জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ (Evidences of Climate Changes) :
বিভিন্ন ভূ-তাত্ত্বিক যুগে জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্ন পৃথিবীর উপরিভাগে, সমুদ্রতলে ও ভূ-ত্বকের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণসমূহ নীচে আলোচনা করা হল—
1. অতীত হিমবাহের অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন ( Indication of advancement and retreat of past glaciers) :
হিমবাহের পর্যায়ক্রমিক অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন থেকে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা করা যায়। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা গেছে যে খ্রিস্টের জন্মের 3000 বছর পূর্বে পৃথিবীতে বরফাবৃত অঞ্চল কমে গিয়েছিল। এখনকার তুলনায় হিমরেখা 300 মিটার ওপরে অবস্থান করছিল। আবার, খ্রিস্টপূর্ব 500 সাল নাগাদ হিমরেখা অনেকটা নেমে এসেছিল।
পরবর্তীকালে তার আবার পশ্চাদপসরণ ঘটে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে হিমরেখার পুনরায় অবনমন ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে হিমরেখার আবার পশ্চাদপসরণ ঘটে। কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিমবাহের অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের চিহ্ন রয়ে গেছে যা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণ মেলে।
2. পললের আস্তরণে জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্ন (Evidences of change of climate from sediment deposits) :
ভূত্বকে পললের সঞ্চয় অতীত জলবায়ু সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয়। আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশের মরুভূমিতে লবণের খনির অবস্থান থেকে ওই অঞ্চলে অতীতের আর্দ্র জলবায়ুর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায়। বর্তমানে স্থলভাগের যেসব অঞ্চলে লবণের স্তর উপস্থিত, সেই সব অঞ্চলে পূর্বে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অতিমাত্রায় বাষ্পীভবন ঘটে। এর পরিণতিতে হ্রদের জল শুকিয়ে গেলে সঞ্চিত লবণের স্তর লবণ খনিতে পরিণত হয়।
3. সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন (Change of sea level) :
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের উন্নতা ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মেরুপ্রদেশ ও উচ্চ পর্বতের চিরতুষারাবৃত অঞ্চল থেকে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। হিমবাহ গলনের ফলে সমুদ্রজলের উচ্চতা বাড়ছে। বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত অন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের (IPCC) একটি হিসাব অনুযায়ী বিগত কয়েক শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা 10-20 সেমি বেড়েছে। আবার, বায়ুমণ্ডলের উন্নতা কমলে সমুদ্রপৃষ্ঠের বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্লেইস্টোসিন হিমযুগে বায়ুমণ্ডলের উন্নতা ভীষণভাবে কমে যাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় 32 মিটার নেমে যায়। ফলে ওই সময় নদীর নিম্নক্ষয়ের শেষ সীমারও পরিবর্তন ঘটে। তখন উন্মুক্ত সমুদ্রতটের ওপর নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে নতুন নদীখাত সৃষ্টি হয়।
আবার, বিশ্ব উন্নায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের জন্য ওই নদীখাত পুনরায় সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। পরবর্তীকালে নিমজ্জিত নদীখাতটি সমুদ্রতলে ক্যানিয়ন হিসেবে অবস্থান করে। প্লেইস্টোসিন যুগে সমুদ্রতলের অবনমন হিমবাহের আবরণ বৃদ্ধিকেই সুচিত করে। অতএব সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান-পতন জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
4. জীবাশ্ম বিশ্লেষণ (Analysis of fossils) :
জীবজগতে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের বিন্যাস জলবায়ুনির্ভর। ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ুতে ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল গড়ে ওঠে। জলবায়ুর দৈশিক পরিবর্তনে (spatial changes) উদ্ভিদ ও প্রাণীদের পরিবর্তন লক্ষণীয়।
(a) প্রাণী জীবাশ্ম (Animal fossils) :
প্রাণীদের জীবাশ্ম থেকে কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে বয়স নির্ধারণ করে ওই অঞ্চলের জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্ল্যাঙ্কটন সাধারণত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রজলে বেড়ে ওঠে। সমুদ্রের যেসব অঞ্চলে প্ল্যাঙ্কটনের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, সেইসব সামুদ্রিক অঞ্চলের অতীত জলবায়ু সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। আবার, স্থলভাগের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবাশ্ম থেকে তাদের আবাসস্থলের জলবায়ু সম্পর্কে জানা যায়।
