স্থানান্তর কৃষি (Shifting Cultivation)
• সংজ্ঞাঃ
যে ভ্রাম্যমান কৃষি ব্যবস্থায় অনুন্নত জনগোষ্ঠী প্রাচীন পদ্ধতিতে জীবিকার প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করে এবং এই ফসল উৎপাদনের জমি নির্বাচনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়, সেই কৃষিব্যবস্থাকে স্থানান্তর কৃষি বা অস্থায়ী ভ্রাম্যমান প্রাচীন কৃষিব্যবস্থা বলে।
• অবস্থানঃ
ক্রান্তীয় অঞ্চলের আমেরিকা মহাদেশ, মধ্য আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। ভারতে উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুম চাষ (Jhum cultivation ) এই স্থানান্তর কৃষিরই অন্তর্গত।
স্থানান্তর কৃষির বৈশিষ্ট্যঃ
কৃষি পদ্ধতিঃ
এই কৃষিব্যবস্থায় সম্প্রতি পরিষ্কৃত জমিতে দু'তিন বছর একাদিক্রমে ফসল উৎপাদন করে ভ্রাম্যমান কৃষক গোষ্ঠী একটি কৃষিজমি ছেড়ে অপর একটি কৃষিযোগ্য জমির জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে (Slash and Burn Cultivation) এই ছাই মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে চাষ করে। একে স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ণ কাল্টিভেশনও বলে। তবে প্রকৃতপক্ষে এতে কিছু পটাশ যুক্ত হলেও জমির জৈব পদার্থ নষ্ট হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢালু জমিগুলো বনভূমি বা ঘাস জঙ্গলে ঘেরা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করে। বর্ষাকালের আগে চারা রোপণ বা বীজ বপন করা হয়, যাতে বর্ষার জলে সেগুলো নষ্ট না হয়।
উৎপন্ন ফসল:
ধান, ভুট্টা, বাজরা, বিন, কলা, কুমড়ো, আখ, ম্যানিওক প্রভৃতি ফসল স্থানান্তর কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদিত হয়। ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধান, মধ্য আমেরিকায় ভুট্টা, আফ্রিকায় মিলেট প্রধানত জন্মায়।
ও যন্ত্রাদিঃ কৃষি-পদ্ধতির মতো কৃষি যন্ত্রাদিও পুরোপুরি দেশীয় ও প্রাচীন। জমিকর্ষণ, ফসল কাটা, পণ্য পরিবহনে পেশিশক্তিই মুখ্য অবলম্বন। ব্যবহৃত যন্ত্রাদির মধ্যে আছে কাঠ ও লোহার তৈরি লাঙ্গল, কোদাল, কাস্তে, নিড়ানি ও কুঠার।
● ভ্রাম্যমানতাঃ
বর্ষার জলে ভেজা মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে গাছ পুষ্ট হয়। মাটিতে যে সামান্য খাদ্য যুক্ত হয় তার সাহায্যে ২-৩ বছরের বেশি ফসল ফলানো যায় না। এজন্যে খাদ্যের অভাবে জনবসতি বৃদ্ধি পায় না। জনগোষ্ঠী নতুন জমির সন্ধানে অন্যত্র চলে যায় এবং ‘স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ণ' পদ্ধতিতে অর্থাৎ জঙ্গল কেটে ও পুড়িয়ে পুনরায় কৃষিকার্য শুরু করে। সেখান থেকে ২-৩ বছর পর পুনরায় অন্যত্র চলে যায়। এভাবে কয়েকবার স্থানান্তরে যাওয়ার পর পুনরায় আগের জমিতে ফিরে আসে।
ও অবৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থাঃ বনভূমি কেটে পরিষ্কার করায় বৃক্ষহীন হয়; মাটির শিকড় আলগা হয়ে দ্রুত মৃত্তিকা-ক্ষয় হয়। এর ফলে বন্যা প্রবণতা বাড়ে। গাছের পোড়া ছাই-এ উর্বরতা সাময়িকভাবে সামান্য বাড়লেও জৈব পদার্থ পুড়ে যাওয়ায় বস্তুত মাটির ক্ষতিই হয়। এই কৃষি ব্যবস্থাকে এজন্যে অবৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করা হয়।
কৃষকের শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাবঃ
বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব ঘটে।
জীবিকা-সত্ত্বাভিত্তিক উৎপাদনঃ
কোনো উদ্বৃত্ত ফসল থাকে না। জনগোষ্ঠীর খাদ্যের অভাব মেটানোই কষ্টসাধ্য। কৃষিপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কাজকর্ম এখানে তেমন গড়ে উঠতে পারে না।
• উপজাতীয় সমাজ ব্যবস্থায় গোষ্ঠীগত শ্রমঃ
সাধারণত ভ্রাম্যমান উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পরিচালিত এই কৃষিব্যবস্থায় ব্যক্তিগত শ্রম-এর বদলে গোষ্ঠীর সদস্যগণ মিলিতভাবে শ্রমদান করে উৎপাদনকার্যে নিয়োজিত হন।
গোষ্ঠীগত অধিকার:
সাধারণত জমির ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। জমি উপজাতির গোষ্ঠীগত অধিকারে থাকে। উৎপন্ন ফসল গোষ্ঠীর সদস্যগণের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
বিচ্ছিন্ন কৃষিব্যবস্থা:
মূল জনবসতি থেকে দূরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় এর অবস্থান।
নামভেদে স্থানান্তর কৃষিঃ
স্থানান্তর কৃষি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিভিন্ন নামে এই কৃষি হলঃ
'ঝুম' (Jhum) চাষ উত্তর-পূর্ব ভারতে ও বাংলাদেশে। 'চেনা' (Chena) শ্রীলঙ্কায়। 'লাদাঙ’ (Ladang) মালয়েশিয়ায়। 'হুমা' (Huma) ইন্দোনেশিয়ায়। 'কেইনজিন' (Caingin) বা ‘সুইডেন’ (Swidden) ফিলিপিনে। 'অঙ্গিয়া' (Tangya) মায়ান্নারে। 'তামরাই' (Tamrai) থাইল্যান্ডে। ‘রোকা’ (Roca) ব্রেজিলে। ও ‘কোনুকা' (Conuca) ভেনেজুয়েলায়। ‘মিল্পা' (Milpa) মধ্য আমেরিকায়।