ইকনমিক ম্যান (Economic Man)
1776 সালে স্কটিস দার্শনিক ও ধ্রুপদি অর্থতত্ত্বের (Classical economics) প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) তাঁর An Enquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations গ্রন্থে “ইকনমিক ম্যান" (Economic Man)-এর ধারণা দেন।
বাংলায় “ইকনমিক ম্যান”-কে “অর্থনীতিক মানুষ” বা “অর্থনৈতিক মানুষ” বলা যায়। তবে “ইকনমিক ম্যান” শব্দবন্ধের মধ্যে যে গভীর ব্যপ্তি রয়েছে, তা “অর্থনীতিক মানুষ” বা “অর্থনৈতিক মানুষ” – এই ভাষান্তরের মধ্যে সবটা খুঁজে পাওয়া যায় না বলে মনে হয়। তাই বর্তমান আলোচনায় “ইকনমিক ম্যান”-কে তার স্বনামে অর্থাৎ ““ইকনমিক ম্যান” নামেই ডাকা হবে। প্রসঙ্গত 1784 সালে অ্যাডাম স্মিথের Wealth of Nations গ্রন্থের পরিশোধিত বৃহত্তর সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এবং অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) 1844 সালে প্রকাশিত তাঁর Essays on Some Unsettled Questions in Political Economy নামক গ্রন্থে রাজনৈতিক অর্থনীতির (Political Economy) আলোচনায় “ইকনমিক ম্যান”-এর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন।
পরবর্তী পর্যায়ে ফ্রান্সিস এজওয়ার্থ (Fransis Edgeworth), উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভস (William Stanley Jevons), লিয়ন ওয়ালরস (Leon Walras), ভিলফ্রেডো প্যারেটো (Vilfredo Pareto) প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ ইকনমিক ম্যান-এর ধারণাকে সম্প্রসারিত করেন। এমনকি আলোচ্য ধারণাটিকে গাণিতিক মডেলেও তুলে ধরা হয়।
ইকনমিক ম্যান-এর ধারণা ও গুরুত্ব (Concept and Significance of Economic Man)
ইকনমিক ম্যান হল অর্থশাস্ত্রের কাল্পনিক আদর্শ মানুষ অর্থাৎ মডেল ম্যান (model man) । ইকনমিক ম্যানের বৈশিষ্ট্য, যে সে এমন মানুষ, যার –
(i) সজাগ স্বার্থবুদ্ধি আছে (self interest) কিন্তু স্বার্থপর (selfish) নয়; (ii) যুক্তিবোধ আছে (logical): (iii) বিচারবুদ্ধি আছে (rational); (iv) দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানভিত্তিক (scientific thinking); (v) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচলিত সমস্যাগুলি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা আছে (full idea of problem); (vi) কোনো কাজের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্ম সজ্ঞানে (consciously) স্থির করার ক্ষমতা আছে; (vii) বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে (intelligently) তথ্য বিশ্লেষণ করার নৈপুণ্য আছে; যার অনুকূল সিদ্ধান্তগুলি (optimal decisions) কারবারের বা প্রতিষ্ঠানের খরচ কমায় ও মুনাফা বাড়ায়; এবং (viii)যার প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপ অর্থশাস্ত্রে প্রচলিত কোনো মডেলের (models) বিরোধী নয়। অর্থাৎ ইকনমিক ম্যান হল অর্থশাস্ত্রীয় মডেলগুলির ক্ষেত্রে উদাহরণযোগ্য মানুষ যাকে হোমো ইকনমিকাস (Homo economicus) বলা হয়।
“হোমো ইকনমিক্স” উপভোক্তা হিসেবে দ্রব্যের সর্বোচ্চ উপযোগ (utility) ভোগ করে এবং উৎপাদক হিসেবে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ করে। প্রকৃতি অনুসারে “হোমো ইকনমিকাস” হল “হোমো রেসিপ্রোক্যান্স” (Homo reciprocans)-এর বিপরীত মেরুর মানুষ। কারণ হোমো রেসিপ্রোক্যান্সরা সব সময় নিজ স্বার্থবুদ্ধিচালিত মানুষ নয়। যেমন বাজারে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো বিক্রেতা, কোনো ক্রেতার সঙ্গে প্রচুর তর্কাতর্কি, দরদাম করার পরে (haggle) অনেক কম দামে কোনো জিনিস বেচে দিল। এক্ষেত্রে এই বিক্রেতা হল “হোমো রেসিপ্রোক্যান্স” এবং যে ক্রেতা কম দামে জিনিসটি কিনতে সমর্থ হল। সে “হোমো ইকনমিকাস"।
ইকনমিক ম্যান ধারণাটির দুর্বলতা ও সমালোচনা (Weakness and Criticism of the Concept of Economic Man)
ইকনমিক ম্যান ধারণাটির কিছু দুর্বলতা পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী, সমাজ দার্শনিক, অর্থনৈতিক নৃতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদের কাজে ও গবেষণায় উঠে এসেছে, যেমন –
(1) সমাজ শুধুই মুনাফার জন্য নয়, সমাজে সামাজিক বিনিময়েরও স্থান আছে। কার্ল পোলানি (Karl Polanyi, 1944. The Great Transformation), মার্শাল শালিস (Marshall Sahlins, 1972, Stone Age Economics), মার্সেল মওস (Marcel Mauss, 1924, The Form and Reason for Exchange in Archaic Societies) প্রমুখ দেখিয়েছেন যে ঐতিহ্যশালী সমাজে (traditional societies) মানুষের আর্থিক ও সামাজিক আচরণ “ইকনমিক ম্যান”-এর নিজস্বার্থ চালিত আচরণের তুলনায় অনেক আলাদা। যেমন -
