ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিণতি (Consequences of regional disparities in India)
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিণতি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এখানে ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হল—
1 সমষ্টিগত ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি (Increasing Aggregate Imbalance) :
আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি দেশের সমৃদ্ধ ও পশ্চাদ্পর এলাকাগুলিতে সমষ্টিগত ভারসাম্যহীনতার বিষয়টিকে যথেষ্ট প্রকট করে তুলেছে। ইংরেজ শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ আমল থেকে ভারতের যে সমস্ত এলাকা প্রবৃদ্ধির মূল কেন্দ্রবিন্দুরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সুবাদে উন্নয়নের পর্যাপ্ত পরিকাঠামোগুলি প্রায় পুরোটাই সেখানে ঢলে পড়েছে। ফলে, জীবনযাত্রার মান থেকে শুরু করে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, উন্নয়নের প্রতিটি সূচকেই স্বল্পোন্নত এলাকাগুলির সমষ্টিগত ভারসাম্যহীনতা ক্রমশ ভয়াবহ আকার পেয়েছে। উদাহরণ- স্বরূপ, মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর এবং হায়দ্রাবাদের মতো মেট্রোপলিটন শহরগুলির সাথে দেশের অন্যান্য মেট্রো শহর বা আধুনিক জনপদগুলির সমষ্টিগত ভারসাম্যহীনতা যথেষ্ট বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।
2 অনুন্নত অবকাঠামো (Underdeveloped infrastructure):
আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতা এবং অনুন্নত পরিকাঠামোর স্তরটি ভারতের মতো দেশে একে অপরের পরিপুরক। কারণ, আমরা দেখেছি দেশের যে অঞ্চলগুলিতে পরিকাঠামোগত খাতে অধিক ব্যয় করা হয়েছে, তারাই একমাত্র উন্নতিতে শীর্ষস্থান অর্জন করতে পেরেছে। অন্যদিকে, পরিকাঠামোগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির উন্নয়ন চিরকালই বিভিন্নভাবে ব্যাহত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমানে পরিকাঠামোগত দিক থেকে গুজরাট, মহারাষ্ট্রের তুলনায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য অনেকটাই পিছনে রয়েছে।
3 ধনী-দরিদ্র্যর মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি (Big gap between rich and poor) :
আঞ্চলিক বৈষম্য দেশে ধনী- দরিদ্রদের মধ্য আর্থসামাজিক ব্যবধান আগের তুলনায় যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা খুবই সত্য যে, আমাদের দেশের আঞ্চলিক বৈষম্য অধিকাংশ মানুষের কাছে চরম অভিশাপ হলেও, কিছু কিছু মানুষ আবার এই অবস্থার থেকে বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন, ভারতের যে অঞ্চলগুলিতে বৈষম্যের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, সেখানে যে কোনও ব্যবসার করে ধনীরাই সবচেয়ে লাভবান হয়। ঠিক এই কারণেই 2010-2020 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে বেশ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আয় সবচেয়ে দ্রুত হারে বেড়েছে।
4 মর্যাদাহানি ( Loss of dignity) :
আমাদের দেশের বেশ কিছু রাজ্যের আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিস্থিতি শেষ তথা আন্তর্জাতিক স্তরে আর্থসামাজিক মর্যাদাকে ভীষণভাবে বিনষ্ট করেছে। এপ্রসঙ্গে, বিগত শতকের আশির থেকে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশকে একত্রে “BIMARU” রাজ্যরুপে চিহ্নিত করা এরকমই একটি নেতিবাচক ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
5 আবাসন সমস্যা ( Housing problem):
ভারতের মতো জনবহুল দেশে ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বৈষম্য আবাসন সমস্যাকে আরও চরম করে তুলেছে। বিশেষ করে, দেশের কয়েকটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে কর্মসংস্কৃতির পরিবেশ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে পড়ায়, বেশিরভাগ মানুষ আধুনিক পরিসেবা ও নিশ্চিত কর্মকেন্দ্রিক সুযোগসুবিধার আশায় * অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু তথা প্রধান শহরগুলির জনঘনত্বকে রুমশ বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের মুম্বাই, কলকাতা, নয়া দিল্লি প্রভৃতি মহানগরে একজায়গায় অধিক মানুষের মিরিভাবে বসবাসনীতিতে সৃষ্টি সেখানকার আবাসনের সমস্যা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
6 দূষণসৃষ্টি (Causing Pollution) :
ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্য দেশের ক্রমবর্ধমান দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে । বিশেষ করে, দেশের অধিকাংশ বড়ো শহরগুলিতে অধিক চনকেন্দ্রীভবন এবং শিল্পায়ন সংক্রান্ত ঘটনা স্থানীয়ভাবে জল তুলা, মাটি দূষণ,বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে । এইভাবে, দূষণের নিরিখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলিকে সংকটজনক বা প্রায় স্থিতিশীল দূষক পরিসররূপে চিহ্নিত করা গেছে। নয়াদিল্লি, মুম্বাই চেন্নাই এবং হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি শহর কেন্দ্রীভূ ত অর্থনীতির কারণে দূষণজনিত সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত।
