অরণ্যের উপকারিতা (Benefits of forests) :
কবিগুরুর উপদেশ স্মরণ করে আমাদের নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে করে অরণ্য আমাদের কী কী উপকার সাধন করে? অরণ্যের অবদানকে দুভাগে ভাগ করা চলে : প্রত্যক্ষ উপকার ও পরোক্ষ উপকার। প্রথমটিতে রয়েছে অরণ্য থেকে পাওয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রাপ্ত কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমন— কাঠ, মূল, ফুল, নির্যাস প্রভৃতি।
• বনভূমির প্রত্যক্ষ অবদান :
অরণ্যের প্রত্যক্ষ অবদান হল কাঠ, যাকে আমরা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করি। এখনও পাহাড়ি এলাকায় গ্রামের গরিব মানুষেরা কাঠকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। গৃহস্থালির জ্বালানি ছাড়াও কলকারখানায় কাঠ ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের দেশের প্রথম লোহা ও ইস্পাত কারখানাটিতে শক্তি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হত। যেসব দেশে খনিজ তেল বা কয়লার অভাব রয়েছে, সেইসব দেশে কাঠ পুড়িয়ে কাঠকয়লা (Charcol) তৈরি করা হয়। ওই কাঠকয়লার সাহায্যে ধাতব খনিজ থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হয়।
(ক) শিল্পদ্রব্য :
আসবাবপত্র, কাঠের বাড়িঘর, নৌকা, পাতলা তক্তা, প্লাইউড, ফাইবার বোর্ড তৈরির প্রধান কাঁচামাল হল কাঠ। বনভূমির প্রত্যক্ষ অবদানগুলি হল :
কাগজ শিল্পের কাঁচামাল হল কাঠ। কাঠ দিয়ে কাগজ-মণ্ড তৈরি হয় যা কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ। এ ছাড়া কাঠের মণ্ড থেকে সেলুলোজ তৈরি হয়। রেয়ন, অ্যাসিটেট প্রভৃতি তন্তুজ দ্রব্য তৈরি করতে সেলুলোজ লাগে।
• অরণ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বনজ দ্রব্যগুলি হল—
(i) রবার ও অন্যান্য আঠা :
ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকায় হেভিয়া ব্রাসিলিনসিয়া গাছ থেকে আঠা তৈরি হয়। মধ্য আমেরিকার অরণ্যের গাছের আঠা থেকে চিকল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অরণ্যের গাছ থেকে জেলুটোং পাওয়া যায়। এগুলি থেকে চুইংগাম তৈরি হয়।
(ii) রাসায়নিক শিল্পের কাঁচামাল :
সরলবর্গীয় গাছের রস থেকে পিচ, টার, রজন (Resin) ও তারপিন উৎপন্ন হয়। অসমের লখিমপুর ও শিবসাগর জেলায় ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্যের ধুনাগাছের রস থেকে ধুনো ও অগরু গাছের রস থেকে অগরু তৈরি হয়। দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় কুইয়ারকাল সুবার গাছের ছাল থেকে কর্ক তৈরি হয়।
ওক গাছ ছাড়াও হেমলক, চেস্টনাট, ওয়াটল, কুইব্রাচো গাছের ছাল থেকে ট্যানিন অ্যাসিড তৈরি হয় যা চামড়া পাকা করতে, রং করতে বা কালি তৈরি করতে ব্যবহার হয়।
(খ) ভেষজ উদ্ভিদ :
সিঙ্কোনা গাছের ছালের রস থেকে কুইনিন, কর্পূর গাছের রস থেকে কপূর পাওয়া যায়। আবার কোকেন, মরফিন, হিরোইন ও আফিমের মতো নেশার দ্রব্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া অরণ্য থেকে দারচিনি, ছোটো এলাচ ও বড়ো এলাচের মতো প্রধান প্রধান মশলা পাওয়া যায়।
(গ) খাদ্যদ্রব্য :
অনেক উদ্ভিদের ফুল, ফল, পত্র, মূল ইত্যাদি খাদ্য দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অরণ্য থেকে প্রাপ্ত ফলগুলি হল আম, বেল, কাঁঠাল, জাম, আমলকি, হরিতকী বহেড়া প্রভৃতি। শাঁসযুক্ত ফলগুলির মধ্যে চিনাবাদাম, আখরোট, নারকেল ইত্যাদি। আমলকি, তেঁতুল, ব্যাঙের ছাতা ইত্যাদিও বিভিন্নভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাল, খেজুর, মহুয়া থেকে সুরা প্রস্তুত করা হয়। রন্ধনকার্যে সুগন্ধীকারক হিসেবে তেজপাতা ব্যবহৃত হয়।
