welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

মাওরি জনজাতি (Maori Tribe)

আগমনের ইতিহাস – মাওরি ভাষায় মাওরি কথার অর্থ 'সাধারণ' অর্থাৎ তারা নিজেদের প্রকৃতির ‘সাধারণ সন্তান' বলেই নিজেদের মনে করেন। বর্তমানে অধিক সংখ্যায় নিউ

 মাওরি জনজাতি(Maori        Tribe)


পরিচিতিঃ 

আগমনের ইতিহাস – মাওরি ভাষায় মাওরি কথার অর্থ 'সাধারণ' অর্থাৎ তারা নিজেদের প্রকৃতির ‘সাধারণ সন্তান' বলেই নিজেদের মনে করেন।

 বর্তমানে অধিক সংখ্যায় নিউজীল্যান্ডে এবং অল্পসংখ্যায় অস্ট্রেলিয়ায় মাওরিগণ বসবাস করেন। মনে করা হয় মাওরিগণ পলিনেশিয়ার দ্বীপবাসী যারা ‘কায়াক' (Kayak) বা ছিপ নৌকোয় সমুদ্র পাড়ি দিতেন, এই অঞ্চলে ১২৫০-১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে আগমণ করেন ও নির্জন দ্বীপে নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন। তারা যে যে 'কায়াক’-এ চড়ে এসেছিলেন সেই কায়াক-এর মানুষজনেরই ১০-১৫ পরবর্তী প্রজন্মের বর্তমান মানুষ বলে বিশ্বাস করেন। শ্বেতাঙ্গদের আগমণ ঘটে মাওরিদের আগমনের অনেক পরে।


 

 ২০১৭ খ্রীষ্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মাওরি জনসংখ্যা নিউজীল্যান্ডে ৭ লক্ষ ৩৪ হাজার ২০০, যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৫.৪ শতাংশ। যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০ এবং মহিলা ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার ৮০০। অষ্ট্ৰেলিয়ায় মাওরি জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৪২ হাজার ১০৭ জন (২০১৬)।

ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তার : 

সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। তবে প্রথম দিকে তেমন কোনো দ্বন্দ তৈরী হয়নি ইউরোপীয়দের সাথে এবং উভয়পক্ষ মিলেমিশে এই অঞ্চলে বসবাস করতে থাকেন। ফলে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে মাওরি সংস্কৃতিতে।

 ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে ‘ওয়াইটাঙ্গি' (Waitangi) চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দু-পক্ষ শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। তবে অনতিকাল পরেই, ১৮৬০-এর দশকে জমিসংক্রান্ত বিবাদে উভয়পক্ষ জড়িয়ে পড়েন। সরকার লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি অধিগ্রহন করায় বহু মাওরি বাস্তুচ্যুত হন। মাওরিদের নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও ইউরোপীয়দের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা সংঘাতের রূপ নেয়।

 পরবর্তীকালে রোগ, মহামারিতেও মাওরিদের মধ্যে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় মাওরি জনসংখ্যা চিন্তাজনকভাবে হ্রাস পায়। 

তবে বিংশ শতাব্দীতে অবস্থার উন্নতি ঘটে। ইউরোপীয় ও মাওরিদের মধ্যে বোঝাপড়ার উন্নতি ঘটে।

 মাওরিগণ নিউজীল্যান্ডের বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায় দাবী আদায়ে অনেকটাই সমর্থ হন।

 এই প্রসঙ্গে ১৯৬০-এর দশকে মাওরি প্রতিবাদী আন্দোলন (Maori Protest Movement) উল্লেখনীয়। তবে এখনো বেশকিছু সংখ্যক মাওরি আর্থিক ও সামাজিকভাবে ইউরোপীয়দের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। তাদের জীবনযাত্রার মান, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষায় অগ্রগতি ইত্যাদি এখনো বেশ পিছিয়ে।

 এই শ্রেণীব্যবধান সংকোচনে সরকারীভাবে বেশকিছু উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়।


সমাজ ব্যবস্থা :

 ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে মাওরিগণ সংঘবদ্ধ ছিলেন না, বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। তবে পলিনেশীয় সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব সকল গোষ্ঠীর মধ্যেই বজায় থাকে। 

বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনই কেবল ছিল না, আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহেও কোনো বাধা নেই। তবে মাঝে মাঝে খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের জন্য আন্তঃগোষ্ঠী বিবাদও স্বাভাবিক ছিল, যার ফলে মাওরি যুবকগণ লড়াই -এর প্রশিক্ষণ নিতেন।

 মাওরি সমাজে 'আউই' (lwi) শব্দটি জনজাতি গোষ্ঠীকে বোঝায়। মাওই জনজাতি অনেকগুলি আউই-তে বিভক্ত। তবে আরো ছোটো ছোটো দলে যে সাংগঠনিক বিভাজন ছিল সেগুলিকে মাওরি ভাষায় 'হাপু' (Hapu)বলে। 

হাপু গঠিত হয় বর্ধিত পারিবারিক শাখা-প্রশাখা বা 'হোয়ানাউ' (Whanau or Extended Family Groups) নিয়ে। এরা একই পূর্ব-পুরুষের বংশধর বলা হয়। হাপু একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দল যারা নিজস্ব কৃষিজমিতে চাষাবাস করে এবং মাছ ও পাখি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

