্রের দূরত্ব পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে অধিক হওয়ায় অভিকর্ষ বলের মান কম হয়। তাই বায়ুচাপও কম অনুভূত হয়।
(d) নিরক্ষীয় অঞ্চলে চিরহরিৎ অরণ্যের অবস্থানের ফলে বায়ুতে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় মেশে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে বায়ু হালকা হয় ও চাপ কম অনুভূত হয়।
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়টিতে সারাবছরই উপরিউক্ত ঘটনাগুলির কারণে বায়ু সর্বদাই ঊর্ধ্বমুখী হয়। ফলে ভূপৃষ্ঠে বায়ুর কোনো পার্শ্বপ্রবাহ (Horizontal movement) লক্ষ করা যায় না। তাই বায়ুমণ্ডলে সবসময়ই শান্ত ভাব বজায় থাকে। সেই কারণে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়কে নিরক্ষীয় শান্ত বলয় (Doldrums) বলা হয়। প্রাচীন কালে পালতোলা জাহাজে যাতায়াতের সময় ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বায়ুপ্রবাহের অনুপস্থিতির কারণে যেহেতু এই অঞ্চলে জাহাজ প্রায়ই থেমে যেত তাই নাবিকেরা এই অঞ্চলের নামকরণ করেন ডোলড্রাম।
ক্রান্তীয় উচ্চচাপ অথবা কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় (Tropical High Pressure Belts) :
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে মোটামুটি 25° থেকে 35° সমাক্ষরেখার মধ্যে ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় দুটি অবস্থিত। উত্তর গোলার্ধে এই উচ্চচাপ বলয়টিকে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এই উচ্চচাপ বলয়টিকে মকরীয় উচ্চচাপ বলয় বলা হয়। এই অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টির অন্যতম কারণগুলি হল-
(a) নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ু পরিচলন পদ্ধতিতে ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলীয় স্তরে উত্থিত হয়ে ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে লীনতাপ ত্যাগ করে। এই লীনতাপই এই বায়ুপুঞ্জের উত্তর ও দক্ষিণে প্রবাহিত হওয়ার চালিকা শক্তি। ঊর্ধ্বমণ্ডলের এই বায়ু দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহের সময় ক্রমশ শীতল ও সংকুচিত হয়ে এই দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে নেমে আসে।
(b) দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশ থেকে শীতল ও ভারী বায়ু রসবি তরঙ্গের প্রভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে কর্কটীয় ও মকরক্রান্তীয়
অঞ্চলে এসে পৌঁছানোর কারণেও এই অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। এই দুই উচ্চচাপ বলয়ে বায়ু শীতল ও ভারী হওয়ায় সর্বদাই নিম্নমুখী হয়। তাই ভূপৃষ্ঠের এই বলয় দুটিতে ভূপৃষ্ঠের
সমান্তরালে কোনো বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায় না। তাই বায়ুমণ্ডলে সর্বদা শান্তভাব বিরাজ করে। তাই এই বলয় দুটিকে ক্রান্তীয় শান্তবলয় (Tropical Calms) বলা হয়। এই শান্ত বলয় দুটিকে আবার অশ্ব অক্ষাংশও (Horse Lati- tude) বলা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত কর্কটীয় শান্ত বলয়কেই (30° - 35° N) অশ্ব অক্ষাংশ নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে একই রকম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্য উভয় গোলার্ধের ক্রান্তীয় শান্তবলয়কেই অশ্ব অক্ষাংশ বলা হয়।
দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় (সুমেরু ও কুমেরু) নিম্নচাপ বলয় (Sub-polar Low Pressure Belt):
