তেহরি বাঁধ আন্দোলন [Tehri Dam Movement]
ভারতের পরিবেশীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক অতি সক্রিয় পদক্ষেপ হল তেহরি বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংগঠিত পরিবেশবাদী আন্দোলন। তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রয়েছে প্রধানত তেহরি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুসারে তেহরি বাঁধ হল ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বোচ্চ নুড়ি ভরাট বাঁধ। তাছাড়াও এই বাঁধটি পৃথিবীর সুদীর্ঘ বাঁধগুলির মধ্যে অন্যতম। তেহরি বাঁধটির ভৌগোলিক অবস্থান 30°22 40" উত্তর ও 78°2850" পূর্ব।
ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চল রাজ্যের তেহরি জেলায় গঙ্গার দুটি প্রধান উপনদী ভাগীরথী ও ভিলগঙ্গার সঙ্গমস্থলের পাদদেশে ভাগীরথী নদীর ওপর তেহরি বাঁধ নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল। মধ্য হিমালয়ের এই অঞ্চলটি ভূতাত্ত্বিক মতে ব্যাপক ভঙ্গুর প্রকৃতির। এই বাঁধটি নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে তৎকালীন স্থানীয় পরিবেশ সচেতন মানুষজন এক সুসংগঠিত পরিবেশ আন্দোলন সৃষ্টি করে, এই আন্দোলনই তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দালন নামে সুপরিচিত। 1970-এর দশকে সরকার তেহরিতে বাঁধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সাপেক্ষে 1961 সালে তেহরি বাঁধ প্রকল্পের প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ সমাপ্ত হয়।
এর পরবর্তী সময়ে 1972 সালে তেহরি বাঁধ প্রকল্পটির নকশা পূর্ণরূপে অনুমোদিত হয়। পরিকল্পনা অনুসারে বলা যেতে পারে যে বাঁধটি প্রায় 260.5 মিটার উঁচু। ভারত সরকারের প্ল্যানিং কমিশন থেকে 1972 সালে তেহরি বাঁধ প্রকল্পটি অনুমতি ও ছাড়াপত্র পায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে 1978 সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের জলসেচ বিভাগ তেহরি বাঁধ প্রকল্পটির কার্য প্রাথমিকভাবে আরম্ভ করে। পরিকল্পনা অনুসারে তেহরি বাঁধের জলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হবে এক বড়োসড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং সংলগ্ন এলাকায় সেচের জল সরবরাহ করা হবে; এমনকি দিল্লিতেও জল সরবরাহ করা হবে।
এই বাঁধ নির্মাণের আরো এক লক্ষ্য ছিল। সেই বাঁধ নির্মাণ করার পর সেখানে নানান শিল্প ও কারখানা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই ধরনের বাঁধ নির্মাণের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোথাও জলাভাব দেখা দেবে, আবার কোথাও জল প্লাবন দেখা দেবে। এছাড়াও বাঁধ নির্মাণ করার পরে সেই স্থানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করলে সেই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য ধোঁয়া, আবর্জনা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে। এর পরে এই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে ঘিরে হরেক রকম সহায়ক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে সেই কারখানার বর্জ্য পদার্থ, ধোঁয়া, গ্যাস, দুর্গন্ধ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট পরিবেশকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে।
এছাড়াও হিমালয়ের মতো পাহাড়ের বুকে তেহরির মতো বড়ো বাঁধ তৈরি করলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের মাটির ওপর যে চাপ প্রদত্ত হবে তাতে যে কোনো মুহূর্তে বৃহৎমাত্রিক ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এই সকল মারাত্মক পরিবেশ সংকটের কথা মাথায় রেখে স্থানীয় পরিবেশবিদ ও পরিবেশ সচেতন মানুষজন একত্রে 'তেহরি বাঁধ বিরোধী সংঘর্ষ সমিতি' গঠন করে। এই সমিতির নেতৃত্বেই উক্ত জনেরা হিমালয়ের এই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তেহরি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে এক তীব্র পরিবেশবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন, এই আন্দোলনই তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত। তেহরি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ও কার্য সরকার হাতে তুলে নেওয়ার পর থেকেই এই আন্দোলন জন্মলাভ করে। এই আন্দোলনের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে ছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা।
তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন বেশ কয়েক দশক ধরে অব্যাহত রয়েছে। এই আন্দোলনটি তেহরি বাঁধ বিরোধী সংঘর্ষ সমিতির পরিবেশ সংরক্ষণমূলক ঐকান্তিক মানসিকতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। পরিবেশবিদগণ তেহরি বাঁধ নির্মাণের বিকল্প হিসাবে গঙ্গার গতিপথে কতকগুলি ছোটো বাঁধ নির্মাণ করার কথা বলেছেন। তাঁরা এও বলেছেন যে, এই বাঁধগুলি ভূমিকম্প সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে, সার্বিকভাবে পরিবেশের ক্ষতি যথেষ্ট মাত্রায় কম হবে এবং সুরক্ষাগত দিক থেকে এই বাঁধগুলি যথেষ্ট নিরাপদ হবে। তবে শেষরক্ষা হয়নি।
আন্দালনের চরম মুহূর্তে পৌঁছেও তেহরি বাঁধ নির্মাণের কাজ আন্দোলনকারীরা আটকাতে পারেনি। তবুও তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন সমগ্র ভারতবর্ষের বুকে গুরুত্ব ও কৃতিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে অতি অসামান্যতার দাবি রাখে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে বলা যেতে পারে যে, তেহরি বাঁধ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভারতের পরিবেশীয় আন্দোলন ও চেতনা ব্যাপক বলিষ্ঠ রূপ ধারণ করে।