দ্রাঘিমারেখা বরাবর সঞ্চলন চক্র (Meridional Circulational Model) :
বায়ুমণ্ডলের সাধারণ সঞ্চলন সম্পর্কিত গবেষণার প্রথম দিকে দ্রাঘিমারেখা বরাবর সঞ্চলন চক্রের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই বিষয় সম্পর্কে দুটি মতবাদ প্রচলিত। এগুলি হল-1. হ্যাডলির এককোষীয় সঞ্চলন চক্র ও 2. হ্যাডলির ত্রিকোষীয় সঞ্চলন চক্র।
A. হ্যাডলির এককোশীয় সঞ্চলন চক্র (Single-cell circulation model):
বায়ু সঞ্চলন সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বপ্রথম অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ আবহবিদ জর্জ হ্যাডলি (George Hadley) সম্পূর্ণভাবে সরাসরি উত্তাপের দ্বারা প্রভাবিত (thermally direct cell) দুটি বায়ু সঞ্চলন চক্রের ধারণা দেন যা এক কোশীয় সঞ্চলন চক্র (Single-cell Circulation Model) নামে পরিচিত। অনুমান সমূহ (Assumptions) এই চক্র কতকগুলি অনুমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত-
(a) ভূপৃষ্ঠ একটি সমসত্ব উপাদানে গঠিত বা জল ও স্থলভাগ উপস্থিত থাকলেও এগুলি উত্তাপ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে না।
(b) সূর্য সর্বদাই নিরক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে এবং মেরুর দিকে ক্রমাগত তির্যকভাবে পড়ে। তাই মেরুর দিকে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ গ্রহণের হার কমতে থাকে।
(c) পৃথিবীর আবর্তন বেগ এখানে অনুপস্থিত। তাই শুধুমাত্র বায়ুচাপীয় ঢালই বায়ুপ্রবাহে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে।
ব্যাখা (Explanations):
নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্থায়ী নিম্নচাপ ও মেরু অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ বিরাজ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বায়ুচাপীয় ঢাল মেরুঅঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে বিস্তৃত হবে। ফলে উভয় মেরু থেকে নিরক্ষরেখার দিকে বায়ু প্রবাহিত হবে। যেহেতু নিরক্ষরেখায় উত্তাপের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাই এখানে বায়ু ঊর্ধ্বমুখী হবে এবং ঊর্ধ্ববায়ুমণ্ডলে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে বায়ু প্রবাহিত হবে ও ক্রমশ শীতল হয়ে মেরু অঞ্চলের দিকে নেমে আসবে। এভাবে মেরু অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপ কক্ষের সৃষ্টি হবে। হ্যাডলি প্রস্তাবিত তাপন প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট চক্র সরাসরি চক্র (Hadley cell) নামে পরিচিত।
• সীমাবদ্ধতা (Limitations):
পৃথিবীর আবর্তন বেগের উপস্থিতির জন্য হ্যাডলি প্রদত্ত এককোশীয় বায়ু সঞ্চলন চক্র বাস্তবে ক্রিয়াশীল হওয়া সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট কৌণিক ভরবেগ ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ার দিয়ে প্রবাহিত মেবুমুখী বায়ুকে পূর্বদিকে বিক্ষিপ্ত করে। উপরন্তু মেরুর দিকে ঘূর্ণায়মান অক্ষের ব্যাসার্ধ (r) কমতে থাকায় ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য বায়ুর গতিবেগ ক্রমশ বাড়তে থাকত । এই অবস্থায় মোটামুটি 30° অক্ষাংশের কাছে বায়ু সর্বাধিক গতি লাভ করত এবং সম্পূর্ণ পূর্বাভিমুখী হত। এর ফলে বায়ুর গতিবেগ জনিত তীব্র আন্দোলনে বায়ু ছোটো ছোটো উচ্চচাপীয় কক্ষ বিশিষ্ট ঘূর্ণাবর্ত (eddy) সৃষ্টি করত এবং হ্যাট্লি চক্রটি নিম্ন অক্ষাংশেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত। সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য ও পৃথিবীর আবর্তন গতির সম্মিলিত প্রভাবে সমগ্র পৃথিবীকে তিনটি নিম্নচাপ বলয় ও চারটি উচ্চচাপবলয় পরিবেষ্টন করে আছে, যার প্রভাবে সৃষ্ট বায়ুচাপ ঢাল বরাবর নিয়ত বায়ু প্রবাহিত হয়। এই কারণেই এককোষীয় সঞ্চলন চক্রের পরিবর্তে পরবর্তিকালে ত্রিকোষীয় সঞ্চলন চক্রের উদ্ভব হয়।
