welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

জারোয়া উপজাতী (Jarawas tribes )

ভারতের বঙ্গোপসাগরের অন্তর্গত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি বিচ্ছিন্ন উপজাতি হল জারোয়া। আন্দামানি ভাষায় "জারোয়া' অর্থে 'আগন্তুক' (Stranger) বোঝানো হয়,

 ভূমিকা (introduction)

ভারতের বঙ্গোপসাগরের অন্তর্গত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি বিচ্ছিন্ন উপজাতি হল জারোয়া। আন্দামানি ভাষায় "জারোয়া' অর্থে 'আগন্তুক' (Stranger) বোঝানো হয়, একই সঙ্গে জারোয়া'-র নিজেদের 'আ' (Ang) রূপে পরিচয় দিয়ে থাকে। প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বভাগ পর্যন্ত জারোয়াদের জীবন-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি আমাদের কাছে প্রায় অজানাই ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা তৎকালীন ভারতবর্ষে এসে জারোয়া গোষ্ঠী সম্পর্কে গবেষণামূলক তথ্য আহরণ শুরু করলে জারোয়া গোষ্ঠী একটি স্বকীয় জনজাতি রূপে আমাদের কাছে পরিচিতি পায়।

 পরিচয় (Identity) : 


ঐতিহ্যগত দিক থেকে জারোয়াদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে যথেষ্ট মতানৈক্য থাকলেও কোনো কোনো বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ মনে করেন, জারোয়াদের আদি বাসস্থান ছিল আফ্রিকা। 'জাঙ্গিল' উপজাতির বংশধর এই জারোয়া গোষ্ঠী আজ থেকে প্রায় 55000 বছর আগে সুদূর সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের জন্য চলে আসে এবং অভিযোজনের মধ্যে দিয়ে আজও এখানে নিজেদের বিশুদ্ধ জাতি সত্তাকে টিকিয়ে রেখেছে।


জারোয়াদের সামগ্রিক পরিচিতি (General introduction to Jarawas)

বাসস্থান (Habitat)

জারোয়া জনগোষ্ঠী দক্ষিণ আন্দামান এবং মধ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিমাংশ বরাবর বসবাস করে।


প্রকৃতি (Nature) 

জারোয়ারা মূলত আধুনিকতার প্রভাব মুক্ত, খাদ্যসংগ্রাহক, শিকারি, অকুতোভয় এক জনজাতি।


নৃতাত্ত্বিক পরিচয় (Ethic identity)

জারোয়ারা নিগ্রোয়েড নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত।


দৈহিক গঠন (Physical form)

সমস্ত জারোয়াই (i) মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট, (ii) গোলাকৃতির মস্তক, (iii) ঠোঁট পুরু, (iv) নাক প্রশস্ত, (v) দেহত্বক গাঢ় কালো, (vi) ঘন কোঁকড়ানো (fizzly) চুল বিশিষ্ট।


গোষ্ঠী ( Group)

জারোয়া জনজাতিরা ওটি প্রধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত, যেমন- (i) 'তনমদ' (Tanmad) এরা হল উত্তর দিকের একটি বিশেষ দল। (ii) 'থিডং' (Thidong) → এরা আন্দামানের পশ্চিম মধ্যভাগের দল। (ii) 'বোইয়ার' (Bolab) এরা হল আন্দামানের দক্ষিণ-পশ্চিমের দল।


ধর্ম (Religion)

জারায়াদের নিজস্ব কোনো ধর্ম না থাকলেও এরা প্রকৃতির উপাসক বা সর্বপ্রাণবাদী (Animist)।


ভাষা (Language) 

জারোয়ারা ওশি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত 'জারোয়া' ভাষায় কথা বলে। 


জনসংখ্যা (Population)

2011 সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুযায়ী বর্তমানে আন্দামানে মাত্র 380 জন জারোয়া জনজাতি বসবাস করে।


■ জারোয়া সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক অভিযোজন (Natural Adaptation of Jarowa Community) :

 দীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে আন্দামানের অরণ্যময় দুর্গম পরিবেশে বিচ্ছিন্ন ভাবে জারোয়ারা বাস করতে করতে বেঁচে থাকার একাধিক অভিযোজনগত কৌশল আয়ত্ত করেছে, 

যেমন—

খাদ্য সংক্রান্ত অভিযান (Food- related adaption) :

