ভারতের জাত বা বর্ণ ব্যবস্থা (Caste system of India)
ভূমিকা ঃ
জাত বা বর্ণগত শ্রেণীবিভাগ ভারতের সামাজিক পরিকাঠামোর অঙ্গ হিসেবে বৈদিক যুগ থেকেই চলে আসছে। একটি মানুষের সামাজিক অবস্থান, তার সামাজিক সম্পর্ক, আচরণ কিরূপ হবে তা অনেকাংশে নির্ণীত হয়েছে সে কোন জাতিতে জন্মগ্রহণ করেছে তার দ্বারা। তার সামাজিক আন্তঃসম্পর্ক ও সামাজিক ক্রিয়ায় জাত ব্যবস্থা তথা সে কোন জাতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে তা তার সমগ্র জীবনকে প্রভাবিত করত।
জাত বা বর্ণ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঃ
জাত ব্যবস্থা শুরু হয় আর্যদের ভারতবর্ষে আগমনের পরে। তথাকথিত অনার্যগণ ভারতের প্রাচীন অধিবাসী। তারা বনে জঙ্গলে সংগ্রহ, তৃণভূমিতে পশুচারণ করে মূলত জীবিকা অর্জন করতেন। সীমিতভাবে প্রাচীন প্রথায় কৃষিকাজও করতেন। পরবর্তীকালে আর্যরা অধিক সংখ্যা আগমন করলে অরণ্য কেটে তৃণভূমি পরিষ্কার করে উর্বর জমিগুলিকে কৃষিকাজের অধিনে নিয়ে আসেন। ফলে প্রয়োজন হয়। প্রচুর শ্রমশক্তির। এভাবে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে যে সমাজ ব্যবস্থায় শুধু খাদ্য ফসল উৎপাদনই নয়, তার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন চাহিদার জন্য শ্রম শক্তির প্রয়োজন হয়। আর্যগণ জ্ঞানী এবং যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায় তারা সহজেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন অংশে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করে এবং অন্যান্য অধিবাসীদের উপর তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে শুরু করে। তৈরি হয় বর্ণভেদ। এই বর্ণভেদ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত। এছাড়াও এই বর্ণের বাইরে যারা রয়েছেন তাদের বলা হয় নমঃশূদ্র এবং যারা অপরিচ্ছন্ন কাজ করবে বলে তাদেরকে বলা হয় অস্পৃশ্য। এরা মৃতদেহ সৎকার, পশুর চর্ম সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ অথবা সমাজে মানুষের পরিত্যাজ্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে বাসস্থানকে পরিষ্কার রাখবেন। এভাবে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস জাতপাতের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে বহু যুগ আগে থেকেই, বলা হয় সেই বৈদিক যুগ থেকেই।
বর্ণভেদের শ্রেণী বিভাজনটি এরূপ—
১. ব্রাহ্মণ, যারা ধর্মাচারণ করবেন এবং পৌরহিত্য করবেন। ২. ক্ষত্রিয়, যারা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী তারা যুদ্ধ বিগ্রহে অংশগ্রহণ করবেন এবং প্রজা পালন করবেন। ৩. বৈশ্য, যারা ব্যবসা, বিপণন গো-পালন ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থাকবেন। ৪. শূদ্র, এরা মূলত কৃষিজীবি ও সমাজের উচ্চতর বর্ণকে পরিষেবা প্রদানকারী জনসাধারণ। এছাড়া এর বাইরে রয়েছে ৫ নমঃশূদ্র, যারা উপরের সমস্ত জাতিগত মানুষদের ভিন্নতর পরিষেবা দেবেন যেমন মৃতদেহ সৎকার, মৃত পশুর চর্ম সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ, আবর্জনা তথা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবেন, এরূপ জনজাতিকে অপরিচ্ছন্ন ও অস্পৃশ্য বলে সমাজের থেকে দূরে রাখা হতো অথচ সমাজে তাদের প্রয়োজন অনিবার্য ছিল এবং আছে। শুরু থেকে জাতিপ্রথাকে শ্রমবিভাজনের ভিত্তি ধরা হত কিন্তু পরে তা সামাজিক শ্রেনীবিভাজন এবং সামাজিক সুবিধাভোগী শ্রেণীদের স্তরবিন্যাসে উপনীত হয়। এই জাত পাত উত্তরাধিকারসূত্রে চলে আসে এবং সামাজিক সুবিধাভোগের অগ্রতাকে মান্যতা দিয়ে এসেছে।
বাসস্থান বিস্তারে প্রভাব ঃ
গ্রামাঞ্চলে বাসগৃহ কোথায় হবে, গ্রামীণ বসতি বিন্যাসে এই জাতপাত ব্যবস্থার প্রভাব দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত উচ্চতর জমিতে বা অপেক্ষাকৃত উর্বর জমিতে বাস করবেন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা; তারথেকে কিছুটা দূরে বাস করবেন বৈশ্য বা বিপননকারী ও কৃষিজীবী অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন মানুষেরা; আর আরো দূরে নিম্নভূমিতে অথবা পতিত জমিতে অথবা অনুর্বর জমিতে বাস করবেন নমশূদ্ররা। এইভাবে বসতি বিন্যাস হয় এবং জাত পাত ধরে গ্রামগুলির নামকরণও হয়, যেমন কায়স্থ পাড়া, যুগিপাড়া, তেলিপাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