B. হ্যাডলির ত্রি-কোশীয় তত্ত্ব (Tri-cellular Model) :
আবহবিজ্ঞানী উইলিয়াম ফেরেল 1856 সালে বায়ুচাপ বলয়ের বণ্টন ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের প্রভাবে হ্যাডলির চক্রকে নিরক্ষরেখা থেকে উভয় গোলার্ধে 30° অক্ষাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে আরও দুটি অর্থাৎ, প্রত্যেক গোলার্ধে তিনটি করে বায়ু সঞ্চলন কোশের উপস্থাপন করেন। একেই ত্রি-কোশীয় সঞ্চলন চক্র (Tri-cellular Circulation model) বলে। 1941 সালে রসবি (Rossby), 1951 সালে বিজ্ঞানী পলম্যান (Palmen), 1969-এ নিউটন (Newton) এই মডেলটির সম্পূর্ণ রূপ দেন। (চিত্র: 9.3)
1. হ্যাডলি চক্র (Hadley cell):
নিরক্ষরেখার উভয় দিকে 30° অক্ষরেখা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অর্থাৎ, নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় থেকে ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের মধ্যে আয়ন বায়ু দ্বারা পরিচালিত বায়ুসংবহন চক্রটি হ্যাডলির কোশ নামে পরিচিত।
নিরক্ষীয় অঞ্চলে বিশেষত জলভাগের ওপর সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবে পতিত হওয়ায় বায়ু সর্বদাই উয় ও হালকা হয়। বায়ুর অনুভূমিক চাপ ঢাল খুব সামান্য হওয়ায় বায়ুপ্রবাহও দুর্বল প্রকৃতির না হয়। তাই ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে দ্রুত গতিসম্পন্ন বায়ু খুব একটা প্রবাহিত না হওয়ায় নিরক্ষরেখার উভয়পার্শ্বে 5° অক্ষরেখার মধ্যে শান্ত ভাব বিরাজ করে। তাই এই অঞ্চলকে নিরক্ষীয় শান্তবলয় বা এক ডোলড্রাম (Doldrums) বলা হয়।
এখানে বায়ু নিউয় ও হালকা হওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী হতে বাধ্য হয়, এর ফলে মাঝে মধ্যেই ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় কিউমুলাস বা কিউমুলোনিম্বাস মেঘ সৃষ্টি হয়।
এর প্রভাবে এই অঞ্চলে বজ্রঝড়সহ বৃষ্টিপাত প্রায়ই ঘটতে থাকে। ঘনীভবনের এর কারণে এখানকার বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে লীনতাপ (Latent heat) মুক্ত হয়। এই লীনতাপ বায়ুকে ভাসমানতা (buoyancy) প্রদান করে এবং হ্যাডলি কোশ সঞ্চালনে সাহায্য করে। ঊর্ধ্বমুখী এই বায়ু ট্রপোস্ফিয়ারের শেষ সীমা অর্থাৎ ট্রপোপজে পৌছালে তা উভয় মেরুদিকে বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কোরিওলিস বলের প্রভাবে উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু ডানদিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে ক্রমশ পূর্বাভিমুখী হয়ে পড়ে।
ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে মেরুমুখী এই বায়ু ক্রমাগত তাপবিকিরণ করে শীতল ও ভারী হতে থাকে। উপরন্তু এই বায়ু যখন মধ্যঅক্ষাংশীয় অঞ্চলে এসে পৌছায় তখন মেরু অঞ্চল থেকে আগত বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়। ফলে বায়ুর পরিমাণ ও ঘনত্ব বাড়তে থাকায় উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বা 30° অক্ষরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে নিম্নমুখীবায়ু সঞ্চিত হয়ে বায়ুচাপ বাড়িয়ে