উভয় গোলার্ধে 60°-70° অক্ষরেখার মধ্যে সুমেরু ও কুমেরু বৃত্ত বরাবর দুটি নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর গোলার্ধে এর নাম সুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় ও দক্ষিণ গোলার্ধে কুমেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়। তবে উত্তর গোলার্ধে স্থলভাগের পরিমাণ জলভাগের তুলনায় বেশি থাকায় এবং এদের অসম বণ্টনের কারণে নিম্নচাপ বলয়টি একটানা বিস্তৃত না হয়ে কয়েকটি ক্ষুদ্র নিম্নচাপ কোশ হিসেবে অবস্থান করে। এই দুটি অঞ্চলে নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টি হওয়ার প্রধান প্রধান কারণগুলি হল-
(a) ক্রান্তীয় অঞ্চলের তুলনায় মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে কোরিওলিস বল অধিক থাকায় কেন্দ্রবহির্মুখী (Centrifugal) বলের প্রভাব বেশি হয়, ফলে বায়ুর সর্বাধিক গতিবিক্ষেপ ঘটে। তাই, এই অঞ্চলে সারাবছর নিম্নচাপ বিরাজ করে।
(b) মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী বায়ু এবং ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উয় ও হালকা বায়ু মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় অঞ্চলে এসে জমা হয়। এই দুই ভিন্নধর্মী বায়ুর সমাবেশ ঘটায় উভয় প্রকার বায়ুর সম্মিলন (Convergence) ঘটে না। বরং উন্নবায়ু ও শীতলবায়ুর মধ্যে সংঘর্ষ ও সীমান্ত সৃষ্টির ফলে উল্লবায়ু ঊর্ধ্বমুখী হয়।
(c) ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত উয় সমুদ্রস্রোত এই অঞ্চলে প্রচুর উত্তাপ নিয়ে আসে। ফলে সমুদ্র সংলগ্ন ভূমিভাগে বায়ুর উয়তা তুলনামূলকভাবে বাড়িয়ে নিম্নচাপ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের মতো দুই মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় দুটিতে বায়ু সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী হয় বলে ভূপৃষ্ঠে অনুভূমিক বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায় না। তাই এই দুই বলয়েও শান্তবলয় সৃষ্টি হয়েছে।
দুই মেরুদেশীয় (সুমের ও কুমের) উচ্চচাপ বলয় (Polar High Pressure Belt):
দুই মেরুবিন্দু সংলগ্ন অঞ্চলে সারাবছরই স্থায়ী উচ্চচাপ বিরাজ করে। উত্তর গোলার্ধে এই উচ্চচাপ বলয়কে সুমেরু উচ্চচাপ বলয় এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এই বলয়কে কুমেরু উচ্চচাপ বলয় বলা হয়। প্রধানত তিনটি কারণের সম্মিলিত প্রভাবে এখানে উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
(a) দুই মেরুতে সারাবছরই উন্নতা অত্যন্ত কম থাকে। এমনকি গ্রীষ্মকালেও এখানকার উয়তা হিমাঙ্কের নীচে থাকে। তাই এই অঞ্চলে বায়ু অত্যধিক শীতল, ভারী ও অধিক ঘনত্বযুক্ত হয়। এই কোরিওলিস বল সর্বাধিক হওয়া সত্ত্বেও বায়ুর ঘনত্ব অধিক বৃদ্ধির কারণে এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
(b) সূর্যরশ্মি অত্যন্ত তির্যকভাবে পড়ায় বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণও খুব নগণ্য। তাই আর্দ্রতার পরিমাণও কম। ফলে বায়ু শীতল ও ভারী হয়।
(c) পৃথিবীর আবর্তন গতির কারণে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চল থেকে ছিটকে ওপরে উঠে আসা বায়ু এই অঞ্চলে নেমে এসে বায়ুচাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে।
(d) মেরুবিন্দুদ্বয়ে অবস্থিত বায়ুর ভরকেন্দ্রের দূরত্ব পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে কাছে অবস্থান করায় অভিকর্ষ বলের মান বেশি হয়। এর প্রভাবে মেরু অঞ্চলে বায়ুর চাপ অধিক অনুভূত হয়।