(i) পাপুয়া নিউগিনিতে সামাজিক ক্ষেত্রে বড়ো মাপের মানুষদের শূকর ও অন্যান্য দ্রব্য দানের অর্থাৎ “মোকা" (Moka) দেওয়ার প্রচলন আছে,
(ii) থাইল্যান্ড এবং অন্যত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিদানের আশা না করে দানের প্রচলন আছে, যে রেওয়াজ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেও দেখা যায়। সুতরাং এই মানুষেরা পণ্য বা দ্রব্যের ক্রয়, বিনিময়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ লাভের আশা না রেখেই কাজ করে। এই কারণে সমাজের সবাই “ইকনমিক ম্যান” হয় না। সামাজিক মূল্যবোধকে সমৃদ্ধ করা ও মুনাফা বৃদ্ধি করার লক্ষ্য ও পদ্ধতি সর্বদাই আলাদা।
প্রসঙ্গত, সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে পণ্যের বিনিময় বাজারকেন্দ্রিক নয় (non-market exchange)। কিন্তু মুনাফা সর্বোচ্চ করার উদ্দেশ্যে পণ্যের হস্তান্তর হল বাজারকেন্দ্রিক বিনিময় (market exchange)। এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
(2) যুক্তি ও বিচারবোধসম্পন্ন মানুষ সামাজিক মঙ্গলের জন্যও কাজ করে। বর্তমানকালেও বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, সফটওয়্যার ডেভেলপাররা মানুষের কল্যাণের জন্য মাঝে মাঝে এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, যা “ইকনমিক ম্যান”-এর নিজস্বার্থ রক্ষার ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যেমন –
QGIS সফটওয়্যার, Linux Kernel অপারেটিং সিস্টেম, রিচার্ড স্টলম্যান (Richard Stallman)-এর উদ্যোগে GNU ফ্রি সফটওয়্যার প্রভৃতি প্রকল্প অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী ও পেশাদার, অপেশাদার মানুষের উপকারে আসছে। লাভের সর্বোচ্চকরণ এঁদের অর্থাৎ আলোচ্য উদ্যোগের উদ্যোক্তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না।
(3) অর্থনৈতিক কাজে ঝুঁকি (risk) আছে। কেইন্স, ভেবলেন, সাইমন প্রমুখ অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন যে ইকনমিক ম্যান-এর সবক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও তার ভিত্তিতে মুনাফা বৃদ্ধি করার নৈপুণ্য বাস্তবে সর্বদা ঘটে না। কারণ যে-কোনো অর্থনৈতিক কাজ – তা কৃষি, শিল্প, ব্যাবসা যাই হোক না কেন, তার মধ্যে ঝুঁকি (risk) থাকবে। যেমন খরা ও বন্যায় চাষের ক্ষতি, কাঁচামালের অভাবে শিল্পের ক্ষতি, বাজারে চাহিদার পরিবর্তন হলে বা সহজ শর্তে ঋণের অভাবে ব্যাবসার ক্ষতির ঝুঁঝুঁকি বাদ দিয়ে কারবার করা যায় না।
(4) বিনিয়োগকারী (investors) অনেকক্ষেত্রেই বিনিয়োগে বিচারবোধের পরিচয় দেয় না, যা ইকনমিক ম্যান-এর প্রকৃতি বিরোধী। ইজরায়েলি গণিতবিদ-মনস্তাত্ত্বিক এমোস তেভারস্কি (Amos Tversky) দেখিয়েছেন যে বিনিয়োগকারীরা যে বিনিয়োগে ক্ষতির ঝুঁকি অল্প সেখানে স্বল্প বিনিয়োগ করেন ও যেখানে ক্ষতির ঝুঁকি বেশি সেখানে উদাসীন (indifferent) থেকে বেশি বিনিয়োগ করেন। তাঁদের এই আচরণ মুনাফা বৃদ্ধির উপযুক্ত হলেও, আর্থিক যুক্তিবোধের উপযুক্ত নয়।
ইকনমিক ম্যান-এর ধারণায় কিছু দুর্বলতা থাকলেও, বিশ্লেষণের স্বার্থে এটি মেনে নেওয়া দরকার যে অ্যাডাম স্মিথ, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ অর্থতত্ত্ববিদ সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষ বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ “ইকনমিক ম্যান” হবে, সে দাবি করেননি।
কারণ এই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এমন প্রচুর মানুষ বাস করেন, যাদের শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিধিনিষেধ ইত্যাদি আলাদা। সুতরাং প্রত্যেকেই সমযুক্তি ও সমবিবেচনার মানুষ হবেন, তা সম্ভব নয়।
তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তত্ত্ব ও মডেলগুলির প্রয়োগের উপযুক্ত কাল্পনিক মানুষ হল ইকনমিক ম্যান। সুতরাং নিজের ভালোমন্দ, লাভ-লোকসান বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সবাই না পারলেও, প্রতিটি সমাজে এমন লোক সংখ্যায় অল্প হলেও নিশ্চয়ই আছে, যাদের আর্থিক যুক্তিবোধ, বিবেচনাবোধ আছে। যারা তথ্য বিশ্লেষণে নিপুণ ও যারা অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণে পটু। তারাই ইকনমিক ম্যান।