তোলে। তাই এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়া কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য বায়ুর গতিবেগ এই অঞ্চলে বাড়তে থাকে এবং বায়ু 30° অক্ষাংশের কাছাকাছি সম্পূর্ণ পূর্বাভিমুখী হয়ে পড়ে এবং জেট বায়ুপ্রবাহের (Jet stream) সৃষ্টি করে। এই অঞ্চলের বায়ু উল্লম্বভাবে ভূপৃষ্ঠের ওপর নামতে থাকে। ফলে ভূপৃষ্ঠ দিয়ে এই অক্ষাংশীয় অঞ্চলে কোনো অনুভূমিক বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায় না। তাই আগেকার দিনের পালতোলা জাহাজগুলি এখানে এসে গতিহীন হয়ে পড়ত। ফলে খাদ্য ও পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে ঘোড়াগুলিকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হত। তাই ক্রান্তীয় এই শান্তবলয়কে অশ্ব অক্ষাংশ (Horse Latitude) বলা হয়।
অশ্ব অক্ষাংশ থেকে কিছু পরিমাণ বায়ু ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে নিরক্ষরেখার অভিমুখে সঞ্চালিত হয় এবং কোরিওলিস বলের প্রভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে ফেরেলের সূত্রানুযায়ী উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বাঁক নিয়ে অর্থাৎ উত্তর- পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বাঁক নিয়ে অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। সারাবছর ধরে এই বায়ু নিয়মিত ও নির্দিষ্ট দিক থেকে প্রবাহিত হওয়ায় পূর্বে ভারত মহাসাগরের দিকে পাড়ি দেওয়া পালতোলা জাহাজগুলি এই বায়ুপ্রবাহের পথ অনুসরণ করে চলত।
এই জাহাজগুলি প্রধানত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই চলাচল করত। তাই বাণিজ্যের সুবিধার জন্য অনেকে মনে করেন এই বায়ুপ্রবাহের নামকরণ করা হয় বাণিজ্য বায়ু (Trade Wind)*। আবার, এই বায়ুপ্রবাহটি সারাবছর নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয় বলে এটি আয়ন বায়ু নামেও অভিহিত করা হয়। আয়ন শব্দের অর্থ পথ। উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় পর্যন্ত প্রবাহিত এই আয়ন বায়ু উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং মকরীয় উচ্চচাপবলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় পর্যন্ত প্রবাহিত এই বায়ু দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নামে পরিচিত।
উভয় উচ্চচাপ বলয় থেকে আগত এই আয়ন বায়ু নিরক্ষীয় অঞ্চলে এসে সম্মিলিত হয়। এই সম্মিলন বলয়টিকে আন্তঃক্রান্তীয় সম্মিলন বলয় (Inter Tropical Convergence Zone) বা ITCZ নামে অভিহিত করা হয়। জলভাগ ও স্থলভাগের অসম বণ্টনের কারণে এই বলয়টি একটানা না হয়ে কয়েকটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত হয়েছে।
সুতরাং এভাবে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে উয়বায়ু উর্ধ্বমুখী হয়ে ট্রপোস্ফিয়ারের উপরিভাগ দিয়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত বায়ু শীতল ও ভারী হয়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলে নিমজ্জনের পর পুনরায় আয়ন বায়ুরূপে ভুপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলে চলে আসে এবং হ্যাডলি চক্র সম্পূর্ণ করে। ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ার দিয়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত এই উল্লবায়ু যেহেতু আয়নবায়ুর বিপরীতে পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত হয়, তাই এই বায়ুপ্রবাহের নাম প্রত্যয়ন বায়ু (Antitrade Wind)। নিরক্ষীয় অঞ্চলে আগত সৌরশক্তির প্রভাবে বায়ু উত্তপ্ত হওয়ায় যেহেতু এই সংবহন চক্রের সূচনা হয় এবং ঊর্ধ্বাকাশে মুক্ত হওয়া লীন তাপ যেহেতু প্রত্যয়ন বায়ুর ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহের প্রধান চালিকা শক্তি, তাই হ্যাডলির চক্রকে সরাসরি উত্তাপের দ্বারা প্রভাবিত চক্র (Thermally direct cell) বলা হয়।