(ঘ) পত্র :
বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত নানা ধরনের পত্র বহুভাবে ব্যবহৃত হয়। তেওঁ গাছের পাতা তামাক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। আবার শাল গাছের পাতা থালা, গ্লাস, কাপ তৈরিতে কাজে লাগে।
(ঙ) তৃণ, বাঁশ ও বেত :
তৃণভূমি ও অরণ্য থেকে প্রাপ্ত নানা প্রজাতির তৃণ গবাদি পশুর খাদ্য, গ্রহাদির ছাদ তৈরির উপাদান এবং কাগজ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাবাহ, ভাবর, এলিফ্যান্ট ইত্যাদি তৃণগুলি কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া খুস তৃণ খসখস তৈরিতে, মুগ্ধ ভূল চেয়ার, টুল ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
বাঁশের ব্যবহার অনেক রকমের। বাড়ির ছাদ, মেঝে, দেয়াল, মাদুর, বিভিন্ন ধরনের পাত্র, দক্ষি প্রভৃতি তৈরির সস্তা কাঁচামাল হিসেবে বাঁশের ব্যবহার প্রচলিত। এ ছাড়া বাঁশের নরম কাণ্ড এবং বীজ খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে। বাঁশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হল কাগজ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে। বেত একটি উল্লেখযোগ্য অরণ্যজাত উপকরণ যা দড়ি, কাছি, মাদুর, ব্যাগ, ঝুড়ি, আসবাবপত্র, ছড়ি, ছাতার হাতল, খেলার সরঞ্জাম ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
(চ) প্রাণীজ দ্রব্য :
অরণ্য থেকে প্রাপ্ত প্রাণীজ দ্রব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লাক্ষা। পলাশ, পিপুল, শিশু, শিরীষ, কুল, বেড়, গুলার, কলা ইত্যাদি গাছে লাক্ষা নামে একপ্রকার কীট জন্মে যার দেহ নিঃসৃত এক জাতীয় রসই হল লাক্ষা। পৃথিবীর মোট লাক্ষা উৎপাদনের প্রায় 85% ভারতে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ওষুধ, প্লাসটিক, রং, রেশম, গালা, চামড়া, কাঠের পালিশ ইত্যাদি তৈরিতে লাক্ষা ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য প্রাণীজ দ্রব্যগুলির মধ্যে মধু, মোম, মথ, রেশম, শিং, হাতির দাঁত, হরিণের শিং উল্লেখযোগ্য।
মনে রাখতে হবে, উপরিউক্ত অরণ্যজাত দ্রব্যগুলি কোনো কোনো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। ভারতের প্রায় 35 লক্ষ মানুষ অরণ্যভিত্তিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত এবং সরকারি আয়ের প্রায় 2 শতাংশ অরণ্য থেকেই আসে।
বনভূমির পরোক্ষ অবদান (Indirect contribution of forest land) :
বনভূমি পরোক্ষভাবে মানুষের তথা বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। বস্তুতপক্ষে, অরণ্যের পরোক্ষ অবদান অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। বনভূমির পরোক্ষ অবদান গুলি হলো -
ক ভূমিক্ষয়রোধ :
বনভূমির গাছপালা মাটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে বলে বৃষ্টিপাত বা অন্যান্য কারণে মাটি সহজে ধুয়ে যেতে পারে না। ফলে ভূমিক্ষয় রোধ হয়ে থাকে। বনভূমির বৃক্ষের শিকড়ে বৃষ্টির জল প্রতিহত হয় বলে হঠাৎ নদীর জলবৃদ্ধি হয় না এবং বন্যার গতিবেগ কমে আসে।
(খ) জমির উর্বরতাবৃদ্ধি :
