যুক্তিসংগত নির্বাচনের তত্ত্ব (Theory of Rational Choice )
অর্থনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মনস্তত্ত্ব, মানুষের আর্থ-সামাজিক আচরণ (behaviour) প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ধ্রুপদি (classical), নব্য ধ্রুপদি (neo-classical), আধুনিক ও কল্যাণমুখী (welfare) অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ব্যাপ্ত পরিসরে নির্বাচনকে ভিত্তি করে নানা মতামত ও তত্ত্ব আছে, যেমন উপভোক্তার নির্বাচন তত্ত্ব (Theory of Consumer Choice); অমর্ত্য সেন, ফিসবার্ন, অ্যারো প্রমুখের সামাজিক নির্বাচন তত্ত্ব (Social Choice Theory) ইত্যাদি।
বর্তমান আলোচনায় সাধারণ মানুষ কীভাবে তার নিজস্ব যুক্তিসংগত পথে নির্বাচন করে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে যুক্তিসংগত নির্বাচন তত্ত্ব সম্পর্কে (Rational Choice Theory) আলোচনা করা হল। এই তত্ত্বটি উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভস (William Stanly levons), গ্যারি বেকার (Gary Becker), ড্যানিয়েল খানম্যান (Daniel Kahneman). লায়নেল রবিনস (Lionel Robbins), বায়রন মিলার (Byron Miller), ডোনাল্ড গ্রিন (Donald P Green) প্রমুখের আলোচনা-সমালোচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।
নির্বাচন (Choice)
বিভিন্ন বিকল্পের (substitutes) মধ্য থেকে মনোমত কোনো বস্তু বা দ্রব্য বা পরিসেবাকে পছন্দ করে তাদের নিজের কাজে লাগান অর্থাৎ নিজের অধিকারে আনা হল “নির্বাচন” বা “চয়েস" (choice)।
সাধারণ মানুষের নির্বাচন (Common man's choice) :
নির্বাচন করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, জন্মগত ধর্ম! সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্বাচন করে চলেছে। উদ্দেশ্য হল বস্তু বা দ্রব্য বা পরিসেবা থেকে সর্বোচ্চ উপযোগ (utility) গ্রহণ করা ও ভোগ করা। যেমন – অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা মাছের চেয়ে সাধারণত ডিম বেশি পছন্দ করে। নিত্যযাত্রীরা ভিড়েঠাসা বাস বা ট্রেনের তুলনায় ফাঁকা বাস বা ট্রেন বেশি পছন্দ করে। এখানে মাছ ও ডিমের মধ্যে তুলনামূলক স্বাদের মধ্যে নির্বাচন অথবা ভিড় বাস বা ট্রেনের কামরা ও বাস বা ট্রেনের ফাঁকা কামরার মধ্যে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের নির্বাচন লুকিয়ে রয়েছে।
পেশাগত বা বিষয়গত নির্বাচন (Professional choice) :
বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ মানুষ, বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত মানুষ, তাদের বিষয় ও পেশা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন (choice)-এর ব্যাখ্যা করেন। যেমন – একজন সেফোলজিস্ট (Psephologist) ভোটদানের হার বিশ্লেষণ করে নির্বাচনে (election) ভোটদাতারা কাকে বিধানসভা বা লোকসভায় নির্বাচিত করবেন, তার ব্যাখ্যা দেন। একজন নৃতাত্ত্বিক আদিম মানুষের খাদ্য, হাতিয়ার, শিকার নির্বাচনের ধরন অনুসন্ধান করেন। একজন চাষি বছরের কোন সময়ে কোন জমিতে কোন ফসলের চাষ করলে লাভের সম্ভাবনা বেশি – সে বিষয়ে নির্বাচনে দক্ষ হন।
“নির্বাচন”-এর নিয়ন্ত্রকসমূহ বা “নির্বাচন"-এর ভিত্তি (Controls or Basis of choice)
(1) দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন :
অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ভূগোলে মনে করা হয় যে-কোনো দ্রব্য বা সম্পদ বা কোনো পরিসেবা দুষ্প্রাপ্য (scarcity) হলে মানুষ অর্থাৎ উপভোক্তা (consumer) ওই দ্রব্য বা সামগ্রীর বিকল্পগুলির মধ্যে নির্বাচন করে। যেমন বাজারে বড়োমাপের ওজনদার ইলিশ দুষ্প্রাপ্য ও দামি হলে বহু ক্রেতা সাধ্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত ছোটো ইলিশ মাছ কেনে (নির্বাচন করে)।