2. ফেরেল চক্র (Ferrel cell) :
উভয় গোলার্ধে উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় এবং মেরুবৃত্তপ্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের মধ্যে পশ্চিমা বায়ু দ্বারা যে বায়ুসংবহন চক্রটি পরিচালিত তাকে ফেরেল চক্র বলে। এই চক্রটি হ্যাডলি চক্রের ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠস্থ বায়ু মেরুমুখী কোরিওলিস বলের প্রভাবে পূর্বাভিমুখী হওয়ায় পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। তাই এই বায়ুপ্রবাহকে পশ্চিমা বায়ু (Westerly) বলে।
আবার, ঊর্ধ্বস্তরের বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়। মূলত অশ্ব অক্ষাংশ থেকে ভূপৃষ্ঠস্থ সব বায়ুপ্রবাহই নিরক্ষরেখামুখী না হয়ে কিছু পরিমাণ বায়ু মেরুমুখী হয়। এই সময় আবর্তন গতির প্রভাবে ও কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণহেতু বায়ু পূর্বাভিমুখী হতে থাকে। উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু রূপে প্রবাহিত হয়। পশ্চিমা বায়ু যখন মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলে এসে পৌছায় তখন মেরু অঞ্চল থেকে আসা শীতল মেরুবায়ুর সম্মুখীন হয়। ভিন্ন তাপমাত্রা ও ঘনত্ব বিশিষ্ট এই দুই বায়ু কখনোই মিলিত হয় না বরং এই দুই প্রকার বায়ু একে অপরের সাপেক্ষে একটি সীমানা তৈরি করে, যাকে মেরু সীমান্ত বা Polar front বলে। এই সীমান্ত বরাবর উয়, আর্দ্র হালকা বায়ু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মেঘ সৃষ্টি করে ও ঘূর্ণবাতের পরিবেশ সৃষ্টি করে। ঊর্ধ্বমুখী এই বায়ুর কিছু অংশ ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়ে ফেরেল চক্র সম্পাদনে সহায়তা করে।
ফেরেল কোশটিকে তাপীয় পরোক্ষ কোশ (Thermally Indirect cell) বলা হয়। কারণ এই সঞ্চলন কোশটি হ্যাডলি কিংবা মেরু কোষের ন্যায় ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয় না। নিম্ন অক্ষাংশ থেকে আগত উয় পশ্চিমা বায়ু এবং উচ্চ অক্ষাংশ থেকে আগত শীতল মেরু বায়ু দ্বারা সীমান্ত সৃষ্টি এবং রসবি তরঙ্গের Zonal flow-এর মাধ্যমে উত্তাপের আদানপ্রদান দ্বারা এই সঞ্চলন চক্রটি সম্পাদিত হয়।
3. মেরু চক্র (Polar cell) :
উভয় গোলার্ধে মেরুবৃত্ত প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় এবং মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের মধ্যে মেরুবায়ু প্রভাবিত যে বায়ু সংবহন চক্রটি সক্রিয় থাকে তাকেই মেরু চক্র (Polar cell) বলা হয়। মেরুপ্রদেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে শীতল ও ভারী বায়ু ভূপৃষ্ঠ বরাবর মেরু সীমান্তের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় কোরিওলিস বলের প্রভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। ফলে এই বায়ু মেরুদেশীয় পুবালি বায়ু (Polar easterly) নামে অভিহিত হয়।