 এক বা একাধিক হাপু নিয়ে একটি গ্রাম গঠিত হত। হাপু দলনেতাকে 'আরিকি' (Ariki) বলা হত। তিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দুটি ভূমিকাই পালন করতেন। কখনো কখনো ধর্মীয় ভূমিকা নিজহাতে রেখে আত্মীয় কাউকে অন্যান্য বিষয়ের দায়ীত্ব দিতেন। 

পারিবারিক কর্তা মাওরি ভাষায় হলেন 'কাউমাটুয়া' (Kaumatua)। সভাগৃহকে বলা হত 'হয়ারে রুনাগা (Whare runanga) এবং সভা প্রাঙ্গনকে বলা হত 'মারে' (Marae)। 

বিভিন্ন কাজে দক্ষ বা বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিকে বলা হত ‘তোহুঙ্গা' (Tohunga)। তারা অন্যান্যদের তাদের কাজের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। গোষ্ঠীর বংশগত গৌরব 'মানা' (Mana) রক্ষায় তারা সবসময় তৎপর ছিলেন।


সংস্কৃতি (Culture) : 

শত শত বর্ষ বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ শূণ্য থাকায় মাওরিগণ নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। তবে তা পলিনেশীয় সংস্কৃতি দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত। মাওরিদের নিজস্ব ভাষা গড়ে উঠেছে। হস্তশিল্প ও অন্যান্য কৃৎ-কৌশলে তারা দক্ষ।




‘হাকা” (Haka) একটি যুদ্ধ নৃত্য যা বিশেষ জনপ্রিয়। এটি পূর্বে যুদ্ধের আগে করা হত। অতিথী আপ্যায়ণেও এর আনুষ্ঠানিক প্রদর্শণ প্রচলিত ছিল।

পূর্ব পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা এই অঞ্চলের মাওরি সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়েছে। পরস্পরের নাকে নাক ঘষে অভ্যর্থনার রীতি প্রচলিত। অনেকেই ঠোঁট ও থুতনিতে ট্যাটু (Tatoo) করতে ভালোবাসেন।


ধর্ম (Religion) : 

ধর্মগতভাবে এরা নিজস্ব উপজাতীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং প্রাকৃতিক ও অতি-প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাসী। 'আইও' (lo) হলেন উপাস্য সর্বশক্তিমান। ইউরোপীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকে পরবর্তীকালে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন।


বিবাহ (Marriage) :

 প্রথাগত বিবাহ ব্যবস্থায় বয়স্করা মিলিত হয়ে আলোচনা পূর্বক সম্মতি দেন। বিবাহপূর্ব মেলামেশায় স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে প্রেমঘটিত বিবাহে সাধারনভাবে বাধা নেই। বিবাহে ভুড়িভোজের ব্যবস্থা থাকে।


খাদ্য (Food): 

মাওরি ভাষায় 'কাই' (Kai) হল খাদ্য। টাটকা ও প্রাকৃতিক উপাদানের স্বাদে বিশিষ্টতা পায় মাওরি খাদ্য। মাছ ও পশু-পাখির মাংস খাদ্যে প্রোটিন যোগায়। 'কুমারা' (Kumara) বা মিষ্টি আলু রান্নার একটি জনপ্রিয় উপকরণ। এছাড়া বিভিন্ন সব্জি ও দানাশস্য রান্নার উপকরণ। মাটির মধ্যে গর্ত করে তৈরী উনুনকে বলা হয় 'হাগি' (Hangi) যাতে এরা রান্না করত। এখনো গৃহে এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় হাঙ্গি-ডিস জনপ্রিয়। হাঙ্গিতে রান্নার উপকরণ মাছ সহ অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্য (Sea food), মুরগি, মিষ্টি আলু ইত্যাদি।

অর্থনীতি (Economy) : 

বাগান কৃষি (Horticulture) কয়েকশ' বছর আগে থেকেই প্রচলিত। পূর্বে এই চাষের পাশাপাশি শিকার ও সংগ্রহ জীবনযাপন প্রণালীর অঙ্গ ছিল। বর্তমানে অধিকাংশ মাওরি বিভিন্ন আধুনিক পেশা ও ব্যবসায় ইউরোপীয়দের মতই নিজেদের নিযুক্ত করেছেন এবং নিউজীল্যান্ডে আধুনিক কৃষি ও শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে সামিল হয়েছেন। তবে প্রথাগত কর্ম হিসেবে বাগানকৃষি ছাড়াও ট্যাটু শিল্পী, নৌকা ও গৃহ নির্মান, কাঠের কারুশিল্প ইত্যাদিতেও কিছু মাওরি নিযুক্ত রয়েছেন।

দক্ষিণ দীপের উপকূলে প্রাপ্য গ্রীনস্টোন (Greenstone) এবং মাওরি দ্বীপে প্রাপ্য অবসিডিয়ান (Obsidian) এর ব্যবসা আগে হত।



ইউরোপীয়দের তুলনায় মাওরিদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার গড় মান পিছিয়ে আছে। মাওরিদের এক বৃহদংশ নিউজিল্যান্ডের ইউরোপীয় সমাজ ও সংস্কৃতিক সঙ্গে বর্তমানে নিজেদের মিশিয়ে নিলেও বহু প্রচলিত মাওরি রীতিনীতি তারা ধরে রেখেছেন এবং দেশে সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের এক পরিমন্ডল গড়তে উভয়পক্ষই আগ্রহী। এর ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে মাওরিগণ বর্তমানে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

Middle post ad 01