জাত প্রথা ও ভূমিস্বত্ব ভূমির মালিকানা মূলত উচ্চতর বর্ণের হাতে। উর্বর এবং প্রচুর ভূমির মালিকানা থাকে উচ্চতর বর্ণের ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদের হাতে এবং প্রান্তিক কৃষিজীবী ও ভূমিহান খেতমজুর হন শূদ্র বা শূদ্রতর গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন।
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা (Feudal System) :
সাধারণত উচ্চ বর্ণের হাতে থাকে। সামন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থার জমির মালিকানা অধিকাংশই উচ্চবর্ণের হাতে থাকে। ভূমিহীনরা এই উচ্চ বর্ণের জমিতে কাজ করেন অর্থাৎ ভূ মিহীনরা বা নিম্নবর্ণের মানুষেরা উচ্চবর্ণের জমিতে পরিষেবা দিয়ে থাকেন এবং তাদের জীবনযাত্রা সাচ্ছন্দপূর্ণ হওয়ার জন্য অন্যান্য পরিষেবা প্রদান করেন।
ব্রাহ্মণ :
ব্রাহ্মণ সমাজের উচ্চতম বর্ণ। যদিও কর্মের দিক থেকে এরা ধর্মাচারণ করবেন, পৌরহিত্য করবেন, এদের কিন্তু একটা সময় রাজার বদান্যতায় ভূমির পরিমাণ প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে সকলের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ব্রাহ্মনগণ বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন পদবী গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেরালায় নামবুদ্রি; তামিলনাড়ুতে আয়ার, আইঙ্গার; কাশ্মীরে পণ্ডিত, ভাট, ধার; গুজরাটে উপাধ্যায়; অসমে বেজবরুয়া, রামবরুয়া ইত্যাদি, পশ্চিমবঙ্গে চ্যাটার্জী, মুখার্জী, ব্যানার্জি, ভট্টাচার্য ইত্যাদি; বিহারে মিশ্র, ঠাকুর ইত্যাদি; ওড়িশায় মিশ্র, সৎপতি, সামস্ত ইত্যাদি; মহারাষ্ট্রে দেশমুখ, দেশপান্ডে, ফার্ণর্ভিস ইত্যাদি; উত্তরাখণ্ডে দিক্ষিত, দুবে, দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদী, তিওয়ারী, বাজপেয়ী ইত্যাদি; মণিপুরে ব্রাহ্মণদের সামগ্রিকভাবে বামন বলা হয়। এছাড়া অন্যান্য রাজ্যে অন্যান্য নামে ব্রাহ্মনরা পরিচিত। ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় এবং প্রায় ১৬ শতাংশ ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়।
ক্ষত্রিয় ঃ
ক্ষত্রিয়গণ প্রজা পালন করবেন, যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনা করবেন। ক্ষত্রিয়গণ ও ব্রাহ্মণগণ মিলে রাজ্য শাসন করবেন এবং এদের অধীনস্থ থাকবেন সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর লোক। ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় মিলে। ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যার প্রায় কুড়ি শতাংশ বা ১/৫ ভাগ। এদের মধ্যে ব্রাহ্মন প্রায় ৪ শতাংশ ও ক্ষত্রিয় প্রায় ১৬ শতাংশ। এই ২০ শতাংশ মানুষ সমাজের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষকে পরিচালনা করবেন। তাদের পরিষেবা প্রদানে নিয়োজিত করবেন। ক্ষত্রিয়গণ বাহুবলী হওয়ায় ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ায় তারা রাজা জমিদার সামস্ত ইত্যাদি ভূমিকা পালন করতেন এবং প্রজা শাসন করতেন, ফলে তারা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হন এবং প্রচুর ভূমির মালিকানা তাদের হাতে থাকে।
বৈশ্য ঃ
ব্রাহ্মন ও ক্ষত্রিয়দের পরেই বৈশ্যদের স্থান। এরা মূলত পশুপালক, ধাতব দ্রব্য উৎপাদনকারী, সম্পন্ন কৃষিজীবি ইত্যাদি এবং উক্ত কর্মে নিয়োজিত থাকেন। বৈশ্যগণ সমাজে মাঝারী অবস্থান পেয়ে থাকেন। এরা সমাজের উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মধ্যেখানে অবস্থান করেন।
শূদ্র ঃ
মূলতঃ কৃষিজীবী সম্প্রদায় শূদ্রগণ। এরা সমাজে পরিষেবা মূলক কাজকর্ম প্রদানে নিয়োজিত। শূদ্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় জাঠ সম্প্রদায়, বিহারে ভূমিহার, অন্ধ্রপ্রদেশে রেড্ডি, পশ্চিমবঙ্গে মাহিষ্য ও কর্ণটিকে ভেন্নালা সম্প্রদায় ইত্যাদি।
নমশূদ্র ঃ
সমাজে যা অন্যরা করবেন না, নিকৃষ্টতম কাজ বলে বিবেচিত হয়, সেই কাজগুলো সমাজে নমশ প্রদের জন্য পরে থাকে। তারা একসময় অস্পৃশ্য (Untouchables) হিসেবে পরিচিত হতেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে চামার, পশ্চিমবঙ্গে চণ্ডাল, গুজরাটে মেঘ, অন্ধ্রপ্রদেশে মাল, মহারাষ্ট্রে মাহার, তামিলনাড়ুতে আদি দ্রাবিড় ইত্যাদি সম্প্রদায়।