উত্তর গোলার্ধে একে উত্তর-পূর্ব মেরু বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধে একে দক্ষিণ-পূর্ব মেরু বায়ু বলা হয়। এই শীতল পুবালি মেরু বায়ু মেরুসীমান্তের কাছে এসে অবস্থিত বায়ুপ্রাচীরের গা বেয়ে ওপরে ওঠে এবং কোরিওলিস বলের প্রভাবে মেরু বিন্দুর দিকে বিক্ষিপ্ত হয় এবং পশ্চিমা বায়ু রূপে ঊর্ধ্বাকাশে প্রবাহিত হওয়ার সময় শীতল ও ভারী হয়ে পুনরায় মেরু অঞ্চলে নেমে এসে স্থায়ী উচ্চচাপের সৃষ্টি করে।
ঊর্ধ্বাকাশে এই বায়ু যেহেতু মেরু প্রদেশে সারাবছরই নিম্নমুখী থাকে তাই ওপরের স্তরের বায়ুতে স্থায়ী তাপের বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। সাধারণত এই অঞ্চলে বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় 20 থেকে 30 কিমি পর্যন্ত হয়।
মেরু অঞ্চলে স্থায়ী উচ্চচাপটি মোটামুটিভাবে দুটি মেরুবিন্দুতেই অবস্থান করে। কিন্তু উত্তর গোলার্ধে শীতকালে দুটি শীতল মেরুর সৃষ্টি হয়-একটি পূর্ব সাইবেরিয়ার ওপর, অপরটি উত্তর-পূর্ব কানাডার ওপর। ফলে শীতকালে উত্তরমেরু সঞ্চলন কোশটি সাইবেরিয়া ও কানাডার ওপর দীর্ঘায়িত হয়ে অবস্থান করে। মেরু কোশের পরিধি শীতকালে সম্প্রসারিত হয় এবং গ্রীষ্মকালে সঙ্কুচিত হয়।
মেরু চক্রে মেরু বায়ুপ্রবাহের সীমান্তে অর্থাৎ মেরুসীমান্তের কাছাকাছি সমুদ্রের ওপর নিম্নচাপের উপস্থিতির কারণে ঝড়-ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়। এই ঝড় পশ্চিম থেকে ক্রমশ পূর্বদিকে অগ্রসর হয় এবং মেরু অঞ্চলকে বেষ্টন করে অবস্থান করে।
• ত্রিকোশীয় সঞ্চলন মডেলের সীমাবদ্ধতা (Limitations of Tri-cellular Model) :
ভূপৃষ্ঠের ওপর বায়ু সঞ্চলনে অনুভূমিক (Horizontally) ও উল্লম্ব (Vertically) প্রবাহ লক্ষ করা যায়। উল্লম্ব ও অনুভূমিক দু'টি প্রবাহ একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি করে বায়ু সঞ্চলন কক্ষ (cell), যা হ্যাডলি, ফেরেল ও মেরু কক্ষ বা চক্র নামে পরিচিত। এই তিনটি চক্র সমগ্র পৃথিবীর বায়ুপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে চক্রের মাধ্যমে বায়ুর এই সংবহন বা সঞ্চলনকে ব্যাখ্যা করা হয় তাকে ত্রি-কোশীয় নকশা বা Tri-cellular Model বলে। কিন্তু এই মডেলে বায়ু সঞ্চালনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকলেও এর বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এগুলি হল-
1. আয়ন বায়ুর বিপরীতে প্রবাহিত হয় প্রত্যয়ন বায়ু (Antitrade wind), যার উৎপত্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এই মডেল থেকে। কিন্তু বাস্তবে সমস্ত দ্রাঘিমারেখা বরাবর প্রত্যয়ন বায়ু একইভাবে প্রবাহিত হয় না।
2. স্থলভাগ ও জলভাগের অসম বণ্টনের কারণে বায়ুচাপবলয়গুলি একটানা বিস্তৃত হয় না। তাই এই মডেলের সঞ্চলন কোশগুলি নিয়মিতভাবে বিস্তৃত হয় না।
3. এই মডেলটি ফেরেল চক্রে উচ্চবায়ুস্তরে পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত পশ্চিমা বায়ুর উপস্থিতি ও শক্তিশালী হওয়ার কারণ স্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
4. বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে ঘর্ষণজনিত বাধার (Frictional force) অনুপস্থিতির কারণে বায়ু জিওস্ট্রফিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করায় সমচাপ রেখার সমান্তরালে বায়ুপ্রবাহিত হতে দেখা যায়, যা দ্রাঘিমা রেখা বরাবর বায়ুপ্রবাহের মডেলকে সমর্থন করে না। কারণ এই ধরনের জিওস্ট্রফিক বায়ু সাধারণত অক্ষরেখা বরাবর সঞ্চলিত হয়ে থাকে।
5. এই ত্রি-কোশীয় মডেলে দ্রাঘিমারেখা বরাবর প্রবাহিত সাময়িক বায়ুপ্রবাহ-যথা সমুদ্রবায়ু, স্থলবায়ু, মৌসুমিবায়ু প্রভৃতির উৎপত্তি ও বিস্তার সম্পর্কে কোনো প্রকার আলোকপাত করা হয়নি।