আন্দামানের সমুদ্র-উপকূলবর্তী দ্বীপময় অরণ্যভূমির সঙ্গে জারোয়াদের খাদ্য সংক্রান্ত অভিযোজন যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ। এরা খাদ্য সংস্থানের জন্য খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকারের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।

খাদ্যসংগ্রহ : 

খাদ্যাহারের দিক থেকে জারোয়ারা সর্বভুক। তাই জারোয়াদের মূল খাদ্যসংগ্রহস্থল হল বনভূমি।এরা বন থেকে ফল, মৃগ, মধু, লার্ভা, লতাপাতা প্রভৃতি সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো আরোয়া সম্প্রদায় একটি লাঠির ডগায় বন্য ডালের আংটা লাগিয়ে কলা, নারকেল, পেপে কিংবা কাঁঠাল প্রভৃতি গাছ থেকে পেড়ে নেয়। জারোয়া মহিলারা বেলাভূমি থেকে কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপের ডিম কিংবা সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছ সংগ্রহ করে থাকে।

শিকার : 

খাদ্যসংস্থানের ক্ষেত্রে শিকার পদ্ধতি জারোয়াদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিকারের জন্য অতি প্রাচীন কাঠের ধনুক বা 'আস্ত' (Aay), ভিন্ন বা 'পাথো' (patho), ছোটো-বড়ো ধারালো বিশিষ্ট বর্শা বা 'কোচ' (koach) প্রভৃতি ব্যবহার করে। জারোয়ারা এই ধরনের অস্ত্রগুলিকে জল থেকে মাছ কিংবা বন থেকে শুকর বা কুকুর শিকার করতে ব্যবহার করে। প্রায় 15-20 ফুট দূর থেকে কয়েকজন পুরুষ মিলে তির ছুড়ে পশুগুলিকে শিকার করে থাকে।

অনেকসময় জারোয়ারা লাইলনের সুতো দ্বারা নির্মিত একটি বিশেষ ভালকে মাছধরার কাজে ব্যবহার করে। একে 'ঘোম' (Thom) বলা হয়।

প্রসঙ্গত, জারোয়ারা 'থুলা' (Thula) নামক ফাঁকা স্থানে একটি আগুনকুণ্ডে যাবতীয় খাবারকে ফুটিয়ে, সেদ্ধ করে কিংবা ঝলসিয়ে রান্না করে খায়। রান্নার কাজে পুরুষ ও মহিলা উভয়েই অংশ নেয়। জারোয়াদের একটি অতি প্রিয় খাবার হল সেদ্ধ করা বড়ো গিরগিটি।

পোশাক সংক্রান্ত অভিযোজন (Cloths-related adaptation) :


আন্দামানের অবস্থানগত বিচ্ছিন্নতা এবং জলবায়ুগত প্রতিকূলতা জারোয়াদের পোশাক সংক্রান্ত অভিযোজন ঘটিয়ে থাকে।


সাধারণত জারোয়া পুরুষ কিংবা মহিলা সম্প্রদায় উভয়ই কোনোরকম পোশাক পরতে পছন্দ করে না। তবে কখনো কখনো এদের দেহের নিম্নাংশ ঢাকতে গাছের পাতা বা ছালকে ব্যবহার করে। জারোয়া সমাজের অধিকাংশই অলংকার পরতে ভালোবাসে। এরা স্থানীয় ফুল, ফল, ঝিনুক কিংবা গাছের বাকল ব্যবহার করে বহু স্থায়ী এবং অস্থায়ী অলংকার মাথা, কোমর কিংবা গলায় ব্যবহার করে।


পুরুষ জারোয়ারা সমগ্র দেহে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে তার উপর কাঠি দিয়ে নানান ধরনের নকশা করতে পছন্দ করে। প্রায় যাযাবর প্রকৃতির জারোয়াদের সুনির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান না থাকলেও গৃহনির্মাণে এদের যথেষ্ট পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। এদের অধিকাংশ গৃহ অত্যন্ত ছোটো ছোটো কুঁড়ে বা চালার মতো দেখতে। প্রায় গোলাকৃতির এই ধরনের গৃহ নির্মাণ করতে ভারোয়ারা স্থানীয় বাঁশ বা লতাপাতা, বেত ব্যবহার করে।


জারোয়াদের বৈচিত্র্যপূর্ণ বসতিগুলিকে 'ছাড়ড়া' (chadda) বলা হয়। এগুলি আবার বিভিন্ন ধরনের হয়, যেমন—

 (a) টুটিমে ছাড়ড়া (Tutime chadda) :

