welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

সাঁওতাল (Santal)

ভারতের উপজাতিদের মধ্যে সাঁওতালরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। সাঁওতাল শব্দটি এসেছে সাওয়ানতার থেকে। এই নাম তারা এদেশে আসার পরও ব্যবহার করত।

 

ভূমিকা (Introduction) :

ভারতের উপজাতিদের মধ্যে সাঁওতালরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। সাঁওতাল শব্দটি এসেছে সাওয়ানতার থেকে। এই নাম তারা এদেশে আসার পরও ব্যবহার করত। কারো কারো মতে, মেদিনীপুর সংলগ্ন সামন্তভূমি বা সাওস্ত দেশে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করার দরুন এরা সাওস্তার বা সাঁওতাল নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে সাঁওতালদের অধিকাংশই সাঁওতাল পরগনার আশেপাশে বাস করে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি নানা বৈচিত্র্যে ভরা।


 একদিকে পশ্চিমে রয়েছে ঝাড়খন্ডের রুক্ষ ঢেউ খেলানো ভূমিভাগ, আর একদিকে (পূর্বে) পলিময় সমভূমি। এই বিস্তীর্ণ ভূভাগে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বাঁচার তাগিদে ব্যাপকভাবে মিশে গেছে।

1 বাসস্থান (Habitat )

 বিহার সাঁওতাল পরগনা, ঢাকা, মুঙ্গের, ভাগলপুর, হাজারিবাগ, পূর্ণিয়া, মানভূম, সিংভূম, ওডিশার ময়ূরভঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, মালদা, উত্তরবঙ্গ ও অসমের চা বাগানগুলিতে সাঁওতালরা বাস করে।

2.নৃতাত্ত্বিক পরিচয় (Ethic identity)

জাতি তত্ত্বের বিচারে সাঁওতালরা দ্রাবিড়ো গোষ্ঠীর বংশধর, যাদের মূল উৎস অস্ট্রে-এশিয়াটিক নৃতাত্ত্বিক পরিবার।

3.সম্প্রদায় (Community)

সাঁওতালদের সমগোত্রিয় কয়েকটি সম্প্রদায় হল—হর, মাজি, সাতার, হোস, খারিয়া প্রভৃতি।

4.দৈহিক গঠন (Physical form)

(i) সাঁওতালরা মধ্যম আকৃতির, (ii) দেহ পেশিবহুল, (ii) দেহের বর্ণ মিশমিশে কালো (iv) ঠোঁট পুরু ও লম্বা, (v) অনুচ্চ কপাল ও নীচু মাথা, (vi) চুল ঢেউ খেলানো ও কোঁকড়ানো (Fizzly) প্রকৃতির। প্রসঙ্গত, বোড়িং সাঁওতালদের সাথে নিগ্রোদের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন।

5.প্রকৃতি (Nature)

সাঁওতালরা অত্যন্ত সহজ-সরল এবং কর্মঠ প্রকৃতির।

6. ভাষা (Language)

সাঁওতালদের প্রধান ভাষাগুলি হল সাঁওতালি, ওড়িয়া, বাংলা, হিন্দি প্রভৃতি।

7.ধর্ম (Religion)

সাঁওতালরা মূলত সাঁওতালি ধর্মের 'মারাঙ বুড়ু' দেবতার উপাসক। তবে, হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সাঁওতালও পরিলক্ষিত হয়।

8. প্রধান জীবিকা (Main occupation)

সাঁওতালদের প্রধান জীবিকাগুলি হল কৃষিকাজ, শিকার, পশুপালন প্রভৃতি।

সাঁওতাল জনসম্প্রদায়ের স্বাভাবিক অভিযোজন (Natural adaptation of Santal Community) :

 অর্থনীতি ( economic): 

সাঁওতালরা প্রধানত কৃষিকাজ করেন। জমিকে ব্যবহার করতে এদের সমকক্ষ জাতি খুব কম দেখা যায়। নিজেদের আশেপাশের কৃষিজমিতে তারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করা ছাড়াও দূরদূরান্তে ধান কাটা ও বোনার সময় কাজ করতে যান। আবার, কাজের শেষে ফিরে আসেন। সময়ে বনের লতাপাতা, ফলমূল জোগাড় করে আনা, শিকার করা ও মাছ ধরা তাদের অর্থনৈতিক জীবনে বিরাট অংশ জুড়ে থাকলেও এদের এক বড়ো অংশ চা বাগান, কয়লাখনি বা কারখানার অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ নিয়েছেন। আবার, কিছু কিছু সাঁওতাল শিক্ষিত হয়ে অফিস, আদালত, শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি করছেন। কিছু সংখ্যক পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। 

