নিস্তব্ধ উপত্যকা আন্দোলন [Silent Valley Movement ]
নিস্তব্ধ উপত্যকা আন্দোলন হল ভারতের বুকে সৃষ্টি হওয়া অন্যতম প্রধান ব্যাপক ও সংগঠিত পরিবেশীয় আন্দোলন। এই আন্দোলনটি নিস্তব্ধ উপত্যকাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল বলে এর এরূপ নামকরণ। এই নিস্তব্ধ উপত্যকাটি ভারতবর্ষের কেরালা রাজ্যের পালঘাট জেলায় অবস্থিত। কেরালা রাজ্যের পালঘাট পাহাড়ি অঞ্চলে কুন্তি নদীর উপত্যকা অংশে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃষ্টি অরণ্য পরিবেশ অতি নির্জন, নিস্তব্ধ ও শান্ত হওয়ায় এই অঞ্চলকে নিস্তব্ধ উপত্যকা বা সাইলেন্ট ভ্যালি বলা হয়।
এই অঞ্চলের আয়তন প্রায় 8592 হেক্টর। ভারতের এই নিস্তব্ধ উপত্যকার মধ্যে রয়েছে প্রায় 1100 উদ্ভিদ প্রজাতি এবং অসংখ্য অতিবিরল, বিপদসংকুল, লুপ্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি। নিস্তব্ধ উপত্যকা অঞ্চলের প্রধান নদী হল কুস্তি নদী। 1970-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই কুত্তি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে কেরালা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ প্রায় ৪০০ হেক্টর বনভূমি নষ্ট করে জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের এক বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে এই অরণ্যের বহু অংশের জলমগ্ন হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা লক্ষ করা যায়।
1973 সালে উক্ত অঞ্চলের মানুষের সহযোগিতায় নানান বেসরকারি সংস্থা একত্রিত হয়ে উক্ত পরিকল্পনা রোধে এবং নিস্তত্ত্ব উপত্যকাকে রক্ষার সাপেক্ষে মহা আন্দোলন শুরু করে, এই আন্দোলনই নিস্তব্ধ উপত্যকা আন্দোলন নামে সুপরিচিত। এই আন্দোলন কেবল মাত্র কেরালা রাজ্যের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিল না বরং এই আন্দোলনের ঢেউ সমগ্র ভারত তথা আন্তর্জাতিক স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। নিজস্ব উপত্যকা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় কবি সুগথাকুমারী, ড. সেলিম আলি, ড. এম. এস. স্বামীনাথন, কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ ও বহু বেসরকারি সংস্থা। নিস্তব্ধ উপত্যকার সুরক্ষার জন্য প্রথম গণআন্দোলন শুরু করে কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ। নিস্তব্ধ উপত্যকা আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের প্রধান বিষয় ছিল- 'Save the Silent Valley ।
1977 সালে বনদপ্তরের গবেষকগণ এই উপত্যকার বাস্তুতান্ত্রিক প্রভাব মূল্যায়ন করে সরকারকে জানান যে নিস্তব্ধ উপত্যকাকে 'বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ' হিসাবে ঘোষণা করা উচিত। 1978 সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিকে ছাড়পত্র দেন এবং ওই একই বছরে IUCN-এর আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে উক্ত প্রকল্পটি বন্ধ করার জন্য সুপারিশ পাঠান। 1979 সালে কেরালা সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে যে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অঞ্চল ছাড়া অবশিষ্ট অঞ্চলটিকে 'জাতীয় উদ্যান' হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। 1980 সালের ডিসেম্বর মাসে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অঞ্চল ছাড়া বাকী অঞ্চলটিকে কেরালা সরকার 'জাতীয় উদ্যান' হিসাবে ঘোষণা করে। 1983 সালের প্রথমার্ধে সরকারের কাছে মেনন কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিখুঁতভাবে এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে 1985 সালের 7 ডিসেম্বর নিস্তব্ধ উপত্যকাকে 'জাতীয় উদ্যান' হিসাবে ঘোষণা করেন। 2001 সালে উক্ত প্রকল্প এলাকার 500 মিটারের বাইরে অপর একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। এই সময় কেরালা বিদ্যুৎ পর্যদ এই অঞ্চলে পাথড়াকাড়াভূ বাঁধকে বিকল্প পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পনা হিসাবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার প্রত্যুত্তরে পরিবেশপ্রেমীরা বলেন, যদি নিলিকাল ও পাথড়াকাড়াভু অঞ্চলে এই প্রকল্প তৈরি হয়, তাহলে নিস্তব্ধ উপত্যকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সুদৃশ্য জলপ্রপাত ধারা বিলীন হয়ে যাবে।
নিস্তব্ধ উপত্যকা আন্দোলনের ফলে আন্দোলন সৃষ্টিময় অঞ্চলের প্রায় 1000 হেক্টর যখন বনভূমি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়, অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য সুরক্ষিত থাকে। পরিবশে ও বায়ুমণ্ডলীয় স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকে এবং তৎসহ স্থানীয় অরণ্য নির্ভর জীবনপ্রণালী অব্যাহত ও সুরক্ষিত থাকে। বর্তমানে কেরালা রাজ্য সরকার নিস্তব্ধ উপত্যকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকেও জাতীয় উদ্যানের আওতায় আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।