বৃষ্টির জল ভূমিভাগের উপরিভাগের উর্বর মৃত্তিকাকে ধুইয়ে বনভূমির বাইরে নিয়ে যেতে পারে না কারণ, মাটি ধুয়ে গাছের শিকড়ে আটকে যায়। এ ছাড়া গাছের পাতা ইত্যাদি মাটিতে পড়ে ও পচে মাটির উর্বরাশক্তি বাড়ায়।
(গ) জলবায়ু-নিয়ন্ত্রণ :
উঘ্ন ও শীতল উভয় প্রকার বায়ুপ্রবাহের তীব্রতাকে অরণ্য প্রশমিত করতে সাহায্য করে। অরণ্য বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে তাড়িত (blown) ধুলোবালির হাত থেকে খেতের ফসলকে রক্ষা করে। মরুভূমির প্রসার রোধ করে। অরণ্যকে বলা হয় প্রাকৃতিক স্প (natural sponge) 1 অধিক বৃষ্টিপাতের সময়ে গাছেরা অতিরিক্ত জল ধরে রাখতে পারে এবং বৃষ্টিহীন সময় ওই ধরে রাখা জলের সাহায্যে গাছ আশেপাশের আবহাওয়ার শুষ্কতা দূর করতে সাহায্য করে। অরণা আবহাওয়াকে এভাবে সমভাবাপন্ন রাখতে সহায়তা করে।
গাছপালার অধিক জলধারণ ক্ষমতা আছে বলে অরণ্য প্লাবন রোধ করতে পারে ও প্লাবনের তীব্রতা কমাতে সক্ষম হয়।
অরণ্য জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুপ্রবাহের ঘনীভবন করে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে ।
(ঘ) মরুভূমির বিস্তার রোধ করা :
মরু অঞ্চলের বালুকণাগুলি বায়ুতাড়িত হয়ে পর্য পরিবাহিত হয়। এভাবে মরুভূমি বিস্তারলাভ করে। উদ্ভিদের মূল বালুকণাগুলিকে দৃঢ়ভাবে আবদ রাখে এবং বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে অন্যত্র পরিবহণে বিশেষভাবে বাধা প্রদান করে। সুতরাং, অরণ্য মরুকরণ (desertification) প্রক্রিয়াকে মন্দীভূত করে। তা ছাড়া দীর্ঘকাল ধরে অরণ্যের অবস্থানের ফলে বায়ুমণ্ডল জলীয় বাষ্পযুক্ত হয় এবং মরু অঞ্চলের আবহাওয়ার শুষ্কতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।
(ঙ) পরিবেশদূষণরোধ :
পরিবেশদূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে অরণ্যা অপরিহার্য। বর্তমান নগরসভ্যতার কুফলে আমাদের চারপাশে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ অতিমাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। অধিক সংখ্যক গাছ লাগালে এই অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। আর পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে পারি।
(চ) পশুর আবাস :
অরণা পশুর আবাস। অরণ্যের পশুপাখি অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। মানুষের খাদ, পোশাক প্রভৃতি তৈরি করার ক্ষেত্রে পশুসম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। অরণ্যে পশুশিকার মানুষের অন্যতম পেশা ও নেশা। বর্তমানে গড়ে তোলা অভয়ারণ্যে পশুশিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অভয়ারণাগুলি প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করে। পর্যটকদের কাছ থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব আদায় করে থাকে।
(ছ) আদিবাসীদের আবাস :
ভারতের প্রায় 25 লক্ষ আদিবাসী অরণ্যে বসবাস করে। জাইরে অববাহিকা, আমাজন অববাহিকার অরণ্যে অনেক আদিম অধিবাসী বাস করে।
(জ) আধ্যাত্মিক পরিবেশ :
প্রকৃতির সঙ্গ লাভ করে মানুষ এক সহজাত আনন্দ পায়। তাই অরণ্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি, বায়ু ও কোলাহল মুক্ত আধ্যাত্মিক পরিবেশ দেশ-বিদেশের সৌন্দর্য পিপাসুদের মানসিক ক্ষুধা নিবারণ করে। অরণ্যের সান্নিধ্যে মানুষের জীবনীশক্তি বাড়ে। এজন্য স্বাস্থ্য নিবাস (Sanitorium), পর্যটক কেন্দ্র (tourists centre) প্রভৃতি অভয়ারণ্যগুলিতে গড়ে উঠেছে।