 কুঁড়ে ঘরের ন্যায় এই ধরনের অস্থায়ী বসতিগুলি উচ্চতা 5 ফুট, লম্বায় এবং চওড়ায় 5 থেকে 5.5 ফুট হয়ে থাকে।


(b) ছাড়া ডি-হুপু (Chadda-da-huthu ) : 

এগুলি মূলত গোলাকার বা ডিম্বাকার প্রায় স্থায়ী বাসগৃহ, যেখানে 4–5টি কিংবা কখনো কখনো 20-25টি পরিবার একত্রিত ভাবে বসবাস করে। এটি হল জারোয়াদের বর্ষাকালীন বাসগৃহ।


(c) থরকালাং ছাড়া (Thorkalang chadda) :

 এটি একটি অতি ক্ষুদ্র বাসগৃহ, যেখানে কোনো অবিবাহিত কিংবা বিপত্নীক জারোয়া বসবাস করে।


(d) থরকংগো ছাড়া (Thorkongo chadda) : 

এই ধরনের বাসগৃহ অত্যন্ত ছোটো এবং এখানে কোনো অবিবাহিত কিংবা বিধবা জারোয়া মহিলারা বসবাস করে।


আর্থ-সামাজিক অভিযোজন (Socio-economic adaptation) :


সামাজিক দিক থেকে জারোয়াদের অভিযোজনকে কয়েকটি বিশেষ ভাগে আলোচনা করা যায়। যেমন


(a) পরিবার গঠন (Family making) : 

একটি জারোয়া পরিবার গড়ে ওঠে স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে। জারোয়া সন্তানরা মাত্র ছয়-সাত বছর পর্যন্ত তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটায়। এর পর থেকে অবিবাহিত ছেলে এবং মেয়ে থরকালাং এবং থরকংগো ছাড়ায় আশ্রয় নেয়। খুব অল্প বয়স থেকেই জারোয়া সন্তান-সন্ততিরা দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং শিকার এবং খাদ্যসংগ্রহে অংশ নেয়। জারোয়া সন্তানরা বিবাহের পরে তারা নতুন পরিবার গঠনের সুযোগ পায়।


(b) বিবাহ (Mariage) : 

জারোয়া সমাজের ছেলে-মেয়েরা অতি অল্প বয়স থেকেই যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে। তাই এদের বেশির ভাগ বিবাহ কৈশোর বয়সেই সম্পন্ন হয়। বিশেষ করে জারোয়া ছেলেদের 18-20 এবং জারোয়া মেয়েদের 14-15 বছর বয়সেই বিবাহ হয়ে যায়।


এখানকার প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মেয়েরা ঋতুমতি হওয়ার পরেই পরিবারের বয়স্ক কোনো ব্যক্তি তাদের বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করে। এই সময় কয়েকদিন মেয়েটিকে দলের বাইরে পৃথকভাবে বসবাস করতে হয় এবং হবু স্বামী ওই অবস্থায় তাকে জীবনসঙ্গীরূপে বেছে নেয়। সন্তানসম্ভবা মেয়েদের আলাদা রাখা হলেও পরিবারের সকলে মিলে তার দেখাশোনা করে। শিশু জন্মের 2-3 বছর সময়কাল পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারও তাদের দেওয়া হয়ে থাকে।


(c) সামাজিক গঠন (Social structure) :

 জারোয়া সমাজে বেশির ভাগ কাজ পুরুষদেরই করতে হয়। মূলত যাবতীয় শিকারকার্য, গৃহ বানানো, খাদ্য সংগ্রহ এরাই করে থাকে। কতবে ছোটো ছোটো শিকার এবং খাদ্যসংগ্রহে মহিলারাও অংশ নেয়। জারোয়া সমাজে শিশুরা কখনোই অবহেলিত হয় না। সমগ্র জারোয়া সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রাধান্য থাকে। এদের সমাজে তিনটি সুস্পষ্ট গোষ্ঠীর সন্ধান মেলে, যথা—

(i) পরিবার :

 জারোয়াদের পরিবারকে একটি ব্যক্তিগত গোষ্ঠী বলা হয়। এই ধরনের পরিবার স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে গড়ে ওঠে।


(ii) স্থানীয় গোষ্ঠী : 

এই ধরনের ছোটো ছোটো গোষ্ঠী স্থানীয় ভাবে নিরন্তর ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠে। এদের দলগুলিতে মাঝেমধ্যেই কিছু জারোয়ার সংযোজন বা বিয়োজন ঘটে থাকে।


