অরণ্যনিধন (deforestation)
ভারতবর্ষে একদা (খ্রিস্টপূর্ব 3,000 বছর) সমগ্র ভূমির 80% জুড়ে অরণ্যাঞল বিরাজ করত। আর 2010 খ্রিস্টাব্দে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র 23% অথবা 68,434,000। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, সেইসঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাথাপিছু সম্পদের চাহিদার সম্মিলিত ফলেরই একটি প্রকাশ এই অরণ্যনিধন।
1990 থেকে 2000 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ভারতের 224,750 হেক্টর অরণ্য ধ্বংস হয়েছে। সেইসঙ্গে শেষ হয়ে গেছে এদেশের অধিকাংশ তৃণভূমি। ভারতে মাথাপিছু অরণ্যভূমির পরিমাণ সর্বাপেক্ষা কম। পৃথিবীতে মাথাপিছু অরণ্যভূমির পরিমাণ গড়ে ।
হেক্টর, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ মাত্র 0.10 হেক্টর। আবার কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু গড় অরণ্যভূমির পরিমাণ যথাক্রমে 14.2, 7.6 এবং 7.30 হেক্টর। ভারতে প্রতি বছরে গড়ে 15 লক্ষ হেক্টর অরণ্য নির্মূল করা হয়। এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী 20 বছরের মধ্যে ভারত সম্পূর্ণ অরণ্যবিহীন হয়ে পড়বে। ভারতের মোট ভূভাগের প্রায় । শতাংশ ভূমি প্রতি বছর বন্ধ্যা ভূমিতে পরিণত হয়।
* আমাদের দেশে অরণ্যনিধনের প্রধান কারণগুলি হল: ঝুম চাষ ( Jhoom Cultivation), উন্নয়ন প্রকল্প (Development projects), জ্বালানি কাঠের চাহিদা (Demand for Firewood), শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কাঠের চাহিদা (Demand for wood for industry and commercial purposes) ও অন্যান্য কারণ ( other causes )
পাহাড়ি অঞ্চলের ঝুমচাষ :
পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষেরা তাদের প্রয়োজনে বনের কিছু অঞ্চল আগুনে পুড়িয়ে পরিষ্কার করে কয়েক বছর যাবৎ চাষ-আবাদ করে। জমির উর্বরতা কমে গেলে সেই জমি পতিত রেখে আবার নতুন জমির সৃষ্টি করে। এভাবে ঝুমচাষের ফলে যে বনভূমি ধ্বংস করা হয়, সেখানে নতুন করে বনভূমি প্রায়ই গড়ে ওঠে না। এরূপে বিপুলভাবে অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুণাচলপ্রদেশ, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে ব্যাপকভাবে স্থানান্তর কৃষি ( Shiting cultivation) করা হয়ে থাকে। এক সমীক্ষা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, ভারতে এ পর্যন্ত প্রায় 43 লক্ষ 50 হাজার হেক্টর জমি স্থানান্তর কৃষির মাধ্যমে চাষ হয়, অবশ্য এদেশে প্রায় 6 লক্ষ 22 হাজার পরিবার স্থানান্তর কৃষির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে।
উন্নয়নমূলক কাজকর্ম :
জনসংখ্যাবৃদ্ধি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যকে শোষণ করা আরম্ভ হয়েছে। বন থেকে কাঁচামাল নেওয়া তো পরের কথা, উন্নয়ন প্রকল্পগুলি রূপায়িত হওয়ার আগে থেকেই অরণ্যবিনাশের কাজ শুরু হয়ে যায়। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বড়ো বাঁধ, জলাধার, রেললাইন পাতা, রাস্তাঘাট ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই পরিবেশের সমস্যা সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে প্রধান হল বিস্তৃতভাবে অরণ্যনিধন। এই-সমস্ত প্রকল্প পরিকাঠামো গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। কর্মী আবাসন, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি ইত্যাদি ব্যাপারগুলি তো আছেই, সেইসঙ্গে থাকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট ও অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবহার যার সামগ্রিক ফলে অরণ্যের সমূহ ক্ষতি হয়।
জ্বালানি কাঠের চাহিদা :
