জেট বায়ুপ্রবাহের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Jet Stream) :
তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তন, বায়ুপ্রবাহের দিক, গতিবেগ, অবস্থান ও বিস্তৃতি অনুযায়ী জেট বায়ুপ্রবাহকে 5টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
1. মেরু সীমান্ত জেট প্রবাহ (Polar front Jet stream):
উপক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত উয় ও আর্দ্র পশ্চিমা বায়ু এবং মেরু অঞ্চল থেকে আগত শীতল ও শুষ্ক মেরু বায়ুর মিলন অঞ্চলে যেখানে উভয় প্রকার ভিন্নধর্মী বায়ুপ্রবাহ দ্বারা সীমান্তের সৃষ্টি হয় সেখানে ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে 45°-60° অক্ষাংশের মধ্যে পশ্চিম থেকে পূর্বে জেট বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। নিয়ত বায়ুপ্রবাহ দ্বারা সৃষ্ট (ফেরেল চক্র ও মেরু চক্রের মাঝে ঊর্ধ্বট্রপোস্ফিয়ারে) মেরু সীমান্তীয় অঞ্চলে এই জেট বায়ুর সৃষ্টি হওয়ায় একে মেরু সীমান্ত জেট বায়ু বলে।
এই জেটপ্রবাহ সারাবছর ধরে অনিয়মিতভাবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। এর গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় 250-300 কিলোমিটার। শীতকালে এর গতিবেগ হয় সর্বোচ্চ। শীতকালে জেটবায়ু প্রবাহটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে সরতে শুরু করে (সর্বাধিক 45° অক্ষাংশ পর্যন্ত)। ফলে শীতকালে এই বায়ু অধিক বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হয় এবং তা বিস্তৃতও হয় সর্বাধিক।
এই সময় জেট বায়ুটি দুটি বা তার বেশি শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। মেরু সীমান্তে সমচাপপৃষ্ঠ (Isobaric Surface) বরাবর উত্তর-দক্ষিণে তাপের সর্বাধিক পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট তীব্র বায়ুচাপের ঢালজনিত শক্তি (Fp) এবং বিপরীতমুখী কোরিওলিস বলের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সমচাপ রেখার সমান্তরালে পূর্বাভিমুখী জিওস্ট্রফিক বায়ুই মেরুসীমান্ত জেট বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি করে। তাই মেরু সীমান্ত জেট বায়ুকে আবহাওয়াবিদগণ প্রাথমিক জেট বায়ু (Primary Jet stream) নামে অভিহিত করেছেন। এই বায়ু সাধারণত বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির তবে কখনো কখনো সমগ্র পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে অবস্থান করে।
2. উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহ (Sub-tropical Jet stream):
ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 12 কিমি উচ্চতায় হ্যাডলি চক্র ও ফেরেল চক্রের সম্মিলন অঞ্চলে ক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের ওপর 25°-35° অক্ষাংশে পশ্চিম থেকে পূর্বে উচ্চগতিবেগসম্পন্ন আর একটি জেট বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়। একেই উপক্রান্তীয় জেট বায়ু বলে।
এই বায়ুকে আবার ক্রান্তীয় পশ্চিমা জেট বায়ুও বলা হয়। এই বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ সবসময় ও সবস্থানে একই রকম থাকে না। কোথাও অত্যন্ত প্রবল, আবার কোথাও অতি দুর্বল। কোনো স্থানে আবার এটি কয়েকদিন যাবৎ অত্যন্ত দ্রুতগতিবেগে প্রবাহিত হওয়ার পর দুর্বল হয়ে পড়ে। ঋতুভেদে উপক্রান্তীয় জেট বায়ুর গতিবেগে বেশ তারতম্য লক্ষ করা যায়। গ্রীষ্মকালে এর গতিবেগ যেখানে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় 160-250 কিমি, শীতকালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ঘণ্টায় প্রায় 375 কিমি। শীতকালে এই জেট বায়ু কিছুটা নিরক্ষরেখার দিকে স্থানান্তরিত হয় এবং অধিক বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হয়। এটি যেখানে নিরক্ষরেখার দিকে বাঁক নেয় সেখানে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ বৃদ্ধি পায়।
শীতকালে এই জেট বায়ুপ্রবাহের আবার উচ্চতারও হ্রাস ঘটে। তাই শীতকালে এই জেট বায়ুটি দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে স্থানান্তরিত হলে হিমালয় পর্বতে বাধা পেয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। উত্তর শাখাটি তিব্বত মালভূমির উত্তরে অবস্থান করে এবং দক্ষিণ শাখাটি উত্তর ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা ভারতে মৌসুমি বায়ু প্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। গ্রীষ্মকালে উত্তরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে সংগতি রেখে বায়ুচাপ বলয়গুলি যেমন উত্তর দিকে সরে যায়, জেট বায়ুপ্রবাহের দুটি শাখাও হিমালয়ের উত্তরে সরে গিয়ে প্রায় 40° উত্তর অক্ষাংশ বরাবর অবস্থান করে। উপক্রান্তীয় জেট বায়ু সৃষ্টির কারণ হিসেবে উপক্রান্তীয় অঞ্চলে দ্রাঘিমারেখা বরাবর উত্তর-দক্ষিণে দ্রুত তাপ ও চাপের পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়।