7 পরিধান বৃদ্ধি (Increasing migration) :
ভারতের বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো একটি বোঝাস্বরূপ। বিশেষ করে, রাজ্যগুলিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য সেখানকার বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাকে আন্তঃরাজ্যমধ্যস্থ পরিযানে যথেষ্ট উৎসাহ বাড়িয়েছে। তাছাড়া, কর্মসংস্থানের নিরিখে ভারতের শহরাঞ্চলগুলি বরাবরই গ্রামাঞ্চলের নিরিখে এগিয়ে থাকায়, অনগ্রসর গ্রামগুলি থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ তাদের পরিযানের মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
জাতিসংঘ (UN)-এর মতে আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে দেশের কর্মরত মোট জনসংখ্যার সাথে নতুন করে আরও 300 মিলিয়নেরও বেশি পরিযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের সংযোজন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ঘিরে বৃদ্ধি পাবে। তখন, দেশে কর্মশক্তির বিপুল জোগান থাকলেও, কর্মসংস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও গভীরতর হয়ে উঠবে।
সম্প্রতি, COVID-19 পরিস্থিতিতে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় দেশের বিপুল জনসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে অথবা নতুন কাজের আশায় পরিযায়ী শ্রমিকরূপে প্রায় 300-1200 কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পদব্রজে, নয়তো বা সাইকেলে করে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।
8 জনসম্প্রদায়গত হতাশা সৃষ্টি (Public frustration):
ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এখানকার উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীকে মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। বিশেষ করে, পশ্চিম ভারতের শিল্পোন্নত অর্থনীতি, দক্ষিণ ভারতের পরিসেবাভিত্তিক অর্থনীতি, উত্তর ও উত্তর-পূর্বের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অনগ্রসর এলাকার শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানকে ঘিরে হতাশা দেশের বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।
9 সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা (Social discomposure):
দীর্ঘ আঞ্চলিক বৈষম্যের যোগসূত্রগুলি ভারতে মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা ন্যায়পরায়ণতার মতো সামাজিক বন্ধনকে বহুকাল আগেই ঢিলে করে দিয়েছে। এই ধরনের প্রতিকূলতা দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের মাঝে দাঁড়িয়ে অবহেলিত অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষকে প্রা কোণঠাসা করে তোলায়, তাদের অনেকেই সমষ্টিগত উন্নয়নের সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা উভয়ই আজ ভুলতে বসেছে।
এরফলে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবন আরও অস্থির ও সংকটময় হয়ে উঠেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক বৈষম্যের বহুমুখী প্রেক্ষাপটে নকশালবাদ চরম সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছিল।
10 অন্তঃরাজ্য এবং আন্তঃরাজ্য আন্দোলন ( Interstate and intrastate movements) :
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বা ভারসাম্যহীনতা একাধিক সময় আমাদের দেশে বিভিন্ন আন্তঃ এবং অন্তঃরাজ্যগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী জনআন্দোলনকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। যেমন-আসাম রাজ্যের উচ্চশিক্ষার প্রসারে ব্যর্থতা, শিল্পায়ন না হওয়া এবং কর্মসংস্থানের প্রতিবন্ধকতার নিরিখে সেখানকার বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়নের হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত যুবক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে একাধিক গণআন্দলনে লিপ্ত থেকেছে। বস্তুত, এদের দীর্ঘ আন্দোলন মূলত সেখানকার আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেই।
অন্যদিকে, 1969-2014 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের বিক্ষুব্ধ জনজাতি সেখানকার আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে পৃথক “ তেলেঙ্গানা” রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়ে এসেছিল। সেই দাবিটিকে পরবর্তীকালে মান্যতা দিয়ে 2014 খ্রিস্টাব্দের 2 জুন অন্ধ্রপ্রদেশের 33টি জেলা নিয়ে নতুন তেলেঙ্গানা রাজ্যটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।