(2) শিল্পের লাভজনক ও সবচেয়ে কম খরচের অবস্থানের জন্য নির্বাচন :
শিল্পের অবস্থানের ক্ষেত্রে সংগঠক তার শিল্পকে কাঁচামালের কাছে, না বাজারের কাছে, না কাঁচামালের উৎস ও বাজারের মাঝামাঝি কোনো অনুকূল স্থানে গড়ে তুলবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তটি ওই তিন বিকল্প অবস্থানের মধ্য থেকে নির্বাচন করে।
(3) উৎপাদকের “সুযোগ ব্যয়" (Opportunity Cost) এর ভিত্তিতে নির্বাচন:
উৎপাদক (producer) কোনো দ্রব্য উৎপাদন করা বা কোনো পরিসেবা দেওয়ার আগে তিনটি মূল প্রশ্নের ভিত্তিতে নির্বাচন করে। এই তিনটি প্রশ্ন হল -
ii) কী (অর্থাৎ কোন্ পণ্য) উৎপাদন করা হবে, (ii) পণ্য ও পরিসেবা কীভাবে উৎপাদন করা হবে, এবং (iii) পণ্য ও পরিসেবা কাদের জন্য (অর্থাৎ কী ধরনের উপভোক্তার জন্য) তৈরি করা হবে। আলোচ্য তিনটি প্রশ্নের ভিত্তিতে উৎপাদক যা খুঁজে দেখে তা হল প্রতিটি ক্ষেত্রে “সুযোগ ব্যয়” বা ঊর্ধ্বতম বিকল্প বা ক্ষতি কত।
(4) ক্রেতা বা উপভোক্তার তৃপ্তির (satisfaction) উদ্দেশ্যে নির্বাচন:
ক্রেতা বা উপভোক্তার (consumer) "নির্বাচন” তার নিজের পছন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য, বিবেচনা (self interest) ও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ক্রেতা বা উপভোক্তা হল “ইকনমিক ম্যান” বা “হোমো ইকনমিকাস” (Homo economicus)।
(5) উৎপাদক ও উপভোক্তার বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন :
উৎপাদক ও উপভোক্তা ব্যক্তিগত স্তরে বর্তমান অবস্থাকে সুচক ধরে নিয়ে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অর্থাৎ নির্বাচন করে (choices are made at the margin) | যেমন – স্থায়ী আমানতের ওপর ব্যাংক সুদের হার বারবার কমালে বিনিয়োগকারীরা ধরে নেয় যে আগামী দিনেও ব্যাংক সুদের হার কমাবে। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় যে ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে টাকা রাখা বা মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখার মধ্যে কোনটিতে তার লাভ বেশি হবে।
(6) দামের ভিত্তিতে নির্বাচন
কোনো দ্রব্য বা পরিসেবার দাম (price) অনুসারে ক্রেতা বা উপভোক্তা ওই দ্রব্য বা পরিসেবা কতটা ব্যবহার করবে সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন - বাজারে পেঁয়াজ, টমেটোর দাম বাড়লে লোকে ওগুলি সাধ্যমতো কম কেনার চেষ্টা করে।
যুক্তির সংগতি বা যৌক্তিকতা (Rationality)
যৌক্তিকতা – ইংরেজিতে Rationality - শব্দের অর্থ হল কার্যকারণের ওপর প্রতিষ্ঠিত যুক্তিসংগত কোনো কাজ। অর্থনৈতিক ব্যাপারে ব্যক্তি বা উপভোক্তার কাছে সেই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত, যে সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তি বা উপভোক্তা, সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়, সবচেয়ে বেশি উপযোগ আহরণ করতে পারে। ব্যক্তির এই আচরণকেই যুক্তিসংগত আচরণ বা র্যাশনাল বিহেভিয়র (rational behaviour) বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে যুক্তিসংগত আচরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি শুধু যে টাকা পয়সা – ধনদৌলত পাওয়ার চেষ্টা করে তাই নয়, আবেগের তৃপ্তি (emotional satisfaction) পাওয়াও তার লক্ষ্য। যেমন – ভাড়া বাড়িতে থেকে যাওয়া বা ফ্ল্যাট কেনার মধ্যে তুলনামূলক “নির্বাচন” করে কোনো ব্যক্তি একটি ফ্ল্যাট কিনলে যে আবেগজনিত তৃপ্তি পায়। তবে অর্থশাস্ত্রে ব্যক্তির আবেগের কোনো স্থান নেই। কেননা আবেগভিত্তিক সিদ্ধান্ত সব ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক হয়। যেমন অতিরিক্ত আয়ের লোভে চড়া সুদের আকাঙ্ক্ষায় বহু মানুষ বিশ্বাস করে চিট ফান্ডে টাকা রাখে। তাদের এই কাজ যুক্তিসংগত “নির্বাচন” বা যুক্তিসংগত আচরণ নয়।
যুক্তিসংগত আচরণের আরও একটি দিক হল ঝুঁকি নেওয়া বা না-নেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণ। ব্যক্তি তার বিবেচনা অনুযায়ী তার “নির্বাচন”-এ (choice) ঝুঁকি নিতে পারে, তবে সেই সিদ্ধান্ত যদি প্রতিটি স্তরে যুক্তির পরম্পরা অনুযায়ী ন্যায্য হয়, তাহলে ব্যক্তির ওই আচরণকে যুক্তিসংগত বলে গণ্য করা হবে।
যুক্তিসংগত নির্বাচনের নীতি (Principles of Rational Choice)
তত্ত্ব হিসেবে যুক্তিসংগত নির্বাচন একটি অর্থনৈতিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। নীতিটি এই যে ব্যক্তি সর্বদা বিচক্ষণ (prudent) এবং যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত (logical decisions) নেয়। এই সিদ্ধান্তগুলি ব্যক্তির সর্বোচ্চ স্বার্থ (highest self interest) রক্ষা করে এবং ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ও তৃপ্তি দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে ব্যক্তিস্বার্থ (self interest) বলতে কোনো ব্যক্তিকে স্বার্থপর (selfish) বোঝায় না।
যুক্তিসংগত নির্বাচনের উপাদান ও অনুমানসমূহ (Elements and Assumptions of Rational Choice) যুক্তিসংগত নির্বাচন তত্ত্বের উপাদান ও অনুমানগুলি নিম্নরূপ —
(1) ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা (Individualism) :
ব্যক্তি বা তার সুবিধা, সুখ, তৃপ্তি ও উপযোগ বৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় (actor) |
(2) অনুকূলতা (Optimality) :
ব্যক্তি তার সুযোগ (opportunity) ও অসুবিধাগুলির (constraints) বন্ধু বিবেচনা করে ওই ব্যক্তির নিজের পক্ষে যা অনুকূল, সেই কাজগুলি করে। তবে ব্যক্তির ওই পছন্দ বা কাজ সর্বদা সবচেয়ে ভালো কাজ বা সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে। সুতরাং ব্যক্তির কাজ বা “নির্বাচন” অবস্থার (situation) সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।
(3) গঠন (structure)
কোনো ব্যক্তির কাজের গঠন (Structure) ও আদর্শ (norm) এক অবস্থা (situationi থেকে অন্য অবস্থায় আলাদা হবে এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে আলাদা হয়। (4) ব্যক্তিস্বার্থ (Self interest) : ব্যক্তির প্রতিটি কাজ তার নিজের স্বার্থপূরণে সক্ষম হবে।
(5) যৌক্তিকতা (Rationality) :
ব্যক্তির সিদ্ধান্ত তার নিজ যুক্তি ও বিবেচনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
(6) বিকল্পগুলির তুলনাযোগ্যতা (Completeness of alternatives) :
ব্যক্তি তার বিবিধ বিকল্পগুলির মতে যখন তুলনা করে, তখন প্রতিটি বিকল্প অন্য বিকল্পের সঙ্গে তুলনীয় হওয়া উচিত। যেমন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে তুঝা নিবারণের জন্য ঠান্ডা জল ও শরবতের মধ্যে তুলনা। অর্থাৎ a ও a-এর মধ্যে a. কে a-র তুলনায় বেশি পছন্দ হতে পারে; অথবা a-কে a,-র তুলনায় বেশি পছন্দ হতে পারে; অথবা a, ও a-র কোনোটিই পছন্দের নাও হতে পারে।
(7) বিকল্পগুলির উপযোগের পরিবহনযোগ্যতা (Transitivity of alternatives) :
ব্যক্তি যে বিকল্পগুলির মা থেকে তার পছন্দের বিকল্পটি নির্বাচন করে, সেই বিকল্পগুলির বৈশিষ্ট্য বা উপযোগের পরিবহনযোগ্যতা থাকা দরকার। যেমন- শীতকালে একজন ক্রেতা (অর্থাৎ উপভোক্তা) গরমজামা কিনবে বলে দোকানে একটি সোয়েটার, একটি কোট ও একটি জ্যাকেট দেখার পর ব্যক্তিটি সোয়েটারকে (a.) কোর্টের (a) তুলনায় বেশি পছন্দ করেছে; আবার কোটাকে (a.) জ্যাকেটের (a.) তুলনায় বেশি পছন্দ করেছে; সুতরাং ব্যক্তিটি সোয়েটারকে (a.) জ্যাকেটের (az) তুলনায় বেশি পছন্দ করেছে। ব্যক্তি বা উপভোক্তার এই পছন্দটি সম্ভব হয়েছে কারণ সোয়েটার, কোট ও জ্যাকেটের গরমজামা হিসেবে উপযোগ পরস্পর তুলনীয় ও পরিবহনীয়। এখানে উল্লেখ্য যে দুটি বিকল্পের মধ্যে তিন ধরনের পক্ষপাতিত্ব (preference) হতে পারে, যথা—
(i) যথাযথ পক্ষপাতিত্ব (Strict preferences) :
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন দুটি বিকল্প, ধরা যাক, সোয়েটারকে (a.) কোটের (a) তুলনায় গরমজামা হিসেবে বেশি পছন্দ করেছে, কিন্তু কখনই সোয়েটার (a)) ও কোট (az)-কে সমান পছন্দ করেনি, তখন সেই ঘটনাটি যথাযথ পক্ষপাতিত্ব (strict preferences)।
(ii) দুর্বল পক্ষপাতিত্ব (Weak preferences)
: অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন দুটি বিকল্প, ধরা যাক, সোয়েটারকে (aq) কোর্টের (az) তুলনায় গরমজামা হিসেবে বেশি পছন্দ করেছে, অথবা সোয়েটার (aq) ও কোট (az)-এর মধ্যে কোনোটিকেই পছন্দ করেনি, তখন সেই ঘটনাটি হল দুর্বল পক্ষপাতিত্ব (weak preferences) (iii) অনিরপেক্ষতা (Indifference) : অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যখন দুটি বিকল্প, ধরা যাক, সোয়েটারকে কোর্টের (az) তুলনায় অথবা কোটকে (az) সোয়েটারের (a) তুলনায় গরমজামা হিসেবে বেশি পছন্দ করেনি। তখন সেই ঘটনাটি অনিরপেক্ষতা (indifference)।
(৪) পূর্ণাঙ্গ তথ্য (Perfect information) :
আলোচ্য তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয় যে ব্যক্তির কাছে তার বিকল্পগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য আছে, যার ভিত্তিতে সে বহু বিকল্পের মধ্য থেকে তার কাছে সঠিক বিকল্পটি নির্বাচন করে।
যুক্তিগত নির্বাচনের তত্ত্ব অনুযায়ী বিকল্পের ধারণা (Conception of alternatives as per Rational Choice Theory)
যুক্তিসংগত নির্বাচনের তত্ত্ব (Rational Choice Theory) অনুযায়ী বিকল্প বলতে একগুচ্ছ কাজকে বোঝায় (set of actions)। বিকল্পের (alternatives) অনেকগুলি দিক বা মাত্রা আছে, যেমন—
(i) কোন্ কাজটি করা বাঞ্ছনীয় এই প্রশ্ন অনুসারে অনেকগুলি বিকল্প কাজের মধ্য থেকে একটি কাজকে নির্বাচন করা হয়। এটি হল কার্যভিত্তিক বিকল্প (set of alternative actions)
(ii) কোন পণ্য ও পরিসেবাটি কেনা হবে বা পছন্দ করা হবে— এই প্রশ্ন অনুসারে অনেকগুলি বিকল্প পণ্য ও পরিসেবার মধ্য থেকে একটি পণ্য ও পরিসেবাকে নির্বাচন করা হয়। এটি হল পছন্দভিত্তিক বিকল্প (set of choosing /-buying alternatives)।
যেমন, আগে দেওয়া সোয়েটার (aq), কোর্ট (a) ও জ্যাকেট (az)-র উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে-
u(a,) > u(a)
u(a,) > u(a,) > u(a)) (2)
যেখানে u - উপযোগ (utility)।
কাজ বা কর্মগুচ্ছের ধারণা (Conceptions of actions)
যুক্তিসংগত নির্বাচনের তত্ত্ব অনুযায়ী, কাজ বা কর্মগুচ্ছ হল ফলাফলের মাধ্যম (instrument of outcome)। নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যক্তি বিভিন্ন পছন্দের (options) ভেতর থেকে তার উপযুক্ত বিকল্পকে অর্থাৎ কাজকে খুঁজে নেয়।
যুক্তিসংগত নির্বাচনের পদ্ধতি (Rational Choice Processes)
অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা র্যাশনাল চয়েস বা যুক্তিসংগত নির্বাচনের যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তা হল—
(1) কে, কোথায়, কী বিষয়ে “নির্বাচন” করছে অর্থাৎ তার বা তাদের পছন্দ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে, সে সম্পর্কে জানা (definition of the problem) |
(2) সিদ্ধান্ত গ্রহণের সূচকগুলিকে (decision criteria) চিহ্নিত করা ও সূচকগুলির কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা (weighing the criteria)
(3) সম্ভাব্য নির্বাচনযোগ্য পণ্য বা পরিসেবার বিকল্প (alternatives) পণ্য বা পরিসেবাগুলিকে চিহ্নিত করা (generation of valid alternatives)
(4) বিকল্পগুলিকে সূচকের ভিত্তিতে ক্রম অনুযায়ী সাজানো এবং গাণিতিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো (rating and computation for rational decision)
সমালোচনা (Criticism)
যুক্তিসংগত নির্বাচন তত্ত্ব অর্থাৎ র্যাশনাল চয়েস থিয়োরির কিছু শক্তি ও দুর্বলতা (strength and weakness ) আছে। যেমন-
(1) তত্ত্বটি শুধুমাত্র অর্থশাস্ত্রই নয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনৈতিক ভূগোল, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগের উপযুক্ত।
(2) আলোচ্য তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয়েছে যে প্রতিটি ব্যক্তি হল “ইকনমিক ম্যান” বা “হোমো ইকনমিকাস (Homo Economicus)। ব্যক্তি তার নিজের সুবিধা অনুযায়ী যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নেয় যার ফলে ওই ব্যক্তির ব্যয় বা খরচের (cost) তুলনায় উপকার বা সুবিধা (benefit) বেশি হয়।
বস্তুত স্বল্প ব্যয়ে অধিক লাভের ইচ্ছা মানুষের মধ্যে এত প্রবল যে বেকার (G Becker, 1976) তাঁর The Economic Approach to Human Behaviour নামক নিবন্ধে আলোচ্য তত্ত্বটির সার্বজনিক আবেদন সম্পর্কে বলেছেন যে যুক্তিসংগত নির্বাচন তত্ত্ব হল মানুষের আচরণ সম্পর্কে ধারণা করার জন্য একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা (a unified. framework for understanding all human behaviour) |
(3) ব্যক্তির যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত (বা নির্বাচন) সব সময় তার শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক সক্ষমতা, প্রয়োজন, রুচি ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।
(4) ব্যক্তি যে তথ্যের ভিত্তিতে নির্বাচন করে বা কোনো পরিসেবার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়, সেই তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নির্ভর করে,
(i) তথ্যটি কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছে, সেই উৎসের (source) ওপর, (ii) তথ্যটি উপলব্ধি (cognition) করার জন্য মানসিক অবস্থার ওপর এবং (iii) সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কতটুকু সময় নেওয়া হয়েছে বা সময় পাওয়া গিয়েছে তার ওপর। প্রসঙ্গত, এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা “বাউন্ডেড র্যাশনালিটি”-র (Bounded rationality) ধারণার জন্ম দিয়েছেন।
(5) হার্বার্ট এ সাইমন (Herbert A Simon, 1957) তাঁর Models of Man গ্রন্থে দেখিয়েছেন মানুষ যে সিদ্ধান্ত নেয় তার কিছুটা যুক্তিসংগত (rational) আর বাকিটা যুক্তিসংগত নয় (irrational)।
(6) ব্যক্তি মানুষের বিকল্পভিত্তিক নির্বাচনকে গাণিতিক উপায়ে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হলেও, সেই ফলাফলের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক আচরণ (social behaviour) নির্ধারণ করা কঠিন কাজ। কারণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির বৈশিষ্ট্য ও উপযোগ আলাদা।