ওজোন স্তরের বিনাশ (Destruction or depletion of Ozone Layer) :
প্রাকৃতিক কারণ (Natural Causes) :
স্ট্যাটোস্ফিয়ারে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় UV-C এবং UV-B রশ্মির প্রভাবে যেমনভাবে ওজোন গ্যাসের সৃষ্টি হয়। ঠিক তেমনভাবেই অধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের UV-A রশ্মির প্রভাবে ওজোন (Og) ভেঙে অক্সিজেন অণু (O.) ও অক্সিজেন পরমাণু (O) তৈরি করে।
O2 UV-A 02 +0
এভাবে দিনের বেলায় অক্সিজেন থেকে ওজোন উৎপাদন, বিয়োজন এবং পুনরুৎপাদন চলতে থাকে এবং স্ট্যাটোস্ফিয়ারে ওজোন স্তরের ঘনত্ব বজায় থাকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন বায়ুমণ্ডলে প্রায় 350,000 মেট্রিক টন ওজোন গ্যাস সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়।
এ ছাড়া সৌরকলঙ্কের চক্রের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন নাইট্রাস অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়ে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। (i) প্রথমে নাইট্রোজেন অণু (N.) অক্সিজেন পরমাণুর (O) সঙ্গে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নাইট্রাস অক্সাইড (NO) তৈরি হয়। (ii) এরপর নাইট্রাস অক্সাইড (NO) অক্সিজেন পরমাণুর (O) সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রিক অক্সাইড (NO) উৎপন্ন করে। (iii) নাইট্রিক অক্সাইড (NO) ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO) এবং অক্সিজেন অণু (O2) তৈরি করে ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে।
1. N2+ O → NO
2. N2 O + O2NO
3. NO + O2 → NO + O
2. মনুষ্যসৃষ্ট কারণ (Man made causes) :
প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ওজোন স্তরের বিনাশ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রাকৃতিক উপায়ে ওজোন গ্যাসের পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে বিনাশ এবং উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হয়ে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু বিংশ শতকের শেষদিকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ করা গেছে যে স্ট্যাটোস্ফিয়ারে উপস্থিত ওজোন স্তরটি ক্রমাগত পাতলা হয়ে আসছে। তাই বিজ্ঞানীগণ নিশ্চিত হন যে, ওজোন গ্যাসের ধ্বংসের হার পুনরুৎপাদনের হারের তুলনায় বেড়ে চলেছে। এই ওজোনের বিনাশ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ঘটছে না। পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয় যে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC), ব্রোমিন যৌগ, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফেট যৌগ ওজোন স্তরের ক্রমাগত বিনাশ ঘটিয়ে চলেছে।
(i) ক্লোরিন তত্ত্ব :
মানুষের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের ফলে উৎপন্ন ক্লোরিন পরমাণু (CI) স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন
স্তর বিনাশের পিছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর মানুষের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে উৎপন্ন ক্লোরিনের প্রধান উৎস হল ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) গ্যাস। 1930 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন রসায়নবিদ থমাস মিজলে (Thomas Midgley) CFC আবিষ্কার করেন। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন যৌগগুলি ফ্রেয়ন নামেও পরিচিত। এদের বাণিজ্যিক নাম জেনেট্রনস। CFC-এর একাধিক রূপভেদ রয়েছে। যথা- CFC-11, CFC-12, CFC-22, CFC. 113 ইত্যাদি। এদের একত্রে CFC, বলে। 1974 খ্রিস্টাব্দে দুইজন পরিবেশ বিজ্ঞানী মারিও মোলিনা (Ma- rio Molina) এবং শেরউড রোল্যান্ড (Sherwood Rowland) মনুষ্যসৃষ্ট ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) গ্যাসকে ওজোন স্তর পাতলা হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে সর্বপ্রথম চিহ্নিত করেন। পরবর্তীকালে 1986 খ্রিস্টাব্দে ড. সুসান সালোমান ওজোন বিনাশের ক্ষেত্রে ক্লোরিন দূষণের ভূমিকার ওপর জোর দেন। সম্প্রতি NASAও CFC-এর মাধ্যমে উৎপন্ন ক্লোরিনকেই ওজোন ধ্বংসের কারণ হিসেবে মেনে নেয়। সম্প্রতি একটি গবেষণায় জানা গেছে যে একটি CFC কণা 1 লক্ষেরও বেশি ওজোন কণাকে ধ্বংস করে।
শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে রেফ্রিজারেটার, এয়ারকন্ডিশনার, স্প্রেক্যান, বিমানের প্রপেলার, ফোম, প্লাস্টিক তৈরির কারখানায় প্রচুর CFC ব্যবহৃত হয়। ফলে CFC বায়ুতে মুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে ওজোন স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। সেখানে সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে CFC ভেঙে ক্লোরিন পরমাণু উৎপন্ন করে। এই ক্লোরিন পরমাণু (CI) ওজোনকে বিশ্লিষ্ট করে ক্লোরিনমনোক্সাইড (CIO) এবং অক্সিজেন অণু (O2) উৎপন্ন করে।
CFC+ UV ray-CL
CL + O → CIO + O
(ii) সালফেট তত্ত্ব : মানুষের বিভিন্ন শিল্প
সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের ফলে কলকারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে নানাপ্রকারের সালফেট যৌগযুক্ত কণা নির্গত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মেশে। এই সালফেড কণাগুলি (বিশেষত হাইড্রোজেন সালফাইড H,S) অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে ওজোন অণুগুলিকে ভেঙে অক্সিজেন অণু ও পরমাণুতে রূপান্তরিত করে।
সালফেট কণাগুলির মধ্যে হাইড্রোজেন সালফাইট (HS) ওজোন ধ্বংসে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। HS গ্যাস হাইড্রক্সিল মূলকের (OH) সঙ্গে বিক্রিয়া করে HS এবং জল (H,O) উৎপন্ন করে। পরে HS ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে HSO এবং অক্সিজেন অণুতে পরিণত হয়ে ওজোনকে বিশ্লিষ্ট করে। আবার, উৎপন্ন HSO গ্যাসটি পুনরায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে ওজোনকে ভেঙে দেয়।
OH+H.SHO+ HS
HS+OHSO+O2 HSO+02- HSO2+O2
(iii) নাইট্রোজেন অক্সাইড তত্ত্ব
নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোজেন অক্সাইড যৌগ ঘটিত বিভিন্ন গ্যাস (NOx), যেমন—নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO), নাইট্রিক অক্সাইড (NO) প্রভৃতি বায়ুতে এসে মিশছে। এই গ্যাসগুলি নানা প্রকারে বিক্রিয়া করে ওজোন স্তর ধ্বংস করছে। এ ছাড়া স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সুপারসনিক বিমান থেকে নির্গত জলীয় বাষ্প এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO) বায়ুতে মিশে ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোনকে বিনাশ করছে। নাইট্রিক অক্সাইড (NO) ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO) এবং অক্সিজেন অণু (O.) উৎপন্ন করে ওজোনকে বিনষ্ট করছে। এই NO, পুনরায় অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাইট্রাস অক্সাইড (NO) তৈরি করে আবার ওজোন ধ্বংসে ফিরে আসছে। এভাবে চক্রাকারে NO থেকে NO, এবং পুনরায় NO উৎপাদনের মাধ্যমে ওজোন ধ্বংস হয়ে চলছে।
NO+ O- NO2+O
NO2+ONO+02
(iv) ব্রোমিন যৌগ তত্ত্ব :
বর্তমানে ওজোন বিনাশ প্রসঙ্গে ব্রোমিন যৌগের বিষয়টি উল্লেখ করা হচ্ছে। আগুন নেভানোর কাজে ট্রাইফুরো ব্রোমোকার্বন (CF, Br), ডাই ফুরো ব্রোমো ক্লোরো কার্বন (CF,BrCI) এবং মিথাইল ব্রোমাইট (CH, Br) গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এগুলি CFC-এর ন্যায় বায়ুমণ্ডলে দীর্ঘদিন থেকে যায় এবং বিভিন্ন বিক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রোমিন উৎপন্ন করে ওজোন স্তরের বিনাশ ঘটায়।
CH.Br সূর্যরশ্মি →CH2 + Br
2Br+O2 Br2 O +02
Br2O + O → 2Br + O2
v) অন্যান্য
করে। এই হাইড্রক্সিল মূলক (OH) ওজোন অণুকে ভেঙে হাইড্রো পারঅক্সাইড (HO) মূলক ও অক্সিজেন অণু (O2)তৈরি করে।
( : উপরিউক্ত গ্যাসীয় উপাদানগুলি ছাড়াও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H,O,) এবং মিথেন (CH.) ওজোন স্তর ধ্বংসে খুব অল্প হলেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ঊর্ধ্বাকাশে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H2O) ভেঙে হাইড্রক্সিল মূলক (OH) তৈরি
H2 O2 UV-B 2HO
HO + O2 → 02 + HO
মিথেন (CH) ঊর্ধ্বাকাশে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে বিশ্লিষ্ট হয়ে (CH.) এবং হাইড্রোজেন পরমাণু (H) উৎপন্ন করে। এই CH, ওজোনকে ভেঙে মিথক্সি (CH,O) এবং অক্সিজেন (O.) সৃষ্টি করে।
CH2 UV-B CH+H
CH+O → CHO+O2