জনবসতি গড়ে ওঠার কারণসমূহ [ Reasons for settlement development ]
সংজ্ঞা:
কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকায় পরিবেশের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে কিছু নির্দিষ্ট সুযোগসুবিধার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মানুষের স্থায়ী বা অস্থায়ী আবাসস্থলকে জনবসতি (Settlement) বলে। ডিকেন ও পিটস্-এর মতে, 'বসতি হল ক্ষুদ্র গ্রাম, গ্রাম, শহর ও নগরের মধ্যে গড়ে ওঠা মানুষ ও তাদের আশ্রয়স্থলের সমষ্টি' (Settlement refers to the grouping of people and houses into hamlets, villages, towns and cities)।
কোনো অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠার জন্য প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণসমূহ দায়ী।
প্রাকৃতিক কারণসমূহ:
কোনো অঞ্চলে বসতি গড়ে ওঠার জন্য ঐ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, মাটি প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানগুলি প্রভাব বিস্তার করে।
• ভূপ্রকৃতি:
ভূপ্রকৃতির তারতম্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের জনবসতি পরিলক্ষিত হয়। ভূমির ঢাল, উচ্চতা প্রভৃতি জনবসতি গড়ে উঠতে প্রভাব বিস্তার করে। পার্বত্য অঞ্চলে ঢালের কারণে উপযুক্ত স্থানের অভাবে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবার, নদীগঠিত সমতল অঞ্চলে অধিক সুযোগসুবিধা থাকার কারণে গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছে।
দৃষ্টান্ত:
ভারতের উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির ঢালের জন্য বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে। আবার ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমতল ভূপ্রকৃতি গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
• জলবায়ু:
কোনো স্থানের জলবায়ু জনবসতি গড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। উয়তা ও বৃষ্টিপাত - জলবায়ুর এই দুটি উপাদান জনবসতি বিস্তারে অনেকাংশে দায়ী।
দৃষ্টান্ত:
অত্যধিক উন্নতা অথবা প্রচণ্ড শীতলতার কারণে মরু অঞ্চলে বা হিমমণ্ডলের উত্তরভাগে জনবসতি খুব কম। নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে অধিক উন্নতা ও বৃষ্টিপাতের জন্য কম জনবসতি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে উপক্রান্তীয় ও নাতিশীতোয় জলবায়ু অঞ্চলে মাঝারি উয়তা ও বৃষ্টিপাতের জন্য সর্বাধিক জনবসতির বিস্তার ঘটেছে।
• মৃত্তিকা:
মৃত্তিকার গঠন ও উর্বরতা জনবসতি বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পলি ও রেগুর মৃত্তিকা সমৃদ্ধ অঞ্চলে চাষাবাদের সুযোগসুবিধার জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ল্যাটেরাইট মৃত্তিকাযুক্ত অঞ্চলে চাষাবাদের সুবিধা কম থাকায় বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে।
দৃষ্টান্ত:
ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল পলিসমৃদ্ধ হওয়ায় ভারতের এই অঞ্চলে অধিক জনবসতি গড়ে উঠেছে।
• জল:
পর্যাপ্ত জলের জোগানযুক্ত অঞ্চলে অধিক জনবসতি গড়ে উঠেছে। কারণ, পানীয় জলের চাহিদার পাশাপাশি অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় কাজেও পর্যাপ্ত জলের প্রয়োজন। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে সাধারণত রৈখিক বা দণ্ডাকৃতি জনবসতি গড়ে ওঠে। আবার মরু অঞ্চলে মরু
হ্রদকে কেন্দ্র করে মরূদ্যান এবং মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে ওঠে।
দৃষ্টান্ত:
পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী-হুগলি নদী তীরবর্তী অঞ্চলে রৈখিক জনবসতি গড়ে উঠেছে। মরু অঞ্চলে সাহারা, থর প্রভৃতি মরুভূমিতে মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে।
• সূর্যের অবস্থান:
কোনো অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠার পিছনে অনেকসময় সূর্যের অবস্থান এবং সূর্যরশ্মির পতনকোণের ওপর নির্ভর করে।
দৃষ্টান্ত:
অধিক শৈত্যের জন্য ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ দেশগুলিতে বাড়িগুলি সূর্যালোকমুখী হয়। ভারতের নৈনিতালে সূর্যালোকের চাহিদার জন্য অধিকাংশ বাড়ি দক্ষিণমুখী ঢাল বরাবর গড়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক কারণ
বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওপর নির্ভর করে কোনো অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রাথমিক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপযুক্ত (যেমন- বনজ সম্পদ সংগ্রহ, খনিজ দ্রব্য উত্তোলন, মৎস্য সংগ্রহ প্রভৃতি) অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলগুলি ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে উন্নত না হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় এখানে গোষ্ঠীবন্ধ বা বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে উঠেছে।
দৃষ্টান্ত:
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে খনিজ তেল উত্তোলনকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে উঠেছে। নাতিশীতোয় অঞ্চলে সরলবর্গীয় বনভূমির কাষ্ঠ সংগ্রহকে ঘিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছে।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণ:
অনেক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণকে কেন্দ্র করে কোনো অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে। কোনো অঞ্চলে জনবসতি কম থাকলেও শিক্ষাকেন্দ্র বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠায় জনবসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার অনেক সময় কোনো ধর্মীয় স্থানকে কেন্দ্র করেও জনবসতি গড়ে ওঠে।
দৃষ্টান্ত:
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ফলে ওই অঞ্চলে জনবসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার মায়াপুরে ইস্কন মন্দিরকে কেন্দ্র করে বৈয়ব ধর্মাবলম্বী মানুষেরা বসতি স্থাপন করেছে।
রাজনৈতিক কারণ:
রাজনৈতিক স্থিরতা কোনো স্থানে জনবসতি গড়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যে স্থানে বা অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিরতা অধিক, সেইসব অঞ্চলে নিরাপত্তা বেশি হওয়ায় জনবসতি গড়ে ওঠে।
দৃষ্টান্ত:
অসমের গুয়াহাটি থেকে দিসপুরে রাজধানী স্থানান্তরের কারণে ঐ অঞ্চলে অধিক জনবসতি গড়ে উঠেছে।
জৈবিক কারণ:
প্রধানত উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব প্রভৃতি জৈবিক কারণের অন্তর্ভুক্ত। ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ প্রভৃতি নিয়ে সৃষ্ট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বায়োম বা ভৌগোলিক বা জলবায়ু অঞ্চল গড়ে ওঠে। নিদৃষ্টান্ত: বিশ্বের বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে নাতিশীতোয় ও মৌসুমি অঞ্চলে সর্বাধিক বসতি পরিলক্ষিত হয়।