(iii) আঞ্চলিক গোষ্ঠী : 

জারোয়াদের আঞ্চলিক গোষ্ঠী যথেষ্ট বৃহৎ হয়। প্রতিটি আঞ্চলিক গোষ্ঠীর খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকার এলাকার স্থান ভিন্ন ভিন্ন, যেখানে অনুমতি ছাড়া এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর এলাকায় ঢুকতে পারে না। তবে দুটি পৃথক আঞ্চলিক গোষ্ঠীর মধ্যে কখনো কখনো খাদ্যদ্রব্য বিনিময় কিংবা উপহার প্রথা পরিলক্ষিত হয়।


জারোয়া সমাজ সূর্যকে ইহে' (Ehey), মেঘকে ইথিবিথি' (Ethibithi), উচ্চ জোয়ারকে চাকতে' (Chakte) এবং নিম্ন জোয়ারকে ‘চিগিয়া' (Chigia) নামে অভিহিত করে।


(d) সংস্কৃতি (Culture) :

 জারোয়া সংস্কৃতিতে এদের দলবদ্ধ প্রকৃতি বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছে। সর্বদা আনন্দে থাকা জারোয়া সম্প্রদায় পূর্ণিমার আলোকোজ্জ্বল রাত্রিগুলিতে নাচ-গানে মেতে ওঠে। এই সময় পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই নিজেদের অলংকৃত করে রাখে। জারোয়াদের নাচ 'পালোহা' (Paloha) এবং গান 'গেগাপ' (Gegap) নামে পরিচিত।

 (e) উৎপাদন (Productivity) : 

জারোয়া সমাজ আদিম অর্থনীতি কেন্দ্রিক হওয়ায় এখানকার সমস্ত জনগোষ্ঠী সরাসরি কোনো উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত না-থেকে খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকারের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। জারোয়া গোষ্ঠীর কাছে আন্দামানের ক্রান্তীয় বনভূমি একটি বিরাট সম্পদের ভাণ্ডার রূপে বিবেচিত হয়।

(f) বণ্টন (Distribution) :

 জারোয়ারা প্রকৃতি থেকে যা-কিছু সংগ্রহ করে, দলের সকলের মধ্যে তা সমানভাবে বণ্টিত হয়। এখানকার সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা বলে কিছুই থাকে না। অনেকসময় একাধিক জারোয়া গোষ্ঠীর মধ্যে সংগৃহীত খাদ্যদ্রব্যকে ঘিরে বিনিময় প্রথা লক্ষ করা যায়। জারোয়া সমাজে কাউকেই বঞ্চিত করে রাখা হয়। না।


(g) মৃত্যু (Death) : 

কোনো জারোয়ার মৃত্যুর পর এখানকার প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী তার মৃতদেহটিকে কোনো গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কিছুদিন পর তা পচে গেলে, মৃতের শরীরের কোনো হাড় কিংবা চোয়ালের নীচের পাটি (mandible)-কে দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে রাখে। এই ভাবে জারোয়ারা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।


জারোয়া সম্প্রদায়ের সমস্যা (Problems of jarwas   Community ) : 

দীর্ঘকাল থেকেই জারোরা সম্প্রদায় সমস্যায় জর্জরিত। 

যেমন-


(i) বহিরাগতদের আগমন : 

জারোয়া সমাজে বহিরাগত বা অজারোয়া (non-Jarwas) সম্প্রদায়ের আগমন একটি বিরাট সমস্যা। এই ধরনের বহিরাগতরা জারোয়াদের অসভ্য-বর্বর জাতি ভেবে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কিংবা গালিগালাজ করে থাকে।


(ii) পর্যটনের প্রভাব :

 আন্দামানে পর্যটকরা বেড়ানোর জন্য যে আন্দামান ট্র্যাঙ্ক রোড (NH4) ব্যবহার করে তা জারোয়া অধ্যূষিত অঞ্চলের মধ্যে দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে। এমনকী 2006 সালে জারোয়া বসতি থেকে মাত্র 3 কিমি দূরত্বেই ভারতীয় পর্যটন কেন্দ্রের একটি রিসর্ট গড়ে তোলা হয়। এর ফলে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পর্যটক জারোয়াদের বিভিন্ন খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ক্যামেরাবন্দি করতে চায়। এতে বহু জারোয়া অত্যন্ত বিব্রত হয়।

(iii) চোরাকারবারীদের আধিপত্য : 

