পরিবেশ ভূগোলের ধারণা [Concept of Environmental Geography]
ভূগোল শাস্ত্রের আলোচনা ক্ষেত্রে বর্তমানে অধিক আলোচিত ও বিশ্লেষণাত্মক ক্ষেত্র হল পরিবেশ ভূগোল। ভূগোল শাস্ত্রে যে শাখায় আমাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যথার্থ নিবিড় বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হয়, সেই শাখাটিকে পরিবেশ ভূগোল বলা হয়। পরিবেশ ভূগোলের ইংরাজি প্রতিশব্দ হল Environmental Geography।
ভূগোলের যে শাখার মূল কেন্দ্রেই পরিবেশ তাকেই পরিবেশ ভূগোল বলা হয়। মূলত পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়াবলির সংজ্ঞা, অর্থ, ভিত্তি, কার্যাবলি, গঠন, উপাদান, আন্তঃসম্পর্ক, বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, প্রয়োজনীয়তা, প্রভাব, প্রভৃতি নানান বিষয়াবলি সম্পর্কে ভূগোলের যে শাখায় দীর্ঘায়িত ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা হয়, সেই শাখাটিকেই পরিবেশ ভূগোল বলে অভিহিত করা হয়। পরিবেশ ভূগোলে একাধারে যেমন পরিবেশের অতীত অবস্থা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়, ঠিক তেমনই, পরিবেশের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েও দীর্ঘ বিশ্লেষণভিত্তিক আলোচনা করা হয়।
বর্তমানে ভূগোলের এই আলোচ্য শাখায় সাধারণত পরিবেশ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের অবনমন, ক্ষতি, পরিবেশ পরিকল্পনা ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গভীর ও নিবিড় দীর্ঘায়িত আলোচনা করা হয়। এক কথায় তাই বলতে গেলে, পরিবেশ ভূগোল হল এমন এক ভূগোলক্ষেত্রীয় শাখা যা সার্বিকভাবে নিবিড় ও বিস্তৃত পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা করে।
সাধারণভাবে পরিবেশ বা পরিবেশ ভূগোল কথাটি মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে নির্দেশ করে। বিজ্ঞানী সি. সি. পার্ক (C. C. Park)-এর মতে, পরিবেশ ভূগোল হল একটি সুনির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সামগ্রিক রূপ। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে গঠিত হয়েছিল পরিবেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলি এর অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। পরিবেশবিজ্ঞানী কে. আর. দীক্ষিত (K. R. Dixshit)-এর মতে, পরিবেশ ভূগোল নির্ধারিত হয় মানুষের চাহিদা ও সমাজ অনুসারে। মানুষ তার বাসস্থানের জন্য স্থান, শ্বাসগ্রহণের জন্য দূষণহীন বাতাস, প্রাণরক্ষার জন্য জল ও খাদ্যকে পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করেছে আবার তার অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য পরিবেশ থেকে সম্পদ উৎপাদন করছে কিংবা পরিবেশকে যথেষ্ট ব্যবহার করছে। পরিবেশের ওপর মানুষের বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম পরিবেশ ভূগোলের ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে।
কিন্তু, এই সাধারণ ধারণা ছাড়াও পরিবেশ ভূগোলের বেশকিছু মৌলিক ধারণা বর্তমান। অধ্যাপক Savindra Singh 2008 সালে তাঁর Environmental Geography বইটিতে পরিবেশ ভূগোলের বেশ কয়েকটি মৌলিক ধারণার সূত্র প্রয়োগ করেছেন। আমরা সবাই জানি, যে পরিবেশ ভূগোল হল মূলত জীবে প্রাচুর্যে ভরা পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশের অধ্যয়ন। মূলত পরিবেশ ভুগোলের পাঠের ক্ষেত্রে মৌলিক একক হল – বায়ুমণ্ডল বা আবহমণ্ডল, জলমণ্ডল বা বারিমণ্ডল এবং শিলামণ্ডল বা অশ্মমণ্ডল। সামগ্রিক পরিবেশ ভূগোলের পরিসরে নানান ঘটনাবলি ও নানান কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বর্ধিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবেশ ভূগোলের পরিসরে থাকা এই ঘটনাবলি ও কার্যবলিগুলি বিশেষভাবে কয়েকটি মৌলিক ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবেশ ভূগোলের আলোচনায় মৌলিক ধারণার ব্যাখ্যা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিশেষভাবে মৌলিক ধারণার ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে যে পরিবেশ ভূগোলের মতো ভূগোলের শাখাটির বিষয়ে পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য অতি মৌলিক বাস্তুতান্ত্রিক একক হল পরিবেশতন্ত্র। পৃথিবীর সামগ্রিক জীবমণ্ডল বেশ কিছু বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা ক্রমপর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশতন্ত্রের সকল জৈব ও অজৈব উপাদানগুলির মধ্যে এক গভীর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত সমস্থিতিক প্রবণতাযুক্ত ক্রিয়াবিধির দ্বারা বিশেষভাবে পরিবেশতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
পৃথিবীর সকল বাস্তুতন্ত্রের সুস্থির অবস্থাকে পরিবেশতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও জটিলতা আরো তাঁর করে বজায় রাখে। পৃথিবীর জীবমণ্ডলে একই ধরনের জীব প্রজাতির মধ্যে স্থানগত ও কালগত বিশেষ পার্থক্য বর্তমান। বিশেষভাবে বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশের সাথে মানুষের ঘাত প্রতিঘাতে, প্রকৃতি বিশ্ব পরিবেশের স্থায়িত্ব বা অস্থায়িত্বতাকে বিশেষ আঙ্গিকে নির্ণয় করে।
পরিবেশীয় ভূগোলের ধারণা এই ব্যাপাক প্রকৃতির, যার উপলব্ধি উপরিউক্ত আলোচনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। বর্তমানে আরো নানান নব নব উপলব্ধি পরিবেশ ভূগোলের ধারণার পরিসরে সংযুক্ত হচ্ছে। আশা রাখি, অদুর ভবিষ্যতে বহু উপালব্ধি পরিবেশ ভূগোলের পরিসরে সংযুক্ত হয়ে ধারণার ব্যাপ্তি ঘটাবে।