সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Mangrove forests of Sundarbans)
সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘন বনভূমিতে আবৃত। ইহার এক বৃহৎ অংশ সংরক্ষিত অরণ্য। ম্যানগ্রোভ অর্থাৎ লবণাক্ত জলাভূমির অরণ্যের জন্য সুন্দরবন অঞ্চল বিখ্যাত। সুন্দরী গাছ থেকে এই বনের নামকরণ মনে করা হলেও সুন্দরী বৃক্ষ কাঠের জন্য কেটে ফেলায় এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন।
সুন্দরবন নাম কেন ?
একটি মত ‘সুন্দর বন' অর্থাৎ বনভূমির সৌন্দর্যের জন্য সুন্দরবন। অপেক্ষাকৃত প্রচলিত মতটি হল সুন্দরী বৃক্ষ থাকায় এই বনের নাম সুন্দরবন হয়েছে
জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম কী ?
সুন্দরবনের কতগুলো উদ্ভিদ যেমন, গরান, গর্জন প্রভৃতির বীজ-এর অঙ্কুরোদগম হয় ফলের মধ্যেই। ফল ফেটে জলসিক্ত মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এইজন্য একে জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম বলে। ফলে এই উদ্ভিদগুলো মাটিতে তাড়াতাড়ি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। বীজ জলে ডুবে নষ্ট হওয়া বা ভেসে যাওয়া আটকাতে বৃক্ষের এরূপ অভিযোজন ঘটে।
• ম্যানগ্রোভ বা লবণাম্বু উদ্ভিদের অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য :
(i) শ্বাসমূল :
অনেক উদ্ভিদ যেগুলি কর্দমাক্ত এবং জলমগ্ন জমিতে বেড়ে ওঠে, যেমন, কেওড়া, বাইন প্রভৃতি বৃক্ষের শ্বাসমূল থাকে। একে নিউম্যাটোফোর (Pneumatophore) বলে। জোয়ারের জ্বলে প্লাবিত হলেও এই শ্বাসমূল জলের ওপরে উঠে থাকে বলে উদ্ভিদ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে।
(i) ঠেসমূল ঃ
কর্দমাক্ত নরম মৃত্তিকায় জন্মানো উদ্ভিদ যাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেজন্য গাছের ঠেসমূল থাকে। ঠেসমূল উদ্ভিদের মূলকাণ্ড থেকে বেরিয়ে মাটিতে নেমে আসে।
উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ঃ সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গর্জন, হেতাল, কেওড়া, পাশুর, ধুধুল, হোগলা, বেত এবং অন্যান্য বিভিন্ন বৃক্ষ, ঘাস ও কাঁটাজাতীয় উদ্ভিদ ও লতাগাছ জন্মে। সুন্দরী সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বৃক্ষ। কারণ এটি শক্ত, টেকসই এবং সুন্দর পালিশ ধরে বলে বাসগৃহ ও আসবাবপত্র নির্মাণে এর যথেষ্ট চাহিদা আছে। গরান ও গর্জন গাছের ছাল চামড়া ট্যান করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই গাছের কাঠ জ্বালানী, স্থানীয় অধিবাসীদের বাসগৃহের কাঠামো তৈয়ারিতে ব্যবহৃত হয়। গেঁওয়া কাঠ দিয়াশালাই বাক্স ও প্যাকিং বাক্স তৈয়ারীতে ব্যবহৃত হয়।
সুন্দরবনের বনভূমি সংরক্ষণ প্রসঙ্গ :
ভারতবর্ষের একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১০৬ দ্বীপ ক্রান্তীয় বনভূমি, লবণাক্ত জলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিলুপ্ত হতে বসেছে বেশ কিছু প্রজাতির বৃক্ষ। সুন্দরী বৃক্ষ বর্তমানে প্রায় বিরল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ক্ষতি হয়েছে। আয়লার মতো ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের অনেকখানি ক্ষতিসাধন করেছে। সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তন সুন্দরবনের জীব বৈচিত্রে প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে। মনে করা হয় সমীক্ষালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে সুন্দরবনের জলস্তর সমুদ্রের জলপৃষ্ঠ উপরে উঠছে এবং বেশ কয়েকটি দ্বীপ সুন্দরবনে জলে দ্বীপ আংশিকভাবে বা পুরোপুরি জলের তলায় চলে গেছে।
এই জলপৃষ্ঠ বৃদ্ধি সুন্দরবনের বনভূমি এবং জীব বৈচিত্র্য হ্রাসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ক্ষতি সাধন করছে। এছাড়া চোরাই কাঠ কারবারীদের উপদ্রবে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। সুন্দরবনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। গ্রামীণ জনসংখ্যার বন সংরক্ষণে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে। বনকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং তাদেরকে বন সংরক্ষণে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
গরান, গেউয়া, গর্জন, কেওড়া এখানকার প্রধান বৃক্ষ। প্রচুর হোগলা ও গোলপাতা জন্মে। এই বনভূমি পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার-এর বিচরণ ক্ষেত্র।