উন্নয়শীন দেশগুলির অধিকাংশ গ্রামে জ্বালানি হিসেবে কাঠের প্রচলন আছে। আর এজন্য বহু গাছপালা কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্বের কাঠ উৎপাদনের 54%-ই জ্বালানি। হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উন্নত দেশগুলি তাদের ব্যবহৃত কাঠের মাত্র 10% জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু উন্নয়শীল দেশে এই পরিমাণ 82%। আমাদের দেশে বছরে 30-33 কোটি মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বিপুল চাহিদার 70%-ই গ্রামাঞ্চলের, কারণ গ্রামাঞ্চলে কাঠের বিকল্প কোনো উৎসের অভাব রয়েছে। জ্বালানি কাঠের ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা মেটাতে অরণ্যাঞ্চলের ওপর ক্রমাগত চাপ পড়ছে।
শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কাঠের চাহিদা :
বাক্স, প্যাকিং বাক্স, আসবাবপত্র, দেয়াশলাই-এর খাপ, কাগজ ও মণ্ড, প্লাইউড তৈরিতে ব্যাপকহারে কাঠ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিগত কয়েক দশকে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রের প্রয়োজনে এদেশে কম করেও 3000 বর্গকিমি বনাঞ্চল পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। অরণ্যের আশপাশে, শহরাঞ্চলের কাঠগোলার কাছাকাছি এমনকি অভয়ারণ্যের ভিতরেও ট্রাকভরতি গাছের গুঁড়ি বা চেরাই কাঠের দৃশ্য আজ অতিসাধারণ। আমাদের দেশের কাগজ শিল্পে 2% কাঠ ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, মূলত চা শিল্পে ব্যবহৃত বাক্সের জোগান দিতে বর্তমানে সমগ্র অসম অরণ্যাঞ্চল থেকে এইসমস্ত সংগৃহীত কাঠের 22% ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি কাঠ আসছে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশের বনাঞ্চল থেকে। রজন, গদ, রবার, ক্ষারজাতীয় পদার্থ, ওষুধ প্রভৃতি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও অরণ্য থেকে তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আহরণ করে। এই সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে আমাদের অরণ্যসম্পদ আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
জীবিকা
অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ :
পশুজাত দ্রব্যের চাহিদার জন্য এবং পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের অর্জনের জন্য পশুচারণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসংরক্ষিতভাবে পশুচারণের ফলে বনাঞ্চলের চারাগাছগুলি ধ্বংস হচ্ছে এবং উচ্চ পাহাড়ি অঞ্চলে পশুদের চলাচলের ফলে ভূমিক্ষয় ও বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বলা যাক। পশ্চিমবঙ্গের আত্মীয় অঞ্চলে প্রায় 12 লক্ষ ভেড়া এবং ছাগল রয়েছে।
এ ছাড়া এ অঞ্চলে বছরে প্রায় 2500 যাযাবর পশুচারকের আগমন ঘটে। ভেড়া ও ছাগল ছাড়া গুজ্জর উপজাতিভুক্ত পশুচারণগণ প্রায় 5,000-7,000 মোষ পালন করে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণের ফলে এই জঙ্গলে মাথাপিছু অরণ্যের পরিমাণ 13:79 ঘনমি. (1981) থেকে কমে 2.66 ঘনমি. (2001) হয়েছে এবং বার্ষিক পশুখাদ্য প্রাপ্যতা 2.60 টন (1981) থেকে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে মাত্র 0.90 টন (2001) দাঁড়িয়েছে।
অবৈজ্ঞানিক ভাবে গাছ কাটা :
কাঠব্যবসায়ীরা অনেক সময়েই বনভূমি থেকে কাঠ আহরণের সময় সাবধানতা অবলম্বন করে না। ফলে বহু চারাগাছ ও অপরিণত গাছের ক্ষতি হয়।
পরিবেশ দূষণের প্রভাব :
পরিবেশদূষণের প্রভাবও বনভূমিকে প্রভাবিত করছে। শিল্পায়নের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে শিল্পোদ্ভব বিভিন্ন গ্যাসের প্রভাবে প্রকৃতির গ্রিন হাউস প্রভাবিত হচ্ছে, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অ্যাসিড বৃষ্টি (Acid rain)।