3. রাত্রিকালীন মেরু জেট প্রবাহ (Polar night Jet stream):
মেরু অঞ্চলে 60° অক্ষাংশ বরাবর ট্রপোপজের ঠিক ওপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে পশ্চিম থেকে পূর্বে তীব্রগতি- সম্পন্ন একটি জেট বায়ু প্রবাহিত হয়।এই বায়ুপ্রবাহ শুধুমাত্র শীতকালে যখন মেরু অঞ্চলে রাত্রিকালীন অবস্থায় থাকে তখন প্রবাহিত হতে দেখা যায়, তাই একে রাত্রিকালীন মেরু জেট বায়ু বলে।
এর গড় উচ্চতা ভূপৃষ্ঠ থেকে 24-25 কিমি, কখনো কখনো 30 কিমি উর্ধ্বেও উঠে আসে। তখন এর গতিবেগ সর্বাধিক হয়। শীতকালে রাতের বেলায় মেরু অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠান্ডায় তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায়। এমনকি স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তরও সূর্যরশ্মির অভাবে খুব একটা উয় হতে পারে না। উপরন্তু নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে ওজোন স্তর সূর্যরশ্মি লাভ করতে থাকায় সৌরশক্তি শোষণ করে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে এরূপ বৈষম্যমূলক উত্তাপ প্রক্রিয়ায় তীক্ষ্ণ তাপীয় ঢালের সৃষ্টি হয় যা শক্তিশালী জেট বায়ুর সৃষ্টি করে। এই কারণে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বায়ুচাপের যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
এর ফলে সৃষ্ট বায়ুচাপের অবক্রমজনিত বল ও কোরিওলিস বলের মধ্যে সমতা বিধানের মাধ্যমে এই জেট বায়ুর সৃষ্টি হয়। এর গড় গতিবেগ ঘণ্টায় 50 কিমি। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে একমাত্র এই জেট বায়ুটি লক্ষ করা যায় বলে একে Stratospheric Jet stream নামেও অভিহিত করা হয়।
4. ক্রান্তীয় পুবালি জেট প্রবাহ (Tropical Easterly Jet stream):
গ্রীষ্মকালে ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ার দিয়ে চিন উপসাগর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমারের দক্ষিণ অংশের ওপর দিয়ে ভারত অতিক্রম করে আরব সাগর পর্যন্ত সাধারণ জেট বায়ুর বিপরীতে অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এক উচ্চগতিসম্পন্ন জেট বায়ু প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে পূর্ব দিক থেকে আসায় এই বায়ুকে ক্রান্তীয় পুবালি জেট বায়ু (Tropical Easterly Jet) বলে।
এটি প্রধানত 15°-20° উত্তর অক্ষরেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ গোলার্ধে এই বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। এমনকি উত্তর গোলার্ধে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশেও এরূপ বায়ুপ্রবাহের কোনো অস্তিত্ব নেই। গ্রীষ্মকালে উত্তর-দক্ষিণে দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুচাপ ঢালের অভিমুখের আমূল পরিবর্তনের কারণেই ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঊর্ধ্বাকাশে পুবালি জেট বায়ুর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় বলে অধিকাংশ আবহবিদরা মেনে নিলেও এই ধরনের পুবালি বায়ুপ্রবাহের উৎপত্তির যথাযথ কারণ এখনো সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি।
এই বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় 175 কিমি থেকে 200 কিমি পর্যন্ত হয়। শীতের শুরুতে উপক্রান্তীয় জেট বায়ুর দক্ষিণ শাখাটি হিমালয়ের দক্ষিণে আবির্ভাবের সাঙ্গে সঙ্গে এই পুবালি জেট বায়ুটির বিলুপ্তি ঘটে। অনেক আবহবিদের মতে, গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের সঙ্গে এই ক্রান্তীয় পুবালি জেট বায়ুর সম্পর্ক রয়েছে।
5. স্থানীয় জেট প্রবাহ (Local Jet Stream):
স্থানীয়ভাবে চাপ ও তাপের চরম বৈষম্যজনিত কারণে কোনো কোনো স্থানে কখনো কখনো নিম্ন উচ্চতায় জেট বায়ুপ্রবাহ লক্ষ করা যায়। এই বায়ুপ্রবাহগুলি সাধারণত গ্রীষ্মকালেই স্বল্প পরিসর স্থান জুড়ে বিস্তৃত হয়। যেহেতু এই সকল জেট প্রবাহ ভূপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় প্রবাহিত হয়, তাই একে নিম্ন উচ্চতার জেট প্রবাহ (Low level Jet stream) বলে।
আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সোমালি দ্বীপপুঞ্জের কাছে উৎপন্ন সোমালি জেট বায়ু (Somali Jet stream) একপ্রকার স্থানীয় জেট বায়ুর উদাহরণ। ব্রিটিশ আবহবিদ J. Find- aller এই সোমালি জেট বায়ুকে প্রথম চিহ্নিত করেন। এই জেট বায়ুটিকে ভূপৃষ্ঠ থেকে 1-2 কিমি উচ্চতায় আফ্রিকার মরিশাস থেকে কেনিয়া উপকূল বরাবর প্রবাহিত হতে দেখা যায়। উত্তর আমেরিকার বৃহৎ সমভূমি অঞ্চলে আরও একপ্রকার নিম্ন উচ্চতা বিশিষ্ট স্থানীয় জেট বায়ুপ্রবাহ দেখা যায়।