গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি (Rural Compact Settlement):
নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাসগৃহের একত্র সমাবেশ ঘটলে গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে ওঠে। পৃথিবীর বেশির প্রতি গঠনের ভাগ মানুষই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। বেশির ভাগ মানুষই প্রাথমিক অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। যোগাযোগ জীবিকা, তা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির উদ্ভব ঘটে।
গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি বিভিন্ন ধরনের হয় এবং বিভিন্ন কারণে এই জাতীয় বসতির উদ্ভব ঘটে।
(i) প্রাকৃতিক কারণ (Physical Factors):
নিম্নলিখিত প্রাকৃতিক কারণগুলির জন্য গ্রামীণ গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে ওঠে।
(a) অবস্থান (Location):
গ্রামীণ বসতির বিন্যাস অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। যেমন-পার্বত্য অঞ্চলে খাড়া ঢালযুক্ত পর্বতের উপত্যকায় গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে ওঠে। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে এধরনের বসতি গড়ে উঠেছে। আবার দ্বীপপুঞ্জে কিংবা পাহাড়ের শীর্ষদেশে বর্গাকার, গোলাকার গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে ওঠে। যেমন-ইটালির পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামীণ বসতি, উন্ন মরু অঞ্চলের মরূদ্যানের নিকট পানীয় জল ও কৃষিকাজের জন্য সেখানে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে।
(b) ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকা (Physiography and Soil):
ভূপ্রকৃতি যদি সমতল হয় এবং মৃত্তিকা খুব উর্বর হয় তাহলে সেইসব এলাকায় কৃষিকাজ খুবই ভালো হয়। এই কারণে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের পলিগঠিত উর্বর সমভূমিতে গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছে।
(c) ভৌম জলের অবস্থান (Availability of Groundwater):
ভূপৃষ্ঠের যেসব অঞ্চলে সহজে জল পাওয়া যায় না অর্থাৎ জলের অভাব আছে সেইসব স্থানের যেখানে জল পাওয়া যায় সেখানে প্রচুর বসতি গড়ে ওঠে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির উদ্ভব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ মরু অঞ্চলের ওয়েসিস বা মরূদ্যানের কথা বলা যায়।
(d) উচ্চভূমির অবস্থান (Location of Upland):
বন্যা কবলিত অঞ্চলের যেসব জায়গাতে সহজে বৃষ্টির জল পৌঁছাতে পারে না সেইসব শুষ্ক ও উচ্চভূমিতে দলে দলে মানুষ বসতি স্থাপন করে। গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদীর প্লাবন সমভূমিতে এই জাতীয় বসতি গড়ে উঠেছে।
(ii) সামাজিক কারণ (Social Factors):
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ- সুবিধা পাওয়ার জন্য মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। ফলে কাছাকাছি বসবাসের মাধ্যমে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির উদ্ভব ঘটেছে। আত্মরক্ষা, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক নীতিনীতি প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভর করে এ ধরনের বসতির উদ্ভব ঘটেছে। এমনকি আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়াগায় ধোপা, নাপিত, কুমোর, পুরোহিত, গোয়ালা-এদের নিকট থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির সৃষ্টি করেছে। এভাবেই আমরা দেখি বামুন পাড়া, কুমোর পাড়া, নাপিত পাড়া প্রভৃতির সামাজিক অবস্থান।
(iii) অর্থনৈতিক কারণ (Economic Factors) :
a) কৃষিসংগঠন ও ভূমির ব্যবহার (Agricultural Pattern and Land use):
গোষ্ঠীবদ্ধ ( জনবসতি গঠনের অন্যতম প্রধান কারণ হল অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা। কৃষি যেহেতু গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা, তাই কৃষিকাজের পদ্ধতি, ভূমির ব্যবহারের ধরন ওই অঞ্চলের জনবসতির বিন্যাস, প্রাকৃতি নির্ধারণ করে। মধ্যযুগে ইউরোপের গ্রামগুলিতে প্রায় সবাই কৃষিজীবী ছিল। ফলে ওইসব সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামের মধ্যভাগে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করত। আর গ্রামের চারপাশে থাকত কৃষিজমি। আবার কৃষক যখন নিজের জমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করল এবং কৃষিক্ষেত্রের নিকট বসবাস করতে শুরু করল তখন বিক্ষিপ্ত বসতির উদ্ভব হল। বাগিচা কৃষি অধ্যুষিত অঞ্চলের বসতি গোষ্ঠীবদ্ধ ধরনের হয়। কারণ বাগিচা কৃষিতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, তারা বাগিচা অঞ্চলেই বসবাস করে। যাযাবর পশুপালক উপজাতিরা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন করে। আবার তারা অন্য জায়গায় চলে গেলেও সেখানে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে তারা থাকে।
(b) কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তন (Change of Agricultural Land):
কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তন কিংবা কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তনের ফলেও জনবসতির গঠন কাঠামো পরিবর্তিত হয়। অনেক বড়ো গ্রাম ছোটো গ্রামে পরিবর্তিত হয়। অনেকেক্ষেত্রে পরিব্রাজনের (Migration) জন্য কোনো অঞ্চলে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতির উদ্ভব ঘটে। কোনো স্থান থেকে অন্য এক স্থানে প্রচুর সংখ্যক লোক এসে বসবাস করলেও এধরনের জনবিন্যাস গড়ে ওঠে।
(iv) ধর্মীয় কারণ (Religious Factors):
অনেকক্ষেত্রে কোনো কোনো অঞ্চলে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ, রীতিনীতির প্রভাবে জনবসতি গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পড়ে। গ্রামে কোনো বড়ো মন্দির, মসজিদ কিংবা জন্য কোনো উপাসনার স্থানকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে ওঠে। সাধারণত একই ধর্মের বা সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস থেকে এই গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতির উৎপত্তি ঘটে।
এসব কারণগুলি ছাড়াও যেসব গ্রামগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত সেখানেও গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি দেখা যায়।