 চাষবাস (Agriculture): 

সাঁওতালরা কৃষিজীবী সম্প্রদায়। এঁরা তিন ধরনের জমি চাষ করেন। বার্গে (Barge), গোরা (Gora) ও খেত (Khet)। বার্গে হল বাড়ির লাগোয়া জমি, বিশেষ করে বাড়ির পিছন দিককার জমি। এখানে তারা ভুট্টা, বিন, মটরশুঁটি, সিম ও শাকসবজি লাগান। 'গড়' হল বাড়ি থেকে সামান্য কিছু দূরে অবস্থিত একটু জমি। এখানে বিভিন্ন প্রকারের ডাল, জোয়ার, কার্পাস চাষ হয়। 'খেল' বলতে পাহাড়ের ঢালে ধাপ কাটা ধান খেত।

জমি (Land) : 

সাঁওতালরা মনে করেন অতীতে জমিতে তাদের যৌথ অধিকার ছিল। কিন্তু জমি গ্রামের চাষিদের (যে-মাঝি, ফা-মাঝি, পাড়ানিক) জন্য নির্দিষ্ট থাকত, যা থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ হত, আর গ্রামের উৎসবের জন্য কিছু জমি রাখা হত। আর পরম্পরাগত গ্রামবাসীরা বর্তমান জমি থেকে পাওয়া কিছু টাকা সেবার জন্য প্রদান করেন।

 শ্রমবিভাগ (Working Groups) :

পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে কাজের ভাগ আছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বর্ষার শুরুতেই পুরুষেরা জমিতে সার দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। লাওল দেওয়া, জমি সমান করা ও বীজ ছড়ানো পুরুষদের কাজ। আর মহিলারা বীজ এক জায়গা থেকে তুলে অন্যত্র রোপণ করেন। দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্ম জল আনা, জ্বালানির জন্য কাঠ কাটা, বাসন ধোওয়া, রান্নাবান্না করা, বাচ্চা মানুষ করা, ঘর পরিষ্কার করা ছাড়াও স্বামীর জন্য মাঠে খাবার নিয়ে যাওয়া তাদের একটি কাজ। ছোটো ছেলেদের নিজের পরিবারের গোরু, ছাগল, ভেড়া দেখাশোনার দায়ীত্ব দেওয়া হয়। কখনও কখনও গ্রামের অন্য পরিবারের গোরুও তারা চরায়, এদেরকে রাখাল বলে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বসে থাকে না। তারাও মাঠে কাজ করেন বা বাড়িতে থাকলে গৃহস্থালির কাজ করেন। সাঁওতালদের মধ্যে সমবায় শ্রম ব্যবস্থা চালু আছে।

শিকার (Hunting) : 

শিকারে পুরুষরা অংশ নেন। শিকারের উদ্দেশ্যে পাহাড় এবং বনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক ভাগের দায়ীত্ব একজন ডিহরি (Dihri)-র ওপর থাকে। তিনি শিকারের আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। কোথায় শিকার পাওয়া যাবে বা শিকারের সময় যাতে দলের কোনও ক্ষতি না হয়, এই জ্ঞান থাকায়, তাঁকে এই দায়ীত্ব দেওয়া হয়।


বার্ষিক শিকারে (ডিসমু সেন্দ্রা) গোটা গ্রামের পুরুষেরা যৌথভাবে অংশ নেন। এই সময় যারা যেখানে থাকেন, তারা নিজের গাঁয়ে ফিরে আসেন। এই ধরনের অভিযানে যা পাওয়া যায়, সেগুলি তাদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়। সাঁওতালদের প্রধান শিকার বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় হয়। ফি-বছর বুদ্ধ পূর্ণিমার আগের দিন দূর-দূরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ অধিবাসী এসে জড়ো হয় পুরুলিয়ার রুক্ষ পাথুরে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে। এটা সাঁওতালদের বহু পুরোনো উৎসব। বয়স্করা যুবকদের সংসার ও সমাজের ভার দেওয়ার আগে এই শিকারে এসে তাদের দীক্ষা দিন। এখনওসেই চল চলে আসছে। ধীরে ধীরে এই শিকার উৎসবের রূপ নিচ্ছে। যদিও এটা ঠিক বর্তমানে অযোধ্যা পাহাড়ের বনভূমি ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বনের পশুও এই উৎসব বর্তমানে নিয়ম রক্ষার্থে চলছে, বললে অত্যুক্তি হয় না।


খাদ্য (Food):

 এরা সাধারণত দুবার খায়। সকালে পান্তাভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে যায়। সন্ধেতে ফিরে এসে গরম ভাতের সঙ্গে একটু নুন, লঙ্কা, শাকভাজা পেলেই সন্তুষ্ট। অতিথি আসলেই মাছ, মাংস পাতে পড়ে। বাচ্চাদের নির্দিষ্ট খাবারের সময় নেই, খিদে পেলেই তারা খায়। পুকুর বা নদীর মাছ, বন ও মাঠের ছোটো ছোটো শিকার তারা ওই স্থানেই ঝলসিয়ে খায়। অবসর পেলেই এরা তীরধনুক নিয়ে শিকার খোঁজার চেষ্টা করে। পচানো ভাত দিয়ে তৈরি হাঁড়িয়া এরা পান করে। গরমকালে ও যে-কোনো উৎসবে হাঁড়িয়া খেয়েই তারা রাত কাটিয়ে দেয়। মহুয়া ফুল থেকে তৈরি মদ তাদের খুব প্রিয় পানীয়


গৃহস্থালির সাজসরগাম 

এদের চাষবাসের সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে জমিতে হাল দেওয়ার জন্য লাঙল, মাটির চটলা সম্মান করার জন্য মই (আর গম), মাটি কোপানোর জন্য কোদাল (কুদি), ধান কাটার জন্য কাস্তে। বাড়ির আসবাবের মধ্যে রয়েছে খাটিয়া, মাদুর, বসার তক্তা, উদ্‌খল, ঢেঁকি, গানবাজনার জন্য বাঁশি, ঢোল (ধামসা), মাদল, কেনগ্রি (বেহালার মতো), মাছ ধরার জন্য আছে ছাঁকনির জাল, খেপলা জাল, যুদ্ধ ও শিকারের জন্য তীর ধনুক, কেঁচা, বর্শা, কুড়োল, টাঙ্গি, তলোয়ার, বর্ম।।

গ্রাম ও ঘরবাড়ি (Settlement and house): 

সাঁওতালদের গ্রাম সাধারণত আয়তনে ছোটো, 10টি থেকে 35টি পরিবার নিয়ে এক-একটি গ্রাম। প্রধান রাস্তার দুধারে বাড়িগুলি গড়ে ওঠে (লাইনবন্দি বসতি)। একটু উঁচু স্থানে যেখানে কখনও জল জমবে না, সেই সব জায়গায় গ্রামগুলি গড়ে ওঠে।


সাঁওতালদের গ্রামের প্রবেশমুখে থাকে একটি পবিত্র থান, যার চলতি নাম হল জাহের থান (Jahar than)। এটি শালবনে অবস্থিত। এখানে প্রধান দেবদেবীর আবাস। গ্রামের প্রধান রাস্তার পাশেই থাকে গ্রাম প্রধানের বাস তার কাছেই থাকে মাঝি থান। এটি গ্রাম পত্তনকারী প্রথম প্রধানের আত্মার স্থান। বর্তমানে অনেক সাঁওতাল গ্রামে কূট, টিউবওয়েল ছাড়াও কোনো কোনো গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ক্লাবঘর চোখে পড়ে। ঘরগুলি সাধারণত লম্বায় 5 মিটার, চওড়ায় 5 মিটার ও ও মিটার উঁচু হয়। প্রধান ঘরের এক কোণে দেওয়াল দিয়ে। ছোটো জায়গা রাখা হয়। একে ভিতরে ঘর বলে। এটি পরিবারের প্রধান দেবতার স্থান। ছাদের কাঠামো বাঁশ বা গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি। এইগুলিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঠামো তৈরি করা হয়। ছাদের চাল ঢালু ও বেশ নীচে পর্যন্ত নেমে আসে। তাতে করে দাওয়ার ওপর চাল নেমে একটা বারান্দা মতো। এখানে তারা ঢেঁকি, জাঁতি রাখেন। এখানে রাতে শোওয়া, আবার রান্নাবান্নাও হয়। শীতকাল বা বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এখানে।

শোওয়া হয়। প্রতি বাসগৃহের ভিতরে ভাগ থাকে। দরজা একটাই, তা সচরাচর নীচুই হয়। ঘরগুলিতে সাধারণত জানলা থাকে না। দেওয়ালের অনেক উঁচুতে ছোটো ছোটো আয়তাকার গর্ত থাকে। তাই ঘরগুলি ধোঁয়াটে। দেওয়ালগুলি সাদা, লাল, কালো মাটি দিয়ে ছবি আঁকা হয়। দাওয়া মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে তৈরি করা হয়। তাতে আবার কালো রঙ করা থাকে। বাড়িতে গোরু, মোষ, শুয়োর রাখার ঘর থাকে। বাড়ির পিছনে শাকসবজি ফলানো হয়।


পোশাক ও সাজসজ্জা (Clothes and Deconation):

 সাঁওতাল পুরুষদের কাজের পোশাক হল কৌপীন (একখণ্ড) ছোটো কাপড়, মেয়েরা মোটা শাড়ি (পাঁচ হাত), যার এক দিকটা কোমরে জড়ানো অপর দিকটা বুকের ওপর থেকে পিঠের দিকে নেমে এসেছে। ইদানীং পুরুষেরা ধুতি, শার্ট ব্যবহার করছে। যুবকরা প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, মেয়েরা ব্লাউজ ও শাড়ি ধরে 5/6 বছরের শিশুরা সাধারণত প্যান্ট পরে, জামা খুব একটা পরে না। সাঁওতালি মেয়েরা পরিষ্কার থাকতে ও দেহ গয়না ও ফুল দিয়ে সাজাতে ভালোবাসে। প্রত্যেক যুবতী গলায় রুপোর তৈরি হাঁসুলি, মাথার ফুল কানে রিং, হাতে বালা পরে। এ ছাড়া সারা দেহে বিশেষ করে হাতে, পিঠে, গলায় নানারকমের ফুল, পাখি, মাছ দিয়ে উল্কি এঁকে নিজেদের সাজায়।


 হস্তশিল্প 

সাঁওতাল মেয়েরা হস্তশিল্পে পটু। তাদের ঘরের দেওয়ালে নানা রঙের কাজ তারই প্রমাণ। মোষের শিং থেকে তারা বাঁশি তৈরি করে। তা ছাড়া মহুয়া ফুল থেকে তারা ঘানিতে তেল তৈরি করে।

 সামাজিক গঠন :

 অন্যান্য উপজাতিদের মতো সাঁওতালদের একটা নিজস্ব সামাজিক সংগঠন রয়েছে। নিজেদের গোত্র ছাড়া অন্য গোত্রে এদের বিয়ে হয় না। এদের মধ্যে 12 টি গোত্র আছে হাঁসদা, মুর্মু, কিসকু, হেমব্রম, মাণ্ডি, সোরেন, টুডু, বাস্তে, বেসরা, পাউড়িয়া, চাড়ে, বড়োয়া। প্রত্যেক গোত্র বা কুলের একজন গোত্র দেবতা থাকে। যেমন— হাঁসদাদের হাঁস, পাউরিয়ার পায়রা, বেসরাদের বাজপাখি, চাড়ের গিরগিটি প্রভৃতি। ওই গোত্রের লোকেরা। কখনও ওই সব প্রাণী মারে না। অনেকের ধারণা, অতীতে প্রতিটি গোত্রের মানুষদের বেশ কিছু পরম্পরাগত বৃত্তি ছিল। যেমন—সোরেনদের সৈনিকের কাজ, টুডুদের কামারের কাজ, মুর্মুদের পুরোহিতের কাজ। গোত্রের মধ্যে চাড়ে ও বেসরাদের স্থান সবার নীচে।


সাঁওতাল সমাজ পিতৃকেন্দ্রিক, ছেলেমেয়েরা বাবার গোত্রে পরিচিত হয়। প্রতিটি গোত্র প্রতিটি উপগোত্রে বিভক্ত। উপগোত্রের প্রধান কাজ ধর্মকে কেন্দ্র করে বিবর্তিত হয়।

 জীবনচক্র (Lifecycle) :

সাঁওতালদের জীবনচক্রে 4টি পৃথক ভাগ আছে—জন্ম, বয়ঃপ্রাপ্তি, বিয়ে ও মৃত্যু। গর্ভবতী মাকে ধাই দেখাশোনা করে। শিশু জন্মানোর পরে ধাই একটা ধারালো ছুরি দিয়ে শিশুর নাভিটা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে। 

শিশু জন্মানোর পর বাড়ি ও গ্রামটি আচার-অনুষ্ঠানের দিক দিয়ে অপবিত্র হয়ে পড়ে, গ্রামে কোনো উৎসব হয় না। সদ্যোজাত শিশুর বাড়িতে গ্রামের কেউ অগ্রজল গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত শুদ্ধিকরণ উৎসব হচ্ছে। ছেলে হলে 5 দিনের দিন, মেয়ে হলে 3 দিনের দিন এই উৎসব হয়। এই উৎসবে শিশুর নাম দেওয়া হয়। শিশুর নামকরণ একটা নিয়ম মেনে হয়। যেমন বড়োছেলের নামকরণ প্রপিতামহের নামে, সেজ ছেলের নাম হয় মায়ের সম্পর্ক ধরে।

সাঁওতালদের দ্বিতীয় উৎসব হল দীক্ষান্তকরণ যা বিয়ের আগেও 4 থেকে 12 বছরের বয়সের মধ্যে সেরে ফেলতে হয়। এ ছাড়া কোনও সাঁওতাল পুরুষের বিয়ে হবে না বা তাকে মরার পর পোড়ানো হবে না যদি না এই উৎসবের মাধ্যমে সাঁওতাল পুরুষ সামাজিক স্বীকৃতি পায়।


বিয়ে (Marriage) :

 সাঁওতালদের মধ্যে কনে পণ প্রথা চালু আছে (গনম টাকা)। সামাজিক বা আর্থিক মর্যাদা যার যাই থাক না কেন, কনে পণ প্রথার পরিমাণ একই রকম। বিয়ে সংক্রান্ত দীর্ঘ কথাবার্তার এক সন্ধিক্ষণে কনের পরিবারের লোকজন বরের বাড়িতে আসে। তখন কনেপক্ষকে 11 টাকা ও 5 টিন ধান দিতে হয়। বিয়ের দিন বরকে আরও এক টাকা দিতে হয়। সন্তান লাভের আশীর্বাদ হিসেবে কনের ভাই বরের কাছ থেকে একটা গাড়ীও পায়। এই ধরনের ব্যবস্থার মূল কথা হল যে, তাঁরা শুধুমাত্র সন্তানের জননী হয়, রোজকার উৎপাদনমুখী কাজেও তাদের বিরাট ভূমিকা আছে। যারা কনে পণ দিতে পারে না, তাঁদের পক্ষে ঘরজামাই প্রথা হল এক বিকল্প ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে বর-কনের বাবার বাড়িতে থাকে ও 5 বছর ধরে শ্বশুরের জমিতে খাটে।


মৃত্যু (Death) : 

গর্ভবতী মহিলা বা শিশু ছাড়া বাকি সবাইকে দাহ করা হয় নদী বা জলাশয়ের ধারে। বড়ো ছেলে  মুখাগ্নি করে। এদের সৎকার হিন্দু সমাজের মতো। মৃত্যুর 6 দিন পরে তেল নাহান অনুষ্ঠান হয়। ওই দিন তারা তেল দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে।


রাজনৈতিক গঠন (Political Structure) 

সাঁওতালদের রাজনৈতিক কর্মধারা গ্রাম্য পরিষদ (পঞ্চায়েত) দ্বারা পরিচালিত হয়। গ্রামীণ সমাজে যে-কোনও সমস্যার সমাধান এই পরিষদের হাতে থাকে।

 

উৎসৰ (Festival) : 

 বাস্তবে সাঁওতালদের জীবনে উৎসব এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবসর পেলেই, বিশেষ করে ফসল কাটা হয়ে গেলে এরা প্রায় সন্ধ্যেবেলা নারী-পুরুষ সমবেত হয়ে নৃত্যে অংশ নেয়। বাদ্যযন্ত্র সহকারে পরিবেশিত এদের নৃত্য পরিবেশন বেশ তারিফ করার মতো।


ধর্ম (Religious) :

 সাঁওতালদের ধর্মীয় ব্যবস্থায় অশরীরী দেবতাদের একটা প্রধান স্থান আছে। বর্তমানে অবশ্য হিন্দু ধর্মের প্রভাব তাঁদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সাঁওতালদের 7 টি বড়ো উৎসব হল— 

(i) এরো সিম (Ero Sim)→ খেতে বীজ বোনার আগে জুন মাসের অনুষ্ঠান 

(ii) হাঁরিয়াড় সিম (Hariar Sim) → বীজ থেকে চারাগাছ গজানোর সময়কার অনুষ্ঠান 

(iii) এরিগুণ্ডলি মইবাই (Iri gundli mauwai) → বজরার প্রধান ফলকে কেন্দ্র করে প্রার্থনা, 

(iv) কান্সার (Fanthar) হল আমন ধানের প্রথম ফুল আসার সময়কার উৎসব। 

 (v) বাহা (Baha) হল বসন্ত উৎসব। মহুয়া, বুনো ফল ও ফুলের প্রথম কুঁড়ি আসার সময়কার প্রার্থনা। এ ছাড়া বসন্তে পিচকারির সাহায্যে রঙিন জল ছিটিয়ে খেলাও অনুষ্ঠিত হয়। আর বছর শেষের প্রার্থনা হল 

Baha

(vi) মাঘসিম (Magh Sim) ফেব্রুয়ারি মাসে এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে চাষবাসের কাজ শেষ হয় ও উৎসবের শেষে গ্রামবাসীরা সামাজিক ভাবে তাদের বাড়িতে খড় আনার অনুমতি পায়। এই খড় দিয়ে ঘর ছাওয়া হয়।

(vii)  সহরাই (Sohrai) → হল ফসল কাটার উৎসব। জানুয়ারি মাসে 6 দিন ধরে এই উৎসব চলে।


সাঁওতালরা অসংখ্য দেবদেবী, অশরীরী আত্মার পুজো করে। এদের প্রধান দেবতা মাথাযুক্ত বা সিংবোঙ্গো। তাঁদের বিশ্বাস, এই সূর্য দেবতা জীব, বৃষ্টি, ফসল ও আর সব দরকারি উপকরণ জোগান দেয়। সিংবোঙ্গো ছাড়া আর সব দেবতা পাহাড়, বন, নদী, জলাশয় ও অন্যান্য স্থানে থাকে। 

এদের বিশ্বাস, এই সিংবোঙ্গোদের মানুষের ক্ষতি করার প্রচুর ক্ষমতা আছে। তাই তারা এদের পুজো করে। দেবতা ছাড়াও তারা অশরীরী আত্মা যেমন ভূত, প্রেত, রাক্ষস ইত্যাদি মারে।


যাদুবিদ্যা ও ডাইনি বিদ্যায় তারা বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করে ডাইনিদের হেরাগ ও মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা আছে।

সাম্প্রতিক পরিবর্তন(Recent change):

সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসে সাঁওতালদের জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এতদিন পর্যন্ত তাঁরা জমিদার, মহাজন, ঠিকাদারদের শোষণের শিকার ছিল। কিন্তু শিক্ষার প্রসারের ফলে ও রাজনৈতিক জগতের কল্যাণে তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা খুব সচেতন হয়েছে, যার ফলশ্রুতি হচ্ছে ঝাড়খন্ড রাজ্যের সৃষ্টি। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের যথাযথ উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছেন। একদিকে দিনের পর দিন বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে নিঃশেষ হচ্ছে বনের কাঠ ও বনের উপজাত দ্রব্য। এর ওপর আবার সরকার বন সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন করে তাদের বনে অবাধ অধিকার নিয়ন্ত্রণ করেছে। বন ধ্বংসের ফলে মাটিও ক্ষয় হচ্ছে। আর তা চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। সুখের কথা, স্থানীয় অধিবাসীরা ও সরকার এই সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছে ও সমস্যার সমাধানে সরকার সমাজভিত্তিক বনসৃজনের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এ ছাড়া তাঁরা পুরোনো বৃত্তি ছেড়ে কয়লাখনিতে কিংবা কলকারখানায় অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।


উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষিত সাঁওতালরা সভ্য লোকদের সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে ততটা সচেতন নন। এককালে যে সহিঞ্চুতা, সরলতার জন্য তারা সবার দৃষ্টি কেড়েছিল, আজ তা অনেকটাই তাদের মধ্যে দেখা যায় না। তবুও বলা চলে, গ্রামাঞ্চলের সাঁওতালরা তাদের পুরোনো রীতিনীতি, সংস্কৃতিকে অনেকটা আঁকড়ে রেখেছে।

Middle post ad 01