সম্প্রতি আন্দামানের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আকর্ষণে জারোয়াভূমিতে বিভিন্ন চোরাকারবারীর আধিপত্য ক্রমশ বাড়ছে, ফলে জারায়োদের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

(iv) যৌন নির্যাতন : 

অনেকসময় বাইরে থেকে আগত কিছু মদ্যপ অসৎ ব্যক্তি অর্থ এবং খাদ্যের লোভ দেখিয়ে জারোয়া মহিলাদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন চালায়।

(v) ভূমিদখল : 

আন্দামানের বিভিন্ন জারোয়া অধ্যুষিত বনভূমির মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, হিউম্যান সাফারি, অবৈধ শিকার প্রভৃতির জন্য জারোয়ারা ধীরে ধীরে বাস্তুহারা হতে বসেছে।

(vi) সংঘৰ্ষময় জীবন : 

অতি প্রাচীনকাল থেকেই জারোয়ারা নানান সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, যেমন


1875-1900 সালে ইংরেজরা জোর করে জারোয়াদের তাদের পুরানো বসতি থেকে উৎখাত করলে জারোয়াদের সঙ্গে ইংরেজদের তুমুল সংঘর্ষ হয়।


• পোর্টব্লেয়ারের কাছাকাছি ইংরেজ বসতিতে জারোয়ারা যাতে অনুপ্রবেশ না করতে পারে সেইজন্য ইংরেজরা ‘Bush police' নামক সুরক্ষাবাহিনী গড়ে তোলে, যাদের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু জারোয়া মারা যায়।


• 1942-45 সাল পর্যন্ত আন্দামান-নিকোবর জাপানের অধিকারে থাকাকালীন জাপানিরা বোমাবর্ষণ করে। অসংখ্য জারোয়া বসতিকে ধ্বংস করে দেয়।


(vii) রোগের প্রাদুর্ভাব : 

ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজরা তৎকালীন ভারতবর্ষে এসেই জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। এর ফলে 1875-1890-এর মধ্যে ইংরেজ সংস্পর্শে হাম (Measles) এবং সিফিলিস (Syphilis) রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে।


* পরিবর্তন (Changes) : 

জারোয়া সমাজ আন্দামানের প্রতিকূল পরিবেশ এবং সংঘর্ষময় জীবনে আজও টিকে থাকলেও তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। কারণ—

(i) জারোয়ারা মুক্ত পরিবেশে স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাবলম্বী জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

 (ii) আন্দামানের 350 প্রজাতির প্রাণী এবং 150-এরও বেশি উদ্ভিদ প্রজাতির বিশদ জ্ঞান জারোয়াদের রয়েছে।

(iii) এদের বেঁচেথাকার যাবতীয় উপকরণ প্রকৃতি দ্বারাই সুরক্ষিত। তাই আন্দামানের বনভূমিগুলি তাদের প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি দেয়।


তবে ভারত সরকার সাম্প্রতিক কালে জারোয়া জনজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, 

যেমন-

(i) জারোয়াদের একাধিক সমস্যা উপলব্ধি করে সুপ্রিম কোর্ট জারোয়া অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে সমস্ত ধরনের পর্যটনমূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।


(ii) জারোয়া জনগোষ্ঠী যাতে বিব্রত না হয় সেইজন্য এদের বসতি অঞ্চলের 5 কিমি দূরত্ব পর্যন্ত অঞ্চলকে ‘Buffer Zone' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।


(iii) 2004 সালে আন্দামান প্রশাসন জারোয়া জীবনযাত্রায় সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন এবং ন্যূনতম হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।


(iv) তা ছাড়া জারোয়া জনজাতিগুলিকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচাতে ভারত সরকার নানা ভাবে তাদের জীবনদায়ী ঔষধ সরবরাহ করে।


উপসংহার (Conculsion) : 

বর্তমানে জারোয়া সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞমহল যথেষ্ট উদ্‌বিগ্ন। যে-হারে জারোয়া সংখ্যা কমে যাচ্ছে আগামী দিনে কোনো একসময় তারা হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যদিও জারোয়ারা ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দামানের বহিরাগতদেরও জারোয়াদের বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল হতে হবে। কারণ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে, তা জারোয়াদের টিকে থাকার জন্য সত্যই ভয়ংকর। সম্প্রতি Anthropological Survey of India থেকে প্রকাশিত 'Perticularly Vulrerable Tribal Groups of India' গ্রন্থে জারোয়াদের জীবনকেন্দ্রিক গবেষণাপত্র সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Middle post ad 01