(b) উদ্ভিদ জীবাশ্ম (Plant fossils) :
উদ্ভিদের অস্তিত্ব রক্ষায় জলবায়ুর প্রভাব সর্বাধিক। তাই উদ্ভিদের জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন—
(i) একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্ট জলবায়ুতেই গড়ে ওঠে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে যে ধরনের বড়ো পাতার উদ্ভিদ জন্মায়, তা মরুভূমিতে স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারে না। আবার, নাতিশীতোষ অঞ্চলের সরলবর্গীয় উদ্ভিদ নিরক্ষীয় অথবা মরু অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। জয়শলমিরের মরু জলবায়ুতে সরলবর্গীয় গাছের উপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব। কারণ দেওদর গাছ উচ্চ অক্ষাংশীয় শীতল জলবায়ুতে অথবা উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জন্মায়। তথাপি এই অঞ্চলের উড ফসিল পার্কে স্বস্থানিক দেওদর গাছের (1 কোটি 80 লক্ষ বছর পূর্বের) জীবাশ্ম ওই অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনেরই আভাস দেয়।
(ii) উদ্ভিদের পরাগরেণু বিশ্লেষণ করে অতীতের জলবায়ুর প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা যায়। প্রাচীন হ্রদ বা জলাশয়ের মাটি থেকে সংগৃহীত পরাগরেণু বিশ্লেষণ করলে গাছের প্রকারভেদ এবং সেগুলির জীবদ্দশাকালে জলবায়ুর প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। যদি বিভিন্ন স্তরে পরাগরেণুর বিভিন্নতা দেখা যায় তাহলে তা জলবায়ুর পরিবর্তনকে নির্দেশ করে।
(iii) উদ্ভিদের বর্ষবলয়কে বিশ্লেষণ করেও অতীত জলবায়ুর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কোনো বৃক্ষের কাণ্ডকে আড়াআড়িভাবে কাটলে দেখা যায় যে কাণ্ডের কেন্দ্রকে বেষ্টন করে কতকগুলি বলয় অবস্থান করছে। এই বলয়গুলির সংখ্যা গুণলে গাছের বয়স নির্ধারণের পাশাপাশি বৃক্ষটির জীবদ্দশায় জলবায়ু কেমন ছিল তা জানতে পারা যায়। যেমন কোনো বৃক্ষের বর্ষবলয় গোলাকৃতি ও পুরু হলে সেটি উদ্ভিদ বিকাশের জন্য অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিবেশ অর্থাৎ উয়-আর্দ্র অবস্থাকে নির্দেশ করে। অপেক্ষাকৃত পাতলা বলয়গুলি প্রতিকূল শুষ্ক ও শীতল জলবায়ুকে নির্দেশ করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডগলাস (Douglass) দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকায় উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ষবলয় বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন যে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ও বৃক্ষের বর্ষবলারের বৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। অনুরূপভাবে, আমেরিকার অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক ক্যালিফোর্নিয়ার শ্বেত পর্বতের এক-একটি পাইন গাছের বর্ষবলয় বিশ্লেষণ করে 3500 ও 1300 খ্রিস্টপূর্বাব্দের জলবায়ু বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে প্রমাণ হয়েছিল, ওই সময় ওই এলাকায় শীতল জলবায়ু ও হিমবাহের উপস্থিতি ছিল।
5. ভাসায় (Varves deposits) :
কোনো হ্রদ বা পুকুরে ঋতুভেদে বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত বালি ও কাদার স্তরকে ভাব বলে। তাই কোনোস্থানে ভার্ব সঞ্চয়ের প্রকৃতি দেখে ওই স্থানের অতীত জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়। যেমন—স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহে শুধুমাত্র ভার্ব সঞ্চয়ের প্রকৃতি দেখেই বিগত 13700 বছরের অতীত জলবায়ুর বিবরণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
6. হিমবাহ সঞ্চিত আবরণের গভীরতা পর্যবেক্ষণ (Depth of glacial deposition) :
হিমবাহের বরফের গভীর আস্তরণ পর্যবেক্ষণ করেও অতীত জলবায়ুর প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানী হ্যারল্ড সি উরে (Harold C Urey)-র নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে পাইপ দিয়ে ড্রিল করে বরফের অতিগভীর স্থানের নমুনা সংগ্রহ করে পুরা তাপমাত্রার (Peleo-temperature) বিশ্লেষণ করেন। অর্থাৎ, বহু বছর আগে যখন বরফ জমেছিল, তখনকার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি বরফের স্তরে আবদ্ধ অক্সিজেনের দুটি রূপভেদ (আইসোটোপ) O-16 এবং O-18 বিশ্লেষণ করে এই ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হন। আবার, বরফের আস্তরণে আবদ্ধ বায়ুর বুদবুদ বিশ্লেষণ করে অতীতের বিভিন্ন সময়ের বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়।