চিপকো আন্দোলন [Chipko Movement]
ভারত সহ পৃথিবীজুড়ে যে কটি পরিবেশীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম প্রধান আন্দোলন হল চিপকো আন্দোলন। এই আন্দোলনের নামকরণের বিষয়ে বলতে গেলে বলা যেতে পারে যে, “চিপকো' শব্দটি গাড়োয়ালি শব্দ "Angalwaltha' থেকে এসেছে। 'চিপকো' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল 'আলিঙ্গন করে রাখা' বা 'জড়িয়ে ধরা'। ঠিকাদাররা গাছ কাটতে এলে অঞ্চলের সকলে মিলে প্রত্যেকটি গাছকে আলিঙ্গন করে রেখে গাছ কাটা প্রতিরোধ করেন বলেই এই আন্দোলনকে চিপকো আন্দোলন বলা হয়। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের গাড়োয়াল জেলার মন্ডল গ্রামে 1973 সালের এপ্রিল মাসে অবাধ অরণ্য ধ্বংস প্রতিরোধ করতে চিপকো আন্দোলন শুরু হয়।
তবে চিপকো আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ভারতের পার্বত্য জেলা চামোলির এক প্রত্যন্ত শহর গোপেশ্বরে 1973 সালের মার্চ মাসে। এই আন্দোলনটি ভয়ংকর আকার নিয়েছিল 1974 সালের মার্চ মাসে। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের চামোলি জেলার রেনিগ্রামে ঠিকাদাররা গাছ কাটতে এলে গ্রামের অধিবাসী ও বিশেষত নারীরা সমস্ত গাছকে আলিঙ্গন করে রেখে গাছ কাটা প্রতিরোধ করেন। চিপকো আন্দোলনী পথে প্রথম বড়ো প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছিল যখন সাইমন কোম্পানি বনদপ্তর থেকে তিন কোটি গাছ কাটার অনুমতিপত্র পায়। চিপকো আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আন্দোলনকারী ছিলেন আলোচ্য গ্রামগুলির মহিলারা।
চিপকো আন্দোলানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন গৌরীদেবী, সুদেশাদেবী, বাচ্নিদেবী, চন্ডীপ্রসাদ ভাট, সুন্দরলাল বহুগুনা, গোবিন্দ সিং রাওয়াত, ঘনশ্যাম রাতুরি, ধূম সিং নেগি প্রমুখ। এই আন্দোলনের বেশ কয়েক বছর পরে অসংখ্য গবেষক ও বিজ্ঞানী আন্দোলন সংঘটিত অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তার ওপর মানুষের প্রভাব নিয়ে গবেষণা। করতে থাকেন। 1980-র দশকে এই আন্দোলন সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। 1981 থেকে 1983 সালের মধ্যে ট্রান্স হিমালয় অঞ্চলে 5000 কিমি পথ পায়ে হেঁটে চিপকো আন্দোলনের বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেন সুন্দরলাল বহুগুনা। এই আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে বজন সম্পদ সংরক্ষণে এক অতি উৎসাহ ও অতি উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটায়। পরিবেশপ্রেমী থেকে পরিবেশবিদরা চিপকো আন্দোলনকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতি হিসাবে চিহ্নিত করেন।
সাধারণ মানুষ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই আন্দোলনের পথকে অনুসরণ করেছিল মূলত বাস্তুতান্ত্রিক সচেতনতা ও বৃহৎ আকারে বনচ্ছেদন রুখতে। চিপকো আন্দোলন বহু মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা ও সহানুভূতি অর্জন করেছিল দেশ এবং বিদেশ থেকে। 1987 সালে এই আন্দোলনকে 'The Right Livelihood Award সম্মানে ভূষিত করা হয়।
চিপকো আন্দোলনের ফলে ভারতের সর্বত্র অরণ্যহনন ও বেআইনিভাবে গাছ কাটার উপর নিয়ন্ত্রণ জারি, ভূমিক্ষয়ের ও অরণ্যধ্বংসের প্রবণতা হ্রাস এবং সর্বোপরি মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। এই আন্দোলন সমকালীন সামাজিক বাস্তুতান্ত্রিক আন্দোলনের এক বিশিষ্ট মানদণ্ড বা বেশুমার্ক। এই আন্দোলনের প্রভাব জঙ্গল আচ্ছাদিত হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও বিহারে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। চিপকো আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী সময়ে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে এপিকো আন্